‘সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে’ পাঠে শান্ত হয় মন

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:০৯ পিএম, ২০ মার্চ ২০১৯

অনন্ত রায়হান

প্রতিদিন একটু একটু করে নয়, গাণিতিক পদ্ধতিতেও নয়, বলতে গেলে চোখের সামনে জ্যামিতিক হারে বদলে যাচ্ছে পৃথিবী। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে শুধু নয়, শিল্পকলা, সিনেমা, সাহিত্যও একই ধারায় অনুসৃত। সিনেমার আঙ্গিকে বিপ্লব, সংগীত ও কবিতায় চমকে দেওয়া উল্লম্ফন। ভালো-কী মন্দ, সে হিসেব যার যার নিজস্ব এবং অহেতুক তর্কের অবতার। কবিতা ব্যবচ্ছেদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েও পাঠে স্বস্তি-অস্বস্তি অনুভূতি এবং অনুভবের আনন্দ-নিরানন্দ প্রকাশ বাসনা আজ খাতা-কলমের সংযোগ ঘটিয়েছে।

‘সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে’ একগুচ্ছ কবিতার সংকলন। শার্ল বদলেয়ার ধারায় চলতি শতকের সিকি ভাগে এসে তারুণ্য ঝলমলে কবি রশিদ হারুন অগণিত পাঠককে কবিতায় নিমগ্ন করার জাদুকর হয়ে নাজিল হয়েছেন কাব্যগ্রন্থটিতে। ‘এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণ তূর্য’। সুন্দরকে ছুঁই ছুঁই ছুঁই, কিন্তু ছোঁয়া যায় না! প্রাণে মরি মরি মরি, কিন্তু মৃত্যু নেই! বেঁচে থাকার বীভৎস যুদ্ধ, কিন্তু অনিবার্য মৃত্যু। একদিকে পরাবাস্তবতার অদ্ভুত জাদু বাস্তবতা; অন্যদিকে কবিতার শত বছরের গদবাঁধা আইন-কানুন-কাঠামো, তথাকথিত আঙ্গিক ভেঙে উত্তরাধুনিকতার মশাল হাতে ছুটে চলা কবি রশিদ হারুনের বহুমাত্রিক বিপ্লব-বিদ্রোহের প্রস্তুতি পর্বের নিষ্পত্তির রূপক আছে তাঁর বইয়ের অনেক কাব্যে।

কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা একটির সঙ্গে অন্যটি প্রতিযোগিতা করছে অবিরাম। ভাষার গতিশীলতার সঙ্গেও একরকম প্রতিযোগিতায় নামতে হয়েছে। কবিতার ভাষা কেমন করে বদলে যায়, তা বুঝতে এ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতা সমর্থন জোগায়। সেসব আমরা কম-বেশি জানি। গত তিন দশকের কবিতা প্রতিদিন যত পড়ছি, তত মনে হচ্ছে কবিতায় অদ্ভুত এক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে কাটছে কাল।

> আরও পড়ুন- বেলাল চৌধুরীর কবিতার বিষয়বৈচিত্র্য

ভাষার আপেক্ষিকতা ও অনির্ণেয় ভবিতব্য রচনামুহূর্তে যদি কবির সামনে এসে দাঁড়ায় সময় এবং চেতন-অবচেতনের মধ্যে কাটতে থাকে সময় ও স্পেস; তবে সেই কবিতা কেন সৃষ্টি হবে না। যা সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় বহুদূর টিকে থাকতে পারে! প্রতিটি কবিতাই তার ইতিহাসের ধারাবাহিকতার মধ্য থেকে লেখা; কিন্তু কবি তার সময়ে যেখানে এসে পৌঁছেছেন, অন্তত সেই জায়গা থেকেই তাকে লিখতে হবে। অবশ্য তা কোথায় পৌঁছবে তা নির্ধারণ করবে সমসাময়িক কাল। গ্রন্থালোচনা থেকেও জানা সম্ভব কখনো-কখনো।

তবে কথা একটু থেকেই যায়; এ কাব্যগ্রন্থের ভবিষ্যতও মন্তব্যের জালে বন্দি করা অনুচিতই শ্রেয় ঠেকলো। তবে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের অনুভূতি এবং পূর্বাপর নিয়ে আঁকা ‘যাদুকর’ কবিতাটি শুধু ইতিহাসের দলিলই নয়; কবিতায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ঘটনা প্রবাহের অনন্য চিত্রকল্পও। ‘বাবার শেষ চিঠি’ কবিতা ঘিরে নিমজ্জিত হতে হয় কঠিন বাস্তবতার গভীর হিমকূপে।

‘মানুষটার ক্রসফায়ার হয়েছে’ কবিতায় ধারণ করা হয়েছে সমসাময়িক ঘটমান রূঢ়, কদর্য, সভ্যতাবিরোধী ও হতবিহ্বল নিষ্ঠুরতার মেদহীন রূপকের স্পষ্ট প্রতিবাদ। আবার ‘একটি গুমের গল্প’ বা ‘একটি বেওয়ারিশ লাশের অপেক্ষায়’ দেখি রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর অনেক কবিতার গভীরতম সংস্করণ। ‘আজ ঈশ্বরের নামেই মামলা করে দিবো’ কবিতা বলে দেয়- বিদ্রোহী নজরুল বেঁচে আছেন। আগেই বলেছি, সুরিয়ালিজমের অন্য জাতের এক রূপকার কবি রশীদ হারুন। ‘কবি আর প্রেমিক’ ছাড়াও অনেক কবিতায় এ আখ্যার প্রমাণ মেলে।

> আরও পড়ুন- হুমায়ূন ভক্তি-বিরক্তি ও বন্দনা

বইয়ের মলাট, কাগজ, ছাপা, বাঁধাই নিয়ে ইদানিং সমালোচক-আলোচকদের আর লিখতে দেখা যায় না। তবে ‘সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে’র প্রচ্ছদ কথা বলে।

আবার কবিতায় ফিরি। মানে কবিতা যেখানে এসে পৌঁছেছে, সেখান থেকে লিখলে, সমালোচনার ভাষাও তো বদলে যেতে পারে, অন্তত পরিবর্তনের প্রভাবটুকু পড়তে পারে। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতারও উপযুক্ত বিশ্লেষণ কারও পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠেনি আজও। তবে এ ক্ষেত্রে বুদ্ধদেব বসু স্মরণীয় হতে পারেন, তবে তা কেবল কবিকে চিনিয়ে দেবার জন্য; কেননা, জীবনানন্দ সম্পর্কে তিনি যে-আলোচনা হাজির করেছেন, তা উদ্ধৃতিপীড়িত ও বিশেষণনির্ভর। উল্লেখ বাহুল্য নয়, আজও সেই ধারাটি চলছে। এক্ষেত্রে আত্মতৃপ্তি ও সান্ত্বনা হয়ত আছে। আত্মতৃপ্তিটি জীবনানন্দ বাংলা ভাষার কবি বলে আর সান্ত্বনা তাঁর কবিতা এতই আপেক্ষিক ও অনির্ণেয় সমগ্রতা ধারণ করে আছে যে, এর বিশ্লেষণ আজও দুঃসাহসের বিষয়, কঠিন এবং কখনো-কখনো প্রায়-অসম্ভব। তার মানে কবিতারও তর্জমাকারী লাগে। রশীদ হারুনের কবিতার প্রয়োজন উপযুক্ত বিশ্লেষণ।

ছন্দ এখনো কবিতার আলোচনার বড় একটি জায়গা দখল করে আছে। কোন শব্দটি বিদেশি বা তৎসম সেই প্রসঙ্গও গুরুত্ব পাচ্ছে; কবিতার উপমা, রূপক, অন্ত্যমিল, অনুপ্রাস ইত্যাকার অনুষঙ্গ বিশ্লেষণ চলছে অন্তত একশ’ বছর ধরে। চিত্রকল্প নিয়ে আলোচকদের আলোচনার বয়স দু’আড়াই দশক হবে। ‘সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাসমূহের ব্যাখ্যায় চিত্রকল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হয়েই আছে। আর উপমা, চমক, রূপকের জাদু এর অনেক কবিতাকে করে তুলেছে ইদানিংয়ের সংজ্ঞায় সুরিয়ালিজমের উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ছন্দ, অলঙ্কার কবিতার প্রাথমিক শর্ত হলে কবি রশীদ হারুন দীর্ঘ মেয়াদে আলোচনা-সমালোচনা এমনকি তর্ক-বিতর্ক এবং শেষ পর্যন্ত ঝগড়া-ঝাটির কারণও হতে পারেন।

> আরও পড়ুন- রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু ভাবনা : দ্বান্দ্বিক প্রেক্ষাপট

যে কোন ভালো কবিতা প্রচলিত এত সব শর্তকে আড়াল করতে পারে; না-পারলে সে কবিতা কবিতা হয়ে ওঠে না। আবার শর্ত মেনে কবিতা হয় না। নির্ধারিত আঙ্গিকের বাইরে গিয়ে এগোনো যায় না, ছিটকে পড়তে হয়। এ এক অদ্ভুত বৃত্তে ঘুরপাক খায় কবিতা! চিত্রকল্প, অলঙ্কার, ছন্দ এসবের চমৎকারিত্ব দেখানোর মধ্য দিয়ে কবিতার উৎকর্ষের পক্ষে যত সাফাই উত্থাপন হোক, কবিতার সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত টিকে থাকার সংগ্রাম; সমকালোত্তর হয়ে ওঠা তার অভিপ্রায়; নানা তত্ত্ব, সংজ্ঞা ও বিভিন্ন উপাদানের উপস্থিতির ছক বা দাসত্ব থেকে মুক্তি সে চায়। দেখা যায়, কিছু কবিতা সেই লক্ষ্য পূরণ করে বা সেই চেষ্টা ওই কবিতাগুলোর প্রতিটি পাঠে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে তার ব্যাখ্যায় প্রচলিত ছকের উপাদানগুলো আর কাজে আসে না।

সে যা-ই হোক, ‘সময় ভেসে যায় বৃষ্টির জলে’ সুপাঠ্য কাব্যগ্রন্থ। পাঠে মনটা শান্ত হয় কি-না প্রশ্নের জবাব-হ্যাঁ।

এসইউ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।