বাবার মুক্তিযুদ্ধ

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৩:১৫ পিএম, ১৬ ডিসেম্বর ২০১৮

সাদিকুল নিয়োগী পন্নী

রাতে খাবার শেষ করে বাবা খাটে বসে আয়েশ করে পান খাচ্ছেন। পাশে আমি ও ছোট বোন মনিষা বসে আছি। বাবার মন ভালো। মনিষা বাবাকে গল্প বলতে বললেন। বাবার মন ভালো থাকলে প্রায়ই গল্প বলেন। তার অধিকাংশ গল্পই মাছ ধরা নিয়ে। মাঝে মাঝে তিনি মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিও শুনান। বাবা বললেন, আজ তোমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা কাহিনি বলবো। আমি ও মনিষা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললাম, শুরু করো তাহলে।

বাবা শুরু করলেন, মাঠ ভর্তি সোনার ফসল। পাকা ধান নষ্ট হয়ে ঝরে পড়ছে। পাক হানাদার এবং তাদের দোসরদের ভয়ে কেউ মাঠে আসছেন না। বেশির ভাগ ক্ষেতের ফসল রাজাকাররা ইচ্ছামতো নিজেদের গোলায় তুলছে।

মনিষা বলল : বাবা কেউ তাদের বাধা দেয়নি?

মাঝে মধ্যে দুই একজন ফসলের টানে মাঠে এসে ধান ও প্রাণ দুটোই হারিয়েছেন। অনেক কৃষক দূর থেকে দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য দেখে চোখের পানি ফেলেছেন।

আমি বললাম : তুমিও এই দৃশ্য দেখেছো।

হ্যাঁ দেখেছি। একটা যুদ্ধের ঘটনাও আছে পাকা ধানের মাঠে।

আমরা দুই ভাইবোন একটু নড়েচড়ে বসলাম। একটা উত্তেজনা বিরাজ করছে আমাদের মাঝে।

বাবা বললেন, তখন অগ্রাহায়ণ মাস। তারিখটা ঠিক মনে নেই। ভারতীয় একজন ক্যাপ্টেন ১৮জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে রওনা হলেন পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর একটা ক্যাম্প রেকি করতে। আমিও ছিলাম সেই দলে।

মনিষা জানতে চাইলো রেকি কী বাবা?

যুদ্ধের সময় রেকি বলতে বুঝাতো আক্রমণে যাওয়ার আগে শত্রুপক্ষের অবস্থানসহ সবকিছু দেখে আসা। এতে করে যুদ্ধটা হাতের নাগালে থাকে। সহজেই শত্রুপক্ষকে কাবু করা যায়। তবে রেকি করা ছিল অনেক বিপজ্জনক। অনেক যোদ্ধা রেকি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছেন। প্রাণও দিয়েছেন অনেকেই।

আমি বললাম : তারপরের কাহিনি বল।

বাবা বললেন : আমরা নিজ নিজ অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে প্রস্তুত হলাম। ক্যাপ্টেন সাহেব তার কাছে থাকা ম্যাপটা ভালোভাবে আরেকবার দেখে নিলেন। আমরা ১৮জন যোদ্ধা রওনা দিলাম ক্যাপ্টেন সাহেবের পিছু পিছু। আমার পিঠে ছিল একটা সেল্ফ অটোমেটেড রাইফেল (এসএলওআর) আর কোমড়ে বাঁধা গুলির বেল্ট। প্রায় তিন কিলোমিটার হাঁটার পর ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের নিয়ে পৌঁছালেন পাক বাহিনীদের একটা পরিত্যাক্ত ক্যাম্পে। এখানে এক সপ্তাহ আগেও পাকিস্তানিদের অবস্থান ছিল।

মনিষা বললো : পাকিস্তানিরা এখান থেকে গেলো কেন?

বাবা বললেন, মুক্তিবাহিনী এই ক্যাম্পে একাধিকবার গেরিলা হামলা করেছেন। পাকিস্তানিরা তেমন কোনও প্রতিরোধ করতে না পেরে কোনোক্রমে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে দূরের একটি ক্যাম্পে গিয়ে অবস্থান নিয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের এই বিজয়ের কথা শুনে আমরা দুই ভাইবোন আরও বেশি আগ্রহ নিয়ে কাহিনি শুনতে থাকলাম।

বাবা বললেন, ক্যাপ্টেন সাহেব খুব সতর্কতার সঙ্গে আমাদের নিয়ে ওই পরিত্যক্ত ক্যাম্পটি পরিদর্শন করলেন। এখান থেকে আমরা পাকিস্তানিদের নতুন ক্যাম্প সম্পর্কেও কিছুটা ধারণা পেলাম। তারপর ক্যাপ্টেন সাহেব সেখান থেকে আমাদের নিয়ে দক্ষিণ দিকে রওনা হলেন। প্রায় দুই কিলোমিটার হাঁটার পর আমরা একটা খোলা মাঠের কাছে পৌঁছালাম। মাঠভর্তি পাকা ধান। কয়েকটি ক্ষেতে চার-পাঁচজন ধান কাটছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ক্যাপ্টেন সাহেব ইশারা দিয়ে দেখালেন পাকিস্তানিদের ক্যাম্প। তারপর তিনি হিন্দি ভাষায় কিছু নির্দেশনা দিলেন। অনেকদিন ভারতীয়দের সঙ্গে থাকায় আমরা হিন্দি কিছুটা বুঝতাম।

ক্যাপ্টেন সাহেবের কথার অর্থ হলো- সবাই তোমরা ধান ক্ষেতে ছড়িয়ে পড়। ভয় পাওয়ার কিছু নেই। দূর থেকে কেউ দেখলে ভাববে আমরা ধান কাটতে এসেছি। আমি তোমাদের বাঁশি বাজিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে নির্দেশ দেব। ক্যাপ্টেন সাহেবসহ আমরা সবাই ধানক্ষেতে প্রবেশ করে এদিক-ওদিক হাঁটছি। আমরা হাঁটার ছলে দেখে নিলাম ধানক্ষেতের ঠিক পূর্ব দিকে একটা পাহাড়ের ওপরে পাকিস্তানিদের ছোটখাটো একটা ক্যাম্প। আমাদের অবস্থান থেকে ক্যাম্পটার দূরত্ব হবে দুই আড়াইশ মিটার। পাকিস্তানি সেনা ও রাজাকাররা তখন দুপুরের খাবারের জন্য থালা-বাটি নিয়ে ছুটোছুটি করছিল। সেই দৃশ্যও আমাদের চোখে পড়ল। হঠাৎ শুনতে পেলাম ক্যাম্পে টানা বাঁশি বাজানোর শব্দ। পাকসেনা ও রাজাকাররা থালা-বাটি ফেলে দৌড়াদৌড়ি শরু করছে। দুই এক মিনিটের মধ্যেই তারা নিজ নিজ অস্ত্র নিয়ে বাঙ্কারে প্রবেশ করে ধানের মাঠকে লক্ষ করে শতশত রাউন্ড গুলি নিক্ষেপ শুরু করলো।

আমার ও মনিষার গাঁ শিউরে উঠলো। কাঁপা কাঁপা গলায় আমি বললাম- তারপর তোমরা কী করলে?

বাবা বললেন, সঙ্গে সঙ্গে ক্যাপ্টেন সাহেব ইশারায় আমাদের স্লিপিং পজিশনে যেতে বললেন। আমরা সবাই স্লিপিং পজিশনে আছি। আমাদের ওপর দিয়ে বৃষ্টির মতো গুলি যাচ্ছে।

মনিষা বললো : তোমাদের তো কেউ দেখেনি। তাহলে ওরা টের পেল কীভাবে?

ধানকাটা অবস্থায় আমরা ক্ষেতে যে কয়জন দেখেছিলাম তারা সম্ভবত রাজাকার ছিল। প্রথমে আমরা এই বিষয়টি বুঝতে পারিনি। তারাই ক্যাম্পে গিয়ে এই খবর পৌঁছে দিয়েছে।

আমি বললাম : তোমাদের যখন গুলি করছে তোমরা তখন পাল্টা আক্রমণ শুরু করো নি কেন?

বাবা বললেন, আমরা পাল্টা আক্রমণ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ক্যাপ্টেন সাহেব মানা করলেন। তিনি বেশ অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে আমাদের ঠান্ডা মাথায় চুপচাপ আগের পজিশনে থাকার নির্দেশ দিলেন।

মনিষা ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো, তারপর।

বাবা বললেন, একটু পর পাকিস্তানি সেনারা টু-ইঞ্চি মর্টার দিয়ে গোলা বর্ষণ শুরু করলো। মর্টারের গোলা আমাদের অবস্থান থেকে প্রায় দুই তিনশ' মিটার পশ্চিমে গিয়ে পড়ছে। তখন ক্যাপ্টেন সাহেব আস্তে বাঁশি বাজিয়ে আমাদের নির্দেশ দিলেন উত্তর দিকে ক্রোলিং করতে। প্রায় বিশ পঁচিশ মিনিট ক্রোলিং করে আমরা একটা শুকনো খালে এসে পৌঁছালাম। সেখান থেকে দেখতে পেলাম ধানক্ষেতে যেখানে আমাদের অবস্থান ছিল তার আশপাশে গুলি পড়ছে। সেখানে আমরা থাকলে হয়তো সবার প্রাণ যেত। কারণ, যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো আমাদের কাছে তেমন ভারী কোনও অস্ত্র ও গোলাবারুদও ছিল না। এভাবে প্রায় ঘণ্টাখানেক বৃষ্টির মতো গুলি আর গোলা নিক্ষেপের পর পাকিস্তানিরা থামলো। আমরা পাল্টা আক্রমণ না করায় পাকিস্তানিরা ধরে নিয়েছে মুক্তিবাহিনী আসার তথ্যটা সঠিক ছিল না। তারা সবাই অস্ত্র রেখে কিছুক্ষণের মধ্যে আবার খাবারের প্লেট নিয়ে ছুটোছুটি শুরু করলো। অনেকেই লাইন ধরে খাবারও নিচ্ছে। আমরা খালে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য দেখছি। ঠিক সেই মুহূর্তে আমাদের এক সহযোদ্ধা খালের পাড়ের একটি গাছের আড়ালে দাঁড়ালেন। তিনি ক্যাপ্টেন সাহেবের অনুমতি নিয়ে একটা ম্যাগজিন এলএমজিতে লাগিয়ে ক্যাম্পে খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা পাক সেনা ও রাজাকারদের লক্ষ করে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন। ম্যাগজিন শেষ হতেই আরেকটা ম্যাগজিন লাগিয়ে আবার ব্রাশ ফায়ার। আমরাও পজিশন নিয়ে নিজ নিজ অস্ত্র দিয়ে ক্যাম্প লক্ষ করে গুলি শুরু করলাম। এভাবে কয়েক মিনিট চলার পর ক্যাপ্টেন সাহেব আমাদের নির্দেশ দিলেন আমাদের ক্যাম্পে ফিরে যাওয়ার জন্য। আমরা ক্যাপ্টেন সাহেবের পিছু পিছু নিজেদের ক্যাম্পের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। তখন আবার শুরু হলো পাক হানাদের তাণ্ডব। গুলি আর মর্টারের গোলায় চারদিক প্রকম্পিত হচ্ছে তখন। ক্যাপ্টেন সাহেব ভিন্ন পথ দিয়ে আমাদের ক্যাম্পে নিয়ে আসলেন। তার বুুদ্ধিমত্তার জন্য আমরা ১৮জন যোদ্ধাই নিরাপদে পৗঁছালাম।

আমি জানতে চাইলাম তোমাদের আক্রমণে ওদের কিছু হয়নি?

বাবা উত্তর দিলেন, পরদিন খবর পেলাম ওদের প্রচুর গোলাবারুদ নষ্ট হয়েছে। তাছাড়া এলএমজি’র ব্রাশ ফায়ারে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সৈন্য এবং রাজাকার আহত ও নিহত হয়।

জেডএ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।