ভালোবাসার দিনের কবি মহাদেব সাহা
সেই কবে আমার মনে ভালোবাসা জন্মেছিলো জানি না। ভালোবাসা তো বলে কয়ে আসে না। তবে ভালোবাসার কবিতা এসেছে আমার শৈশবে। ভালোবাসার কবিতা আমাকে মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে ছায়াময় একটি মায়াবী আকাশের মতো। সে আকাশজুড়ে আছে অনেক প্রিয় কবিতা, অনেক প্রিয় কবি।
আমার ভালোবাসার কবিতার আকাশটার অনেকটা জুড়ে আছেন কবি মহাদেব সাহা। ভালোবাসার সকাল বিকেল, রোদ বৃষ্টি, আঁধার আলো আর জ্যোৎস্নাময় রাতে তার কবিতা সুর তোলে নিরবধি। ঢাকার ব্যস্ত জনপদে মাধবীকে নিয়ে লেখা সেই কবিতার লাইনে খুঁজে পেয়েছিলাম প্রথম প্রেমকে:
‘ঢাকার আকাশ আজ মেঘাচ্ছন্ন, মাধবী এখন তুমি বাইরে যেও না
এই করুন বৃষ্টিতে তুমি ভিজে গেলে বড়ো ম্লান হয়ে যাবে তোমার শরীর
এই বৃষ্টিতে ঝরে যদি কারো হৃদয়ের আকুল কান্না, শোকের তুষার
গলে গলে যাবে এই বৃষ্টির হিমে তোমার কোমল দেহের আদল
মাধবী বৃষ্টিতে তুমি বাইরে যেও না। মাধবী তুষারপাতে বাইরে যেও না।’
(শহরে, এই বৃষ্টিতে)
মতিঝিল, মহাখালী, সায়েন্স ল্যাবরেটরি, সোবহানবাগ আর ধানমন্ডির অলিতে গলিতে আমার ভালোবাসার পাত্রী মাধবীকে খুঁজেছি বুকের গভীর জলের ধারায়। সেই থেকে সেই জলমান প্রকৃতির মাঝামাঝি, সেই থেকে সেই এক হাহাকারে ছুঁতে পারিনি মাধবীকে।
> আরও পড়ুন- সন্ধ্যা নামার আগে : জীবনের চমৎকার উপস্থাপন
ভালোবাসা আসবে আসবে করে দিন কেটেছে। ভালোবাসার মানবী আসেনি। সে আসেনি বলে মহাদেব সাহার কবিতা উচ্চারণ করেছে কঠিন সে সত্য:
‘শুধু তুমি আসবে না বলে একটি জীবন অসমাপ্ত
একটি জন্ম মিথ্যা হলো
সাঁকোর উপর উঠে দাঁড়িয়েছিলাম, ফিরে এসেছি।’
(তুমি আসবে না বলে)
কতবার গভীর রাতে স্বপ্নমানবের মতো আবৃত্তি করেছি তার কবিতা। বলেছি: মানব তোমার কাছে যেতে চাই। ভালোবাসা না পাবার অভিমান থাকে। এ অভিমান একদিন মানুষকে পরস্পরের কাছে এনে দেবে, এ কথা বিশ্বাস করেছি তার কবিতার পঙক্তির মতোন। কবির ভালোবাসার মানুষের উপমা কেবল মনোমুগ্ধময়ই নয়, সেসব মর্মমূল ছুঁয়ে যাওয়া শব্দ:
‘তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো
এখানে যে ফুটে আছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোলাপ,
তোমার দুহাত মেলে দেখিনি কখনো
এখানে যে লেখা আছে হৃদয়ের গাঢ় পঙক্তিগুলি।’
(তোমার দুইটি হাতে পৃথিবীর মৌলিক কবিতা)
প্রেমের স্বপ্নময় মানুষ জন্ম দেয় কবিতার। প্রেমের কবিতার প্রতিটি অক্ষরকে তিনি তুলনা করেছেন দীর্ঘ শালবন, অথই শ্রাবণ, বর্ষার নদী, বনভূমি, ঝর্ণা ও পাহাড়ের সাথে। তাকে তিনি নিয়ে গিয়েছেন একটি স্বপ্নের প্রিয় নদীর কাছে। তার সাক্ষী তার প্রতিটি প্রেমের কবিতা:
‘যে কবিতার প্রতিটি অক্ষর তোমার কাছে ঋণী
তুমি তার দীর্ঘ শালবন, দিয়েছো গভীর স্নিগ্ধ ছায়া,
তুমি তার অথৈ শ্রাবণ
মেঘে মেঘে দিয়েছো সজল অভ্যর্থনা;’
(সে তোমার অপার করুণা)
> আরও পড়ুন- মোস্তফা কামালের ‘অগ্নিপুরুষ’ : ইতিহাসের শৈল্পিক বয়ান
আমাদের অনেকেই বায়বীয় ভালোবাসায় ভেসেছি সকাল সন্ধ্যা। ভালোবাসার মানুষকে লিখতে চেয়েছি দীর্ঘ চিঠি। সে চিঠি লেখা হয়নি কখনও। গভীর রাতে হালকা আলোয় সেসব কথা পড়েছি তার অনিবার্য প্রেমের কবিতায়:
‘তোমাকে লিখব বলে একখানি চিঠি
কতবার দ্বারস্থ হয়েছি আমি
গীতিকবিতার,
... তোমাকে লিখবো বলে জীবনের গূঢ়তম চিঠি
হাজার বছর দেখো কেমন রেখেছি খুলে বুক।’
(তোমাকে লিখবো বলে একখানা চিঠি)
তারুণ্যের সরলতায় কতবার হতে চেয়েছি প্রেমিকার ছাদের ফুলের চারা, কিংবা চারাগাছ। ঈর্ষা করেছি তোমার কাঁধে ঝোলা ব্যাগটাকে। কতবার কবিতার শব্দ খুঁজেছি, খুঁজেছি উপমা। বারবার ফিরে এসেছি এসব কবিতার কাছে।
‘তোমার প্রণয় থেকে আমি কলম্বাসের মতন আবিষ্কার করি
কবিতার নতুন অঞ্চল।’
(কবিতার স্বর্ণখনি তুমি)
আমাদের ভালোবাসার আকাশ বিষাদে ভরে, সে আকাশে মেঘ জমে, ঝরঝর করে বৃষ্টি নামে। সে আকাশেই আবার চাঁদ ওঠে, জ্যোৎস্নায় আলোকিত হয় রাতের অন্ধকারে। সেসব ভালোবাসার আকাশের কথা খুঁজে ফিরি বিশুদ্ধ কবিতায়।
‘শেষে তুমি আর তোমার কাছেই দেখো ফিরে
এসেছে কবিতা,
কবিতা হবে না তুমি ছাড়া
এখন সবাই তাই তোমার কাছেই নতজানু
তোমার কাছেই হাত পাতে, তোমার কাছেই চায়
একটু করুণা;’
(বিশুদ্ধ কবিতা)
> আরও পড়ুন- আমার কবিতার খাতা : গভীরতম উপলব্ধি
আজকের ভালোবাসার দিনে সব প্রেমিক মানুষের বিশুদ্ধ কবিতার কবি মহাদেব সাহাকে অনেক ভালোবাসা। আমাদের ভালোবাসায় দীর্ঘজীবী হোন তিনি।
এসইউ/জেআইএম