ছবি আঁকায় কচির অসাধারণ পারদর্শিতা
৬০ সালের মাঝামাঝি থেকে ৮০ সালের প্রথম দিকে ঢাকার মধ্যবিত্ত পরিবারের একটি ছেলের চোখে কেমন ছিল দেশটি? পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হয়ে একটা নতুন দেশের জন্ম হলো সেই ছেলের চোখের সামনে। তার দৃষ্টিভঙ্গিতে কী কী ধরা পড়েছিল? স্কুলে স্যারদের কানমলা, বন্ধুদের সঙ্গে ছোট্ট ছোট্ট দুষ্টুমি, নিউ মার্কেটে ঘুরে বেড়ানো, অবাক বিস্ময়ে চোখের সামনে মুক্তিযুদ্ধ দেখা এবং তার সবই একটি মধ্যবিত্ত, সাধারণ পরিবারের সন্তান হিসেবে। এসব নিয়েই আমেরিকা প্রবাসী আজাদুল হকের ধারাবাহিক লেখা– আমার শৈশব– আমার কৈশোর...
গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুলের গল্প, টিলো এক্সপ্রেস, সাতচারা খেলা, টেনিস বল দিয়ে বোম্বাসটিক খেলা, জীবনের প্রথম বান্ধবীর সঙ্গে পরিচয়, প্রথম সিনেমা দেখা, গ্রামের গল্প, পাটখড়ি দিয়ে সিগারেট খাওয়ার গল্প, জ্বিনের কোলে বসার গল্প, এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার গল্প আর মুক্তিযুদ্ধের গল্প– এ রকম নানা ধরনের ছোট ছোট পর্ব নিয়েই আজাদুল হকের ধারাবাহিক প্রকাশিত হচ্ছে প্রতি শনিবার। খুবই সাদামাটা গল্প অথচ প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা এবং সহজপাঠ্য। পড়তে পড়তেই শেষ। একটি পর্ব পড়লেই মনে হবে পরের পর্বে কী হবে? এভাবে তার সঙ্গে আপনারাও ফিরে যেতে পারবেন সেই শৈশবে।
আজাদুল হক টেক্সাসের হিউস্টন শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি একজন তড়িৎ প্রকৌশলী, আমেরিকার ৩য় বৃহত্তম এনার্জি কোম্পানির একটি আইটি ডিপার্টমেন্ট পরিচালনা করেন। তিনি আগে কাজ করেছেন নাসাতে। তবে এসব টেকনোলজি নিয়ে কাজ করলেও তার মন পড়ে থাকে সাহিত্যে, কবিতায়, লেখালেখিতে। এ ছাড়া শখ হিসেবে তিনি গ্রাফিক্স ডিজাইন করেন, থ্রি-ডি অ্যানিমেশন করেন, ডকুমেন্টরি নির্মাণ করেন, ছবি তোলেন।
পর্ব- ৯.
আমাদের স্কুলে প্রতিদিন টিফিন দেওয়া হতো। বেশির ভাগ সময় দেওয়া হতো কলা, সিঙ্গাড়া। এছাড়া লুচি-বুন্দিয়া, লুচি-ভাজি, লুচি-মিষ্টি, ডিম-কলা দেওয়া হতো। ক্লাস ক্যাপ্টেনরা ব্ল্যাক বোর্ডের এক কোণায় লিখে রাখতো আমাদের মোট ছাত্র কত, আজ কতজন উপস্থিত এবং কতজন অনুপস্থিত। এরপর সকালের একটা ক্লাসে দফতরি ভাই এসে সেই সংখ্যাগুলো লিখে নিয়ে যেতেন। আমাদের টিফিন বানানো হতো স্কুলের মসজিদ রুমের সামনে একটা আলাদা টিফিন রুমে। ছোট্ট একটা রান্নাঘরের মধ্যে এই লুচি, সিঙ্গাড়া বানানো হতো। এরপর ক্লাস ক্যাপ্টেনরা গিয়ে অ্যালুমিনিয়ামের সসপেনে করে সেই টিফিন নিয়ে এসে ক্লাসে স্যারের পাশে রাখতেন। যখন ক্লাস শেষ হয়ে টিফিন পিরিয়ড শুরু হতো; তখন আমরা সবাই লাইন দিয়ে সসপেন থেকে নিয়ে আসতাম আমাদের টিফিন।
সবচেয়ে মজা হতো আমের মৌসুমে। আমরা তখন বারান্দায় পা ঝুলিয়ে বসতাম আর আমাদের আম খেতে দেওয়া হতো। আমরা আমগুলোকে টিপে টিপে নরম করে আমের তলার দিকটায় ফুটো করে প্রথমে চোঁ-চোঁ করে খেয়ে নিতাম। স্থানীয়ভাবে এইভাবে খাওয়াকে বলত ‘শিঙ্গা’ দিয়ে খাওয়া। কারণ যখন শিঙ্গাতে ফুঁ দেবার মতো করে খেতে হতো। তারপর শুরু হতো আমের রস বনাম হাতের যুদ্ধ। আমের খোসা খুলে তার আঁটি খেতে গিয়ে আমের রস দিয়ে হাত-মুখের বারোটা বাজিয়ে তারপর আমাদের টিফিন শেষ হতো। এতোদিন পর মাথায় ঢুকলো যে, আম খাওয়ার সময় আমাদের বারান্দায় বসানো হতো কেন। যদি ডেস্কে বসে খেতাম, তাহলে আর ক্লাস করা হতো না আমাদের! আমের রসে একাকার হয়ে যেতো সবকিছু।
আম খাওয়ার সময় বারান্দায় বসা থেকে আরেকটি স্মৃতি মনে পড়লো। আরো একসময় আমরা বারান্দায় বসতাম, তাহলো ড্রইং ক্লাসে মাঝে মাঝে ছবি আঁকার সময়। আমরা বসে বসে চারিদিকে তাকিয়ে সেই দৃশ্য আঁকতাম। ইস, তার একেকটার যা চেহারা হতো; তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। মাঝে মাঝে তো স্যার ডেকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘কিরে, তুই এইটা কী আঁকলি?’ তখন বুঝিয়ে বলতে হতো আমার মাস্টার পিসের অর্থ। স্যার অসহায় হয়ে মাথা নাড়তেন, তার অর্থ হলো- ‘হায়রে গবেট, তোকে দিয়ে কিচ্ছু হবে না।’ পাবলো পিকাসো মাথামুণ্ডুহীন কিছু আঁকলেও তার কতো দাম, আমি আঁকলেই যতো সমস্যা!
এই যেমন একটা উদাহরণ দেই, যা আমার মতো সাধারণ মানুষ যারা আছেন; তারা বুঝবেন। স্যার একদিন বললেন, আমাদের স্কুলের পাশের কৃষ্ণচূড়া গাছের ছবি আঁকতে। খুব ভালো, গাছই তো, সে আর এমন কী কঠিন। কিন্তু আঁকতে গিয়ে দেখি, এ কী? এতোগুলো গাছের পাতা আঁকবো কী করে? আমি তো একটা একটা করে পাতা একেই চলেছি, কিন্তু আমার ছবি তো আর শেষ হয় না! কিন্তু আমাদের কচি? সে খসখস করে কয়েকটা দাগ দিয়ে পুরো গাছটাই একে ফেললো কয়েক মিনিটের মধ্যে, তা-ও আবার পাতাসহ! আমি একদম বোকা বনে গেলাম। গোল গোল করে কিভাবে যেন আঁকিবুঁকি করলো, তাতেই ওর ছবি দেখে মনে হলো- কী সুন্দর ঝাঁকড়া পাতাসহ একগাছ! শুধু কি তাই? পেন্সিলের শীষকে আড়াআড়ি করে কয়েকটা দাগ দিয়ে তারপর হাত দিয়ে ঘঁষে বানিয়ে ফেললো কী সুন্দর গাছের কাণ্ড! এই-ই হলো কচি!
একদিন স্যার বললেন, ‘তোদের একটা হাত সামনে রেখে আরেকটা হাত দিয়ে সামনে রাখা সেই হাতের ছবি আঁক।’ আমি তো কিছুতেই আঙুল আঁকতে পারছি না। একটা আঁকি তো আরেকটা হয় না। হবে কী করে? আমি তো একটা একটা করে আঙুল আঁকার প্রাণান্ত চেষ্টা করে যাচ্ছি। দেখা গেলো, আমার আঁকা বুড়ো আঙুল হয়ে গেছে মধ্যমার থেকে বড়। আচ্ছা, তো মুছলাম বুড়ো আঙুল। সাইজটা ছোট করলাম। ওমা, পরে দেখি মধ্যমা হয়ে গেছে তর্জনীর থেকে দ্বিগুণ! কী মহা মুশকিল রে বাবা! আর এদিকে কচি করলো কি? ওর বামহাতটা কাগজের ওপর রেখে একবারে পুরো হাতটার চারপাশ এঁকে ফেললো পেন্সিল দিয়ে। আর তারপর শুরু করলো তার ম্যাজিক! ওর আঁকা হাত দেখে পুরা ক্লাস হা হয়ে গিয়েছিল।
আমি কচির কাছ থেকেই প্রথম শিখেছি এই পেন্সিলের গায়ে লেখা ‘বি’ বর্ণগুলোর অর্থ। ও দেখতাম একধরনের সবুজ রঙের পেন্সিল ব্যবহার করতো, যার গায়ে লেখা থাকত ৩-বি, ৪-বি। সেগুলোর শীষ ছিল মোটা এবং নরম। ও একেক সময় একেক পেন্সিল ব্যবহার করে আমাদের তাক লাগিয়ে দিতো। আর আমরা তো সেই লোহার মতো শক্ত কাঠপেন্সিল নিয়ে ঘঁষতে ঘঁষতে কাগজের ছালপাখনা তুলে ফেলতাম। ছবি আঁকার পেন্সিল যে আবার ভিন্ন ধরনের হতে পারে, তা কচিই আমাকে প্রথম শিখিয়েছিল। সেই কচি আজ বাংলাদেশের একজন প্রথম সারির স্থপতি। ও যে চিত্রকর না হয়ে কিভাবে স্থপতি হলো, সেটাই অবাক হবার ব্যাপার। তবে ওর কাজের মাঝে এখনও রয়ে গেছে একজন আঁকিয়ের সৃজনশীলতার ছাপ। বোধহয় সেটাই ওর সার্থকতা।
চলবে-
এসইউ/জেআইএম