প্রদীপ মাহবুবের চারটি কবিতা
১.
তোমার গায়ের গন্ধ মেখে
এক ফোঁটা ভালোবাসার জন্য
নিসঙ্গ নিশাচরের মতো
কাটিয়েছি কত না নির্ঘুম রাত!
তোমার ছোঁয়া পেতে
প্রায় অর্ধমৃত হৃৎপিণ্ড
ছুটে বেড়িয়েছে দিনরাত
নীল আকাশের ফুটপাতে!
আজও ঘুমের ঘোরে
কোনো এক অজানা স্পর্শে
শিহরিত হয় ক্ষুধাতুর অবশ অনুভূতি।
শেষ রাত্তিরে আচমকা জেগে ওঠা
টগবগে রক্তাক্ত চাখ
নিমিষেই মুখ থুবড়ে পড়ে
ঠিক উল্কার মতো।
আমি অন্ধকারে হাত হাতড়ে
খুঁজে ফিরি সেই প্রিয় ঘ্রাণ!
তোমার কোমল হাতের পরশ
আজও পুষে রেখেছি
বুকের বাঁ পাশে-
খুব সযত্নে।
কতবার পথ হারাতে চেয়েছিল
উতলা হৃদয়!
আশেপাশে কত স্বপ্নের হাতছানি!
মাতাল হওয়ার কত না আয়োজন!
হাত বাড়ালেই শরীরী ভালোবাসা;
তবু তোমার গায়ের গন্ধ মেখেই
পথ চলেছি অবিরাম, ক্লান্তিহীন।
২. পাশাপাশি
হাজার লোকের ভিড়ে
পাশাপাশি ছিলাম কেবল আমরা দুজন,
সাক্ষী ছিল সন্ধ্যাতারা আর নিঝুম বাতাস-
স্বপ্নের মতোই কেটেছিল কিছুটা সময়!
তোমার চোখের নীলে হারিয়ে-
উড়েছিলাম মেঘেদের দেশে;
দক্ষিণা বাতাসে দোল খাওয়া এলোকেশে
হৃদয়ে লেগেছিল বসন্তের ছোঁয়া,
বুকের বসনের অপূর্ব চাহনিতে
মিটেছিল আজন্মের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব।
হাতের কোমল পরশে
তপ্তবুকে নেমেছিল স্বর্গীয় সুখ,
তোমার নিশ্বাসে নতজানু হয়েছিল
আমার উঞ্চ ঠোঁটের আহ্বান;
নির্মল হাসিতে পরাজিত হয়েছিল
আমার কামনার দৃষ্টি!
পাশাপাশি বসার ক্ষণে
পরাজিত হয়েছি আমি,
অকপটে বলতে পারিনি
চলো পালাই, দূরে কোথাও, অজানায়!
পাশাপাশি বসার কিছুটা সময়ে
প্রেম জন্মেছিল আমার মনে,
তুমি কি পড়েছিলে কিছুটা প্রেমে?
বিদায়ের ক্ষণে আমার চোখে এসেছিল
ক’ফোটা জল!
পাশাপাশি বসলেই কি প্রেম হয়?
৩.
ভালোবাসার মহাকাব্য
তোমাকে নিয়ে ভালোবাসার
একটি কবিতা লিখব বলে-
কাটিয়েছি কত সহস্র রাত!
একাকী নিদ্রাহীন;
আজও লেখা হয়নি একটি অক্ষর,
লিখতে চাইলেই অক্ষরগুলো
লজ্জায় আড়ালে মুখ লুকায়,
মেঘের ডানায় চড়ে পালিয়ে বেড়ায়
নীল আকাশের দূর সীমানায়!
ভালোবাসি শব্দটি লিখতে চাইলেই
কলমের বিদ্রোহে নত হয় সব্যসাচী হাত
অবশ ও শক্তিহীন হয় তেজোদীপ্ত আঙুল
বিদ্রুপে মেতে ওঠে প্রাণহীন খাতার পাতা!
ভালোবাসি কথাটি লিখতে চাইতেই
মস্তিষ্কের নিউরনে বাঁধে তালগোল
থমকে যেতে চায় ধমনীর প্রবাহ, আর
শিরা-উপশিরায় বয়ে চলে ঝড়!
ডাগর চোখে কাজলের কথা লিখতে চাইতেই
অবরোধ ডাকতে চায় চিত্রা হরিণের দল!
মুখের কারুকার্যের কথা লিখতে চাইতেই
নশ্বর পৃথিবীতে ফিরতে চায় কবি জীবনানন্দ!
নীল টিপ আর নীল শাড়ির কথা লিখতে চাইতেই
আকাশের নীল পরীরা বসত গড়তে চায় জমিনে!
বুকের জমিনে স্পর্শের কথা লিখতে চাইতেই
পাহাড়-পর্বত নেমে আসতে চায় এই সমতলে!
স্ফুলিঙ্গের মতো কামনার কথা লিখতে চাইতেই
আগ্নেয়গিরির লাভা হতে চায় শীতল বরফ!
কাব্যের নান্দনিকতায় সাজাতে চেয়েছিলাম
মনের অব্যক্ত পঙক্তিমালা;
আজও লেখা হয়নি প্রণয়ের সেই কাব্য!
আমি ক্লান্ত হয়ে অবশেষে বুঝেছি
আমাদের ভালোবাসা ধারণের ক্ষমতা
এই বিশ্বের কারোরই নেই!
যদি কখনও তোমার সাথে ফের দেখা হয়
পথে-প্রান্তরে, হাট-বাজারে, মসজিদ-মন্দিরে,
জলে কিংবা আকাশে-
বুকের বাঁ পাশে সজোরে জড়িয়ে
অকপটে ধ্বনিত হবে যে শব্দটি
তাতেই রচিত হবে
ভালোবাসার সেই অমর মহাকাব্য!
৪.
আমি বরং সমুদ্রকেই ভালোবাসবো
আমি বহুকাল আগে ভালোবাসা খুঁজতে
সমুদ্রে গিয়েছিলাম,
পড়ন্ত বিকেলে বালুর বুকে পা রাখতেই
সমুদ্র আমাকে কানে কানে বললো,
তোমার হৃদয়ের অগ্নিশিখা দিয়েই
আজ আমি এত উত্তপ্ত।
নোনাজলে পা ভেজাতেই
মৃদু হেসে সমুদ্র আমাকে বললো,
তোমার চোখের কাছে নোনাজল ধার করেছি।
আনমনে ঢেউয়ে গা ভাসাতেই
সমুদ্র আমাকে চিৎকার করে বললো,
তোমার প্রমত্ত হৃদয়ের কাছে এ নস্যি।
সমুদ্রের বিশাল আকাশে তাকাতেই
উড়তে থাকা গাঙচিলেরা বললো,
তোমার ভালোবাসার আকাশে উড়তে গিয়ে
হোঁচট খেয়েছি বারবার। তাই ফিরে এসেছি সমুদ্রে-
যেন দিন শেষে ফিরে যেতে পারি আপন গন্তব্যে।
সমুদ্রজলে ডুব দিয়ে গভীরতা মাপতে চাইতেই
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে সমুদ্র আমাকে বললো,
ফিরে যাও!
তোমার ভালোবাসার গভীরতার কাছে
আজও আমি এক নবজাতকের ন্যায়।
আমি বহুকাল থেকেই
তোমার ভালোবাসায় বিভোর। অথচ
আমার ভালোবাসার গভীরতা বোঝোনি।
যে বোঝে ভালোবাসা তাকেই তো ভালোবাসা উচিত!
আমি বরং সমুদ্রকেই ভালোবাসবো।
বিএ/জেআইএম