আপুর মেডিকেল হোস্টেল

সাহিত্য ডেস্ক
সাহিত্য ডেস্ক সাহিত্য ডেস্ক
প্রকাশিত: ০৯:৩২ এএম, ১১ অক্টোবর ২০১৭

সনম পড়ে একটি মেডিকেল কলেজে আর সানজানা ইন্টারমিডিয়েট ফার্স্ট ইয়ারে। ওরা দুই বোন। বাসা চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে।

সনম ঢাকায় হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। সানজানা- থাকে মা- বাবার সঙ্গে চট্টগ্রামে।
সনম এবার ফোর্থ ইয়ারে।
গত কয়েকদিন ধরে সানজানা এসেছে বড় আপুর হোস্টেলে। সারাক্ষণই আপু পড়াশুনা নিয়ে ব্যস্ত থাকে। সে সময় সানজানার আর কিছু করার থাকে না। বিকেলে প্রতিদিন সে বের হয়। ঘুরে আসে কোথাও । কিন্তু একা একা খুব একটা ভালো লাগে না। আজও সে বিকালে বের হয়েছিলো। বসুন্ধরা মার্কেটে দীর্ঘক্ষণ কাটিয়েছে। সময় যেন কাটতেই চায়না। বার তিনেক ফুচকা খেয়েছে।
বড় আপা ফুচকা বিষয়ে কথা উঠলেই বলেন, তোর তো জন্মই হয়েছে ফুচকা খাওয়ার জন্য। তোর নাম সানজানা না হয়ে ফুচকা বেগম রাখলেই ভালো হতো।
এ রকম কথা হাজার বলেছে সনম। তবে সানজানা এসব কথায় কান দেয় কমই। যখন সনম ফুচকা বেগম বলে তখন তার মুখটা এতই হাস্যোজ্জ্বল দেখায় যে না জানি কত হাসির কথা বলে ফেলেছে।

সানজানা বলে, “এটা কোনো হাসির কথা হলো?”
বসুন্ধরা থেকে ফিরতে প্রায় রাত ৮ টা বেজে গেল সানজানার।
হোস্টেলে ফিরে দেখে , বিদ্যুৎ নেই।
সনম বলল, “এসেছ, ফুচকা বেগম”
ঘর অন্ধকার । সনম তার পড়ার টেবিলে বসে আছে। টেবিলের উপর মানুষের মাথার খুলি। তার পাশে মানুষের কয়েকটি হাড়।

সানজানা দরজাতেই দাঁড়িয়ে আছে। “কিরে ভিতরে আয়- সনম ডাকে। ”

“ঠিক আছে, আমি বাইরে দাঁড়াই। বিদ্যুৎ আসুক। ”
সনম বলে ,, “ও বুঝেছি” । তার মানে তুই কি ভয় পেয়েছিস। আরে বোকা ওগুলো তো প্লাস্টিকের ভয় পাওয়ার কি আছে।
কথাগুলো বলে সে ন্যাকড়া দিয়ে সেগুলো মুছে সে পরিষ্কার করতে থাকে। বলে, “অনেক ময়লা হয়ে গেছে।”
পরিষ্কার করার পরই সে মাথার খুলিটা নিজের মাথায় তুলে সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে “একদিন এই লোকটাও কিন্তু আমাদের মতো বেঁচে ছিলো। ”
এর মধ্যেই বিদ্যুৎ চলে আসে। সানজানা ঘরে ঢোকে। “তুমি যে বললে এটা প্লাস্টিকের।”
“তুই যাতে ভয় না পাস সে জন্য বলেছিলাম প্লাস্টিক। এটা আসল ।এটা আসল মানুষের মাথার খুলি।”
“একসময় এই লোকটারও হয়ত তোর মত মাথা ব্যথা করত। ”
এখন সে সব ব্যথার ঊর্ধ্বে।
এ কথা বলে সনম এমনভাবে হাসতে থাকে যে, না জানি কী মজার কথা বলে ফেলেছে সে। সনমের হাসি দেখে ভয় পেয়ে যায় সানজানা। যতটুকু ভয় মানুষের মাথায় খুলি দেখে পেয়েছিল, তার যতটুকু ভয় মানুষের মাথার খুলি দেখে পেয়েছিল, তার চেয়ে বেশি ভয় বড় বোনকে দেখেই। মনে মনে বলে এমন বিষয়ে কি এভাবে হাসতে পারে।

ডোরবেল বেজে ওঠে। চমকে ওঠে সানজানা। আবার হাসি সনমের।
বলে , “দেখ তো কে এল।”
সানজানা চুপচাপ বসেই থাকে।
“কি রে, ভয় পেলি।” যা দরজা খোল।
সানজানা এগিয়ে যায় দরজার দিকে।
দরজা খোলে। দেখে পাশের রুমের তাবাসসুম। বড় আপার বান্ধবী। সানজানা বলে, “ও আপু তুমি। এসো।”
‘না ভেতরে ঢুকব না।’
তাবাসসুম পেছনের হাতটা সামনে এনে বলে, “এই নাও ধরো”।
তার হাতে একটা কঙ্কাল।
তাবাসসুম বলে, “কই ধরো”।
সানজানা তার কথা শুনে দুই হাত পেছনে নিয়ে নেয়।
এই দৃশ্য দেখে সনম আবার হেসে ওঠে। বলে, “তাবাসসুম, তুই ওটা ঘরে নিয়ে আয়। ও ধরবে না ভয় পেয়েছে”।
তাবাসসুম বলে, “ভয় পেয়েছে ঠিকই, তাতে তোর হাসির কি হলো। এত হাসছিস কেন?”
কথা সুনে সানজানা যেন একটু সাহস পায়।
তাবাসসুম বলে, “তুমি প্রায় সপ্তাহ ধরে ঢাকা এসেছ, অথচ আমার রুমে গেলে না একবারও। চলো এক্ষুণি। ঢাকা এসে মনে হয় বোর হয়ে গেছ।”

হাফ ছেড়ে বাঁচে সানজানা। তাবাসসুমের ঘরে গিয়ে বসে। তার ঘরটি বেশ সাজানো গোছানো। রুমে টেলিভিশনে হিন্দি ছবি চলছে। বড় আপুর ঘরের মত নয় ঠিক। সনমের ঘরে যেমন নানান ডাক্তারি জিনিসপত্র, তাবাসসুমের ঘরে তা নেই।
“হিন্দি ছবিটা বন্ধ করে দেব? তাবাসসুম জানতে চায়। ”
সানজানা বলে “আপনার কম্পিউটারে কি ইন্টারনেট আছে?”
হ্যা। তাহলে তাহলে তুমি নেটে বসো। আমি ছবিটা দেখি, তাবাসসুম বলে।
তখনই হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢোকে সনম। তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বলে, অ্যাই। তুই আমাকে এই সুখবরটা দিলি না কেন?
“কেন কি হয়েছে?”
“কী হয়েছে মনে হয়” আমাদের মেডিকেলে একটা লাশ আনা হয়েছে। আর সেটা তুই আমাকে বলবি না। সনম বলে।
তাবাসসুম বলে, “কাল মর্গে গিয়ে দেখে আসিস।”
“না আমার এখনই দেখতে ইচ্ছে করছে। কী মজা। আমাদের প্র্যাকটিসগুলো তাহলে এখন অনেক ভালো হবে। কী যে একটা ফালতু মেডিকেলে ভর্তি হলাম। যেখানে কোন লাশই নাই। এ কথা বলে সনম চলে যায়।”

তাবাসসুম সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে, “তুমি কি লক্ষ করেছ, সনম একটু বেশি কথা বলছে। একটু বেশি হাঁটছে। ”
হ্যা আমারও তো সেটা মনে হচ্ছে।
তাবাসসুম বলে আমাদের ব্যাচের সবচেয়ে ব্রিলিয়্যান্ট স্টুডেন্ট সে। সব টিচারের প্রিয়।
ছবিটা দেখে শেষ করে তাবাসসুম। সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে, “অনেক রাত হয়েছে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়। ”
সানজানা বলে আপু আমাকে এগিয়ে দিয়ে আসো । একা যেতে ভয় পাচ্ছি।
তাবাসসুম- সানজানা দুজনে এসে দেখে, রুম খোলা, সেখানে সনম নেই। একতলা, দোতলা কোথাও নেই। কারও রুমে নোই। গেল কোথায়!
তাবাসসুম বলে, “নিশ্চয়ই ও মর্গের দিকে গেছে।”
সত্যিই তাই। তাবাসসুম-সানজানা দুর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে সনম যেন কার সঙ্গে কথা বলছে, ঠিক মর্গের পাশে দাঁড়িয়ে। তাদের দুজনকে দেখে সনম এগিয়ে আসে। কাছাকাছি এসে বলে, “ভাবছিলাম লাশটা দেখবো। কিন্তু কেয়ারটেকার কিছুতেই মর্গের দরজা খুলল না। বড়ই আফসোস।

কথা শুনে এবার তাবাসসুম ও যেন ভয় পেয়ে যায়।
এই রকম ভয় সানজানারও ।
তাবাসসুম বলে , “তুই কিন্তু একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলছিস।”
কথা শুনে সনম বলে, “আমি আবার কি বাড়াবাড়ি করলাম। ” এত ভয় পেলে আর ডাক্তারি পড়তে এলি কেন।’
কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগে তাবাসসুমের। “মনে হয় তুই-ই যেন শুধু ডাক্তারি পড়ছিস।” এ কথা শুনে সে তার রুমের দিকে চলে যায়।

সানজানা তার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। “আপু শোনো, আপু শোনো। ”
তাবাসসুম ঘুরে দাড়ায়।
“আপু প্লিজ রাগ করো না। চলো আজ রাতটা আমরা একসঙ্গে কাটিয়ে দেই। সানজানা বলে। ”
তাই হয়। তাবাসসুম সনমের রুমে চলে আসে।
রাত, দুইটা , কিন্তু কারোও চোখে কোন ঘুম নেই। যত আত্মীয়স্বজন মারা গেছে সব মনে পড়ে সানজানার। ভয় বাড়ে । সানজানা তাবাসসুমের গলা জড়িয়ে ধরে।
“আপু। ”

আপু শব্দটার মধ্যে কতটা ভয় লুকিয়ে আছে সেটা বুঝতে পারে তাবাসসুম।
হোস্টেলের পাশে একটা কৃষ্ণচুড়াগাছ । সেটার মধ্যে একটা পাখির পাখা ঝাপটানোর শব্দ পাওয়া যায়।
কিছুক্ষণ পরেই ভেসে আসে, “ভূত- ভূতুম। ভূত- ভূতুম। ”
সনম বলে “ভূতুম পেচা পাখি দেখেছিস কখনো?”
তাবাসসুম বলে, “আমার দেখতে হবে না।”
সানজানা আবার তাবাসসুমকে জড়িয়ে ধরে।
“আশ্চর্য। ” এত ভয় পেলে কি চলে। এই পাখিটা এখন বিলুপ্তির পথে। সনম পাখি দেখতে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়ায়।
তাবাসসুম লাফিয়ে ওঠে বলে, প্লিজ, যাবি না। তোর পায়ে পড়ি।
কথা শুনে সনম হাসে।
তখনই দরজায় ক্রিং ক্রিং করে ডোরবেলটা বেজে ওঠে।
সনম বলে, কে?
ওপাশ থেকে ভেসে আসে একজন পুরুষের কন্ঠস্বর। “আমি হারান শেখ। বেওয়ারিশ লাশ হয়ে আপনার মেডিকেলে এসেছি। আপনি আমাকে দেখতে চেয়েছিলেন। ”
সনম এবার তাবাসসুমের দিকে তাকায়, “দরজা খুলব?”
‘প্লিজ সনম, প্লিজ, ‘তাবাসসুম বলে’।
সানজানা তাবাসসুমের গলা জড়িয়ে ধরে কাপছে।
কাঁপছে তাবাসসুম ও।
ভয় পেয়েছে সনমও ।
তারা একই সঙ্গে ভয়ার্ত চিৎকার করে ওঠে।
তখন কৃষ্ণচুড়াগাছে পাখি ঝাপটানোর শব্দ হয়। চিৎকার শুনে পাখিটা উড়ে যায়।
চিৎকার শুনে হোস্টেলের অনেকেই জেগে ওঠে। কেউ কেউ দৌড়ে ছুটে আসে সনমের রুমের পাশে। ছুটে আসে সিকিউরিটির লোকজন। পুরো মেডিকেল ক্যাম্পাস জেগে ওঠে যেন।
মর্গের দিক থেকে ছুটে আসে হাসান আলী। মর্গের চাবি তার কাছে থাকে।
সে দৌড়ে এসে বলে, “মর্গের নয়া লাশটা তো খুইজা পাইতাছি না। দরজা তো খোলা। ”
সিকিউরিটি প্রধান আহসান সাহেব আসেন। সব কথা শুনে বললেন “নিশ্চয়ই এ লাশ চুরি হয়েছে” ।
আহসান সাহেবের দিকে এগিয়ে যায় সনম। “লাশ চুরি হবে কেন। ওই লাশটাই তো আমাদের রুমের ডোরবেল বাজাল ”
আহসান সাহেব বলেন “যত পাগলের কারখানা। এখানে আর চাকরি করা যাবে না।”
সিকিউরিটি রুমের দিকে দৌড়ে আসেন একজন। আহসান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলেন, “স্যার আপনার বিছানায় শুয়ে আছে কেডা?”

কথা শুনে আহসান সাহেব বলেন, “হাসান আলী, দেখেন তো ওটা কে? আহসান সাহেব কাঁপতে থাকেন। এবার তিনি ভয় পেয়েছেন।
তার কাঁপুনি দেখে সনম হেসে গড়িয়ে পড়ে। বলে, ‘চল, রুমে যাই’।
সানজানা তাবাসসুম রুমের দিকে হাঁটতে থাকে। মসজিদে- মসজিদে ফযরের আজান শুরু হয়। আজান শুনে সানজানার একটু সাহস হয়। সনমের দিকে তাকিয়ে বলে, “আপু আমি আজই চিটাগং চলে যাব। ”
সনম হেসে বলে, ঠিক আছে। চল এক্ষুণি তোকে বাসে তুলে দিই।

এইচআর/পিআর

পরিষ্কার করার পরই সে মাথার খুলিটা নিজের মাথায় তুলে সানজানার দিকে তাকিয়ে বলে “একদিন এই লোকটাও কিন্তু আমাদের মতো বেঁচে ছিলো

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।