রুদ্র-প্রচেতা: পর্ব ০২

ড. রাজুব ভৌমিক
ড. রাজুব ভৌমিক ড. রাজুব ভৌমিক , কবি ও লেখক
প্রকাশিত: ০৪:৫৬ পিএম, ২৯ অক্টোবর ২০১৯

বহুবার দেখিয়াছি বহু ছায়াছবি—সারতঃ বিটিভিতে শাবানা-আলমগীরের বিকেল সাড়ে তিনটার অনুরাগ ও গভীর প্রেমের ছায়াছবি। প্রত্যেক শুক্রবার সন্ধ্যায় বিটিভিতে ছায়াছবির পূর্ণাঙ্গ নিদর্শন শেষে নানা-ধরনের প্রশ্ন আমার মাথায় ছটকাইয়া উঠিত। যেমন—আলমগীর সাহেবের এক লাথি দিয়া বাড়ির দরজা দ্বি-খণ্ডিত করা, শাবানাকে প্রথমবার দেখিবার পরে সঙ্গে সঙ্গে ফুলের বাগানের মধ্যে নাচানাচি, গান গাওয়া এবং জেলহাজতের চৌদ্দ বছর সময় এক মিনিটে সম্পন্ন করাসহ আরও কত কি! কিন্তু এই সব প্রশ্নের কোন উত্তর আমি কখনো পাইতাম না। সমবয়সীদের জিজ্ঞেস করিলে নানা ধরনের উত্তর আমি পাইতাম—কিন্তু কোন সঠিক উত্তর মিলিত না। এ ছিল যেন এক অন্ধের কাছে আরেক অন্ধের প্রকৃতির সৌন্দর্য সম্পর্কে জিজ্ঞাসা। এতদ্ভিন্ন যখন বয়স্ক কাউকে এই সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতাম তাহারা কেন জানি আড়চোখে তাকাইত আর বলিত—দূর হ... তোর এই সব জানিবার বয়স এখনো হয়নি। একটু বড় হইলে সব ঠিকই বুঝিতে পারিব বলে ইহারা প্রতিনিয়ত আমাকে আশ্বাস দিত। কিন্তু আজ যখন তাহার নয়নে আমার দুই নয়ন মিলল; তখন আমার ছায়াছবির একটি প্রশ্নের উত্তর ঠিক মিলিয়া গেল। আজ বুঝিতে পারিলাম, কেন আলমগীর-শাবানাকে প্রথমবার দেখিবার মাত্র নাচানাচি বা গান গাইত—আজ যে আলমগীরের মত আমি তাহাকে প্রথমবার দেখিবার পর আমার হৃদয়খানি আনন্দে নাচিতে লাগিল। আমার স্তম্ভিত হৃদয়ে কত সুরের সঞ্চারণ হইল। তাই আজ আমি তাহার নাম সুর-সঞ্জীবনী রাখিলাম।

মোর দুই চক্ষু হইল জঙ্গলের কচুপাতা কোলাহল, সখির বদনখানি সেথায় ভাসিল হইয়া জল। সুর-সঞ্জীবনীর বাড়ির সামনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করিবার পর আমি সেই স্থান ত্যাগ করিলাম—কিন্তু সুর-সঞ্জীবনীর ঐ বদন আমার দুই চোখের উপরে ভাসিত লাগিল। জ্যাঠা মশাইদের বাসার সামনে দুই হাতে বাজারের দুই থলে নিয়া আমি হাজির হইলাম। জেঠীমা আমারে দেখিয়া অবাক, ‘কি রে রুদ্র তুই আবার কখন আসলি। দে বাজারের ব্যাগ দুটি আমারে দে। তোর জ্যাঠা মশাইয়ের জন্য দুপুরের রান্না করিতে হইবে।’ আমার মুখ থেকে কোন শব্দ হইল না। একি আমি কি বাকরুদ্ধ হইলাম?

যে মোর হৃদয়ে করিল সুরের সঞ্চারণ, সে কি করিল মোর বন্ধ বদন! ‘আ আ আ..’ করিয়া আমার স্বর নিরীক্ষণের জন্য একবার চিৎকার করিলাম। ‘কিরে তোর কী হইয়াছে? চিৎকার করলি কেন?’ জেঠীমা জিজ্ঞাসা করিলেন। আমি জেঠিমাকে পুনরায় উত্তর দিতে পারলাম না—তবে আমার স্বরের যে কোন সমস্যা হইল না, সেটা নিশ্চিত বুঝিতে পারিলাম।

মধ্যাহ্ন ভোজ অন্ত্য করিয়া জ্যাঠা মশাইদের বাসার সবাই এখন গভীর নিদ্রায় মগ্ন। এদিকে ভর দুপুরবেলায় বাসার বাইরে যেতে জ্যাঠা মশাইয়ের কড়া মানা কারণ তখন নাকি ছেলেধরা বা গলাকাটাদের হাতে ধরা পড়িবার সম্ভাবনা বেশি। মধ্যাহ্ন ভোজ শেষে আমি ঠাকুরমা এবং জেঠতো ভাই জীকু একসাথে পালঙ্কের উপর ঘুমাইতে লাগিলাম। আমার নিদ্রা বিন্দুমাত্র আসিল না। পালঙ্কের উপরে কাত হইয়া আমি তাহার কথা ভাবিতে লাগিলাম। তাহাকে নিয়ে ভাবনা যেন মিলনের সমতুল্য। মনের মানুষকে নিয়ে ভাবনা যদি এত মধুর হইয়া থাকে তাহলে তাহার সংস্পর্শ নিশ্চিত স্বর্গসুখ-তুল্য। ঠাকুর-দাদা বৈকুণ্ঠলোকে যাইবার পূর্বে আমাকে একদিন কহিলেন, ‘রুদ্র, সুখের নেশায় মানুষ সবসময় মত্ত, কিন্তু মানবজীবনে দুঃখই অনর্গল।’ তিনি পুনশ্চ ধরিত্রী, স্বর্গ এবং নরক সম্পর্কে আমাকে ধারণা দিবার চেষ্টা করিতেন। তখন আমি ওসব বুঝিতাম না। কিন্তু সেদিন বিছানায় কাত হইয়া ধীরে ধীরে আমি সব বুঝিতে পারিলাম—সুর-সঞ্জীবনীই আমার স্বর্গ এবং তাহার সংস্পর্শ বিনে প্রত্যেক মুহূর্ত যেন নরকের সমান। কিছুক্ষণ পর প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেবার ভান করিয়া আমি চুপ করিয়া বিছানা থেকে উঠিলাম। তাহাকে আরেকটিবার দেখিবার লোভ সামলাতে পারিলাম না। কী করেই বা এ লোভ সামলাই—অন্যসব মানুষের মত আমিও যে সুখের নেশায় মত্ত হইয়া ছুটিতেছিলাম।

বাসা থেকে বাহির হইয়া আমি জ্যাঠা মশাইদের বাসার সামনে পুকুরটির ঘাটে একটু দাঁড়াইলাম। জ্যাঠা মশাইদের বাসা থেকে সুর-সঞ্জীবনীদের বাসা একটু বামদিকে এবং দূরত্ব বড়জোর দুইশ হাত হইবে—এর বেশি এক হাতও হইবে না। ভরদুপুরে আশেপাশে গলাকাটা ও ছেলেধরাদের ভয়—কিন্তু আজ যেন ওসব কিছুই আমার মস্তিষ্কতে আসিল না। কিছুক্ষণ দাঁড়াইয়া থাকিলাম—কী করিব তাহা বুঝিতে পারিলাম না। এরপর একটু দূরে দাঁড়াইয়া তাহাদের বাসার দিকে তাকালাম—কিন্তু তাহাকে দেখিতে পারিলাম না। মনটা বেশ খারাপ হইল—এ নয়নে বর্ষাকালের সূচনা হইল। বহুবার শুনিয়াছিলাম নরক আগুনের রাজধানী—আগুন নিভাইতে জলের কোন বিকল্প নাই। তাহাকে না দেখিবার নরকে তখন আমি পুড়িতেছিলাম—তাই সে আগুন নিভাইতে নয়নজুড়ে জল আসিতে লাগিল। তখন আমি অনুভব করিতে পারিলাম যে সখি বিনে এমন নরকের জ্বালা শতবর্ষের নয়ন জলেও নিভানো সম্ভব হইবে না। কিছুক্ষণ পর আমার জেঠতুতো ভাই জীকু আমার সামনে আসিল। জীকু বয়সে আমার সমতুল্য কিন্তু সে খুব সহজ-সরল প্রকৃতির একজন। জীকু কহিল, ‘কি রে তুই এখানে কী করতেছিস?’ সে আমার নয়নের ধারা দেখিয়া তখন কিছু বুঝিতে পারিল না। আমি জীকুকে বলিলাম, ‘এ বাসাতে কারা থাকে রে জীকু?’ তখন সে একে একে সবার নাম কহিল। জীকুর কাছ থেকে জানিতে পারিলাম আমার সুর-সঞ্জীবনীর প্রকৃত নাম প্রচেতা।

প্রচেতাকে আর একবার দেখিবার জন্য সেদিন পুরো বিকেলবেলাটি আমি জ্যাঠা মশাইদের বাসার সামনে দাঁড়াইয়া জীকুর সাথে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলিলাম। খেলাতে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না—খেলতে খেলতে বহুবার তাহাদের বাসার দিকে তাকিয়েছিলাম। প্রচেতাকে আর দেখিতে পারিলাম না। সন্ধ্যাবেলায় জ্যাঠা মশাইদের ঘরে ঢুকলাম—অন্তরের ঝড় কিছুতেই যেন থামতে চাইতেছে না। ইচ্ছে করেছিল যেন সজোরে তাহার লাগি কান্না করিতাম—সেটাও করিতে পারিলাম না। সেদিন সারারাত এক মুহূর্তের জন্যও নিদ্রা আসিল না। মাকড়সার মত নিরলস সারারাত প্রচেতাকে নিয়ে স্বপ্ন সাজাইলাম। সে রাতে প্রচেতাকে একান্ত নিজের করিবার জন্য স্বপ্ন বুনিলাম না, শুধু চেয়েছিলাম তাহার বদন যেন সারাজীবন দেখিতে পাই। এ স্বপ্ন আমি সারাজীবন দেখিলাম—তাহার বদনখানি দেখিবার ভাগ্য যেন একটু মিলে। সখির বদনখানি যেন সাক্ষাৎ স্বর্গের ফটক—দেখিলে এ প্রাণে শীতল হাওয়া বয়ে যায়।

মসজিদে ও মন্দিরে মানুষ স্বর্গপ্রাপ্তির জন্য প্রতিদিন কত কি-না করিয়া থাকে—কিন্তু এ মানুষেরা কি কভু একবার থামিয়া ভেবেছিল স্বর্গে প্রবেশ করিলে তাহারা কী করিবে? স্বর্গসুখ সহ্য করিবার ক্ষমতা মানুষেরই কি আদৌ আছে? আমি সে রাতে বুঝিতে পারিলাম মানুষের স্বর্গসুখ সহ্য করিতে অক্ষম। আর সক্ষমই কি করে বা সম্ভব হইবে—ধরাতে মানুষ সুখের সন্ধান পাইলে কতই না অপকর্ম করিয়া থাকে। সেখানে স্বর্গের এত সুখের সামনে মানুষের দুর্ধর্ষ পাপী হইবার সম্ভাবনা বিস্তর। একদিন আমাদের গ্রামের বাড়ির পিছনে বোনদের সাথে মাটি নিয়ে খেলিতেছিলাম—মাটির পুতুল, মাটির মিষ্টি, এবং মাটির ঘর বানাইতেছিলাম। সুন্দর আমাদের দিন কাটিতেছিল—হঠাৎ একদিন আমি কোন অদৃশ্য কারণে আমি একটি কাঁচের বোতলের উপর আরেকটি কাঁচের বোতল দিয়া অভিঘাত করিতেছিলাম। ফল কী হইল নিশ্চয় সেটা ধারণা করিতে পারিতেছেন—হাত ও পায়ে কাঁচবিদ্ধ হইয়া রক্ত ঝরিতে লাগিল। সেদিন ঠাকুরমা বলিয়াছিলেন, ‘ওরে রুদ্র, তোর তো দেখি সুখে থাকিতে ভূতে কিলায়।’ তাহলে নিশ্চয় বুঝিতে পারতেছেন যে, যেখানে আমি সামান্য সুখে নিজেকে রক্তে জর্জরিত করিলুম সেখানে মানুষ পুরো স্বর্গ সুখে পাইয়া কী করিতে পারে? মানুষ স্বভাবত এমন—ইহাতে ঈশ্বরের কোন দোষ নাই। মানুষকে নিয়া তাহার ভিন্ন উদ্দেশ্য ছিল—কী ছিল তাহা বলিতে পারিব না। তবে আমরা প্রতিনিয়ত যাহা করিতেছি তাহা যে ঈশ্বরের উদ্দেশ্য নয় সেটা একটু আন্দাজ করিতে পারিলাম। আর তাই বোধ হয় আমি কখনো প্রচেতাকে আপন করিয়া পাইবার স্বপ্ন দেখিতে পারিলাম না। শুধু চেয়েছিলাম তাহার বদনখানি দেখিতে—তাহাকে পাইতে নয়। তাহার সংস্পর্শ পাইলে আমি স্বর্গে নিশ্চিত গমন হইবে। আর স্বর্গসুখে কোন অঘটন ঘটিয়া যায় তাহার কোন নিশ্চয়তা নাই।

পরের দিন সূর্যমামা উঠিবার পূর্বে আমি বিছানা ছাড়িয়া উঠিলাম। গন্তব্য এই মোল্লার একটাই—প্রচেতার বদন। খুব ভোরে উঠিয়া প্রচেতাদের বাসার আশেপাশে হাঁটিতেছিলাম। খুব আশা করিয়াছিলাম তাহার দেখা পাইব—কিন্তু না এইবারও আমি তাহার দেখা পাইলাম না। দেখিব বা কেমন করে—সবাই যে এখন গভীর নিদ্রায় শেষ রাতের স্বপ্ন দেখায় ব্যস্ত। হয়তো প্রচেতাও কোন স্বপ্ন দেখিতেছে। অনেকে পরমেশ্বরের কাছে কত কিছুই না চায়—ঐ দিন যদি আমি পরমেশ্বরের দেখা একটু পাইতাম। তাহলে তাহাকে বলিতাম নিয়ে যাও প্রভু মোরে, সখির স্বপ্নরাজ্যে। তাহাকে স্বপ্নের রাণী বানাইতাম—তাহার চরণতলে এ হৃদয় সমর্পণ করিতাম। চিরে দেখাইতাম মোর এ হৃদয়খানি।

জ্যাঠা মশাই প্রতিদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠিত। বাজারের মাছের আড়তে যাইয়া বড় বড় তাজা মাছ কিনিত। তিনি আমাকে এত ভোরে সখির বাড়ির সামনের রাস্তায় দেখিয়া হতবাক—অতঃপর একটি ধমক দিয়া তিনি কহিলেন, ‘যা আরেকটু ঘুমা।’ জ্যাঠা মশাইয়ের একটি ধমক খাইয়া আমার মাথার ভিতর ‘প্রচেতা’ ভূতটির সঙ্গে সঙ্গে অন্তর্ধান হইল। সোজা জ্যাঠা মশাইদের বাসাতে প্রবেশ করিলাম এবং ঘুমিয়ে পড়িলাম।

সারাদিন বহুবার চেষ্টা করিয়াও প্রচেতার সাক্ষাৎ মিলল না। চিন্তা করিলাম—তাহার দেখা কী আর পাইব, নাকি ঐ দেখা ছিল ঈশ্বরের কোন দুষ্টামির একটা অংশ। জীবনে বহুবার লক্ষ্য করিয়াছি পরমেশ্বর তাহার জীবের সহিত দুষ্টামি করিতেছে। যেমনটি আমি করিতুম আমাদের কুকুরের সাথে—মাঝে মাঝে একটি মাংসের হাড় দেখাইয়া আমাদের কুকুরটির সাথে আমিও খেলিতাম। আর নিজেকে মাঝে মাঝে ঈশ্বর ভাবিতাম। ভাবিতাম ঈশ্বরও বুঝি আমাদের সহিত এমন? ঈশ্বরের এমনি না করিবার পিছনে নিজেকে কোন যুক্তি দিতে পারিলাম না। কারণ এই খেলাতে যে আনন্দ বিস্তর। যা-ই হোক, ঐ দিন আমি লক্ষ্য করিলুম পরমেশ্বরও আমাদের সহিত খেলিয়া ভীষণ আনন্দ অনুভব করিতেছে। তাহা না হইলে আমাকে পরমেশ্বর অযথা এত কষ্টই বা দিতে যাইবে কেন।

আগামীকাল আমাকে গ্রামের স্কুলে যাইতে হইবে। তাই ঠাকুরমা বিকেলে আমাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাইবার জন্য প্রস্তুত হইতেছিল। আমার গ্রামের বাড়িতে যাইবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে করিতেছিল না। অতঃপর প্রচণ্ড ব্যথা অন্তরে ধারণ করিয়া জ্যাঠা মশাইদের বাসা ছাড়িলাম—ঠাকুরমার উদ্দেশ্য রাস্তা সামনে দাঁড়াইয়া একটি রিকশা ভাড়া করিবার। কিছুক্ষণ পর একটি রিকশা সামনে আসিল এবং ঠাকুরমা রিকশার চালকের সহিত ভাড়া নির্ধারণের প্রচেষ্টা চালাইতেছে। হঠাৎ দেখিলাম প্রচেতা আমার পাশ কাটিয়া তাহার বাসার সম্মুখে যাইতেছিল। আহা... কী শান্তি অনুভব করিলাম—এ যেন গ্রীষ্মের তাপদাহে কৃষক সারাদিন পরিশ্রম করিবার পর একটু বৃষ্টির ছোঁয়া পাওয়া। আমি তাহার বদন-পানে একদৃষ্টিতে চাহিতে লাগিলাম—তাহাকে একবার দেখিলে কী আর প্রাণ ভরিবে? এ ক্ষুধা আমার যেন মুহূর্তে সহস্র-গুণ হইল। এদিকে ঠাকুরমা রিকশার চালকের সহিত ভাড়া নির্ধারণ করিয়া ফেললেন এবং তিনি আমাকে রিকশাতে উঠিবার জন্য তাগিদ দিলেন। ‘রুদ্র, ওখানে দাঁড়াইয়া কী দেখছিস। আয় রিক্শায় উঠিয়া বস।’ ঠাকুরমা বড় গলায় কহিলেন। তখন প্রচেতা ঠাকুরমার কথা শুনিয়ে পিছনে ফিরে তাকাইল—দু’চোখের মিলনের পুনরাবৃত্তি হইল। তখন মনে হইল আমার দু’চোখের জন্মই শুধু তাহারে দেখিবার—না হইলে তখন বিকেল বেলায় সূর্যমামা অস্ত যাওয়ার সময় হচ্ছিল আর চারিদিকে প্রকৃতির এত লীলাখেলা না দেখিয়া শুধু আমার তাহার নয়ন পানে দেখিবার বাসনা জন্মিল কেন।

রিক্শায় চড়িয়া গ্রামের বাড়িতে পৌঁছলে সন্ধ্যা ফেরিয়ে যায়। আজ আমি যেন এই গ্রামে নতুন হইয়া আসিলাম। একসময় যে গ্রামকে আমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মনে হইত—আজ সেখানে নিজেকে বেশ অতিথি মনে হইল। মনে হইল এই গ্রামে আমার বেশিদিন থাকিবার নয় কারণ আমার স্বর্গ যে সেই শহরেই—প্রচেতার নয়ন মাঝে। আমাদের গ্রামটির নাম শ্রীনদ্দি। এই গ্রামের নামটির মাহাত্ম্য এখন পর্যন্ত বুঝিলাম না। তবে ধারণা করিলাম যে কাহারো নিজস্ব নামে এই গ্রামটির নামকরণ হইয়াছে। ভদ্রলোকটির নাম হয়তো ছিল নদ্দি—যেহেতু এই গ্রামে বহু হিন্দু ধর্মালম্বীদের বসবাস তাই সে নাম শ্রীনদ্দি হইয়া গেল। আমাদের গ্রামটি আসলেই অদ্বিতীয়—ইহার শোভা অতুলনীয় এবং বৈচিত্রময় নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর। দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠে ভূইয়ার পুত্রদ্বয়ের চাষাবাদ দেখিবার মনোরম দৃশ্যটি কখনো ভুলিবার নয়। সারাদিন পাখিদের কোলাহল—এখানে রাতে পরীদের মত জোনাকিরা উড়িয়া যায়। শরতের শুভ্রতায় বৃষ্টি শরীরকে স্পর্শ করিলে এখানে স্বর্গসুখ উপলব্ধি হয়। সকালের ঘুম ভাঙিয়া যাইলে এখানে সূর্যমামার নরম রোদের ব্যবস্থা—আছে বহু রং মাখানো সূর্যমামার অপরূপ সূর্যাস্তের দৃশ্য এবং রাতের আকাশে চাঁদমামার ভালোবাসার আলো ছড়ানো। কী নাই এ গ্রামে—শুধু মোর প্রচেতা বিনে। ভাবিলাম, ইস যদি মোর প্রচেতা এই গ্রামের হইত। তাহলে এই প্রাণের সঞ্জীবন একটু হইত। রামায়ণে পড়িলাম রাম ও লক্ষণ ইন্দ্রজিতের শক্তিশেলের আঘাতে আহত হইয়া যখন তাহাদের প্রাণ যায় যায় অবস্থা তখন হনুমান তাহাদের জন্য মৃত-সঞ্জীবনী আনতে যায়। হিমালয়ের দুর্গম চূড়ায় ওষধি গুণযুক্ত মৃত-সঞ্জীবনী লতা চিনতে না পারিয়া অবশেষে গোটা ঋষভ পর্বত উপড়ে এনেছিলেন পবনপুত্র হনুমান। তখন মোর মনের গহীনে কিছু আশার সঞ্চার হইল—হয়তো একদিন আমিও ভালোবাসার হনুমান দিয়া আমার প্রচেতাকে এই মনোরম গ্রামে আমার প্রাণের সঞ্চারণ করিবার জন্য আনিত সক্ষম হইব।

বাড়িতে আসিয়া সন্ধ্যায় পড়িতে বসিলাম। আর দেড় বছর যাইলে আমাকে মাধ্যমিক পরীক্ষায় যে বসিতে হইবে। পড়াশোনাতে একদম কোন মনোযোগ নাই বললেই চলে। হঠাৎ মাথায় এক বুদ্ধির উদয় হইল—প্রচেতার একটি ছবি আঁকিতে হইবে। ছোটবেলা থেকেই মাঝে মধ্যে দু-একটি ছবি আঁকিবার চেষ্টা করিতাম। অতটা ভালোভাবে অঙ্কন করিতে পারিতাম না। তখনকার সময়ে বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ছিল—না ছিল মুঠোফোন, না ছিল ক্যামেরা। আহা যদি তাহার একটি ছবি আমার কাছে থাকিত। তাহলে তাহাকে পরাণ ভরিয়া একটু দেখিতাম। অগত্যা আমি পড়িতে বসিয়া প্রচেতাকে আঁকিবার চেষ্টা করিলাম। বহুবার চেষ্টা করিবার পরেও তাহাকে সঠিকভাবে অঙ্কিত করিতে পারিনি। বারবার শুধু কাগজ ও পেন্সিল নষ্ট করিয়াছি কিন্তু পেন্সিল ও কাগজের সঠিক মিলন হইল না।

পরের দিন স্কুলে যাইলাম। ওটারহাট বিদ্যাপীঠের আমি একজন বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র। স্কুলে যাইয়া প্রথমে বন্ধু শুভাঙ্ককে খুঁজিতে লাগিলাম। শুভাঙ্কও বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র—শুভাঙ্কের পিতা অন্য এক শহরের একজন বড় আইনজীবী। অগত্যা শুভাঙ্ককে না দেখিয়া ক্লাসে বসিলাম। গিয়াসউদ্দিন স্যারের অঙ্কের ক্লাস শুরু হইতে আর বেশিক্ষণ বাকী নাই—কিন্তু ভাবিলাম শুভাঙ্ক গেল কই? গিয়াসউদ্দিন স্যার ক্লাসে প্রবেশ করিল—কিছুক্ষণ পর একে একে সবার হাজিরা ডাকিল কিন্তু শুভাঙ্কের কোন চিহ্ন নেই। ক্লাসের মধ্যসময়ে শুভাঙ্ক ক্লাসে উপস্থিত হইল—অতঃপর গিয়াসউদ্দিন স্যারের বেতের শাসানি। বেচারা শুভাঙ্ক কতই না মারটা খেল সেদিন। শুভাঙ্ক সাধারণত নিয়মিত স্কুলে আসে—দেরী সে কভু করে না বললেই চলে। ঐ দিন শুভাঙ্কের পাকস্থলী বিভাগে কোন এক অদৃশ্য কারণে সোরগোল হইতেছিল তাই শুভাঙ্ককে সোরগোল থামাইতে রাস্তার পাশে খোলা আকাশের নিচে অনাকাঙ্ক্ষিত বিরতি নিতে হইল—ব্যস এতেই শুভাঙ্কের স্কুলে আসিতে দেরী হইয়া যায়। পরের ক্লাসে বসিয়া আমি শুভাঙ্কের সহিত প্রচেতাকে নিয়ে গল্প করিতে শুরু করিলাম। কিছু না বুঝিয়া শুভাঙ্ক কহিল, ‘বেটা তুই একটা বাচ্চা ছেলে। এসব প্রেম-টেম ভালো না।’ শুভাঙ্ক এমনভাবে কহিল যে, সে আমার বাপ-দাদার সমতুল্য। বয়সে আমরা দু’জন সমান সমান। তারপরও একটু ভাবিয়া বুঝতে পারিলাম, আসলেই সে সত্য বলিতেছিল। আমিই বা এসবের কী বুঝি?

আমাদের বাড়ি হইতে স্কুলের দূরত্ব প্রায় দেড় মাইল। প্রতিদিন স্কুল শেষ হইলে আমাদের প্রায় দেড় মাইল হণ্টন করিয়া বাড়ি যাইতে হয়। আজও স্কুলে শেষ করিয়া হাঁটিতে শুরু করিলাম। পথে শুভাঙ্কের উপদেশ বাণীগুলো আমি বহুবার ভাবিতে লাগিলাম। কিন্তু শুভাঙ্কের কথাকে বিশ্বাস করিলাম না—কারণ একমাত্র আমিই জানি যে, প্রচেতা শব্দের মানে কী। শুভাঙ্ক যা-ই বলুক না কেন—প্রচেতাকে বিনে আমি বাঁচিতে পারিব না।

চলবে...

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।