যেভাবে কাজ করছে ‘স্বর্ণ কিশোরী ক্লাব’

মোশারফ হোসাইন
মোশারফ হোসাইন মোশারফ হোসাইন , ফিচার লেখক
প্রকাশিত: ০১:৫০ পিএম, ০৮ মার্চ ২০২২

জীবনে চলার পথে কখনো দুঃখ আবার কখনো সুখ আসবে। দুঃখকে উপভোগ করতে হবে আবার সুখকেও। দুঃখ সবার জীবনে আসে না, যে সংগ্রামী, পরিশ্রমী, স্বপ্নবাজ, যে এগিয়ে যেতে চায় তার জীবনেই আসে।

যখন বিপদ আসবে; তখন সরাসরি দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে হবে ধৈর্যের সঙ্গে, শান্ত হৃদয়ে ও সুস্থ মস্তিষ্কে। এটা জীবনের পরীক্ষা ভাবতে হবে। আলাপচারিতায় এমনটিই বলছিলেন স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহী ফারজানা ব্রাউনিয়া।

jagonews24

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সামাজিক বিজ্ঞানে মাস্টার্স করে অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টরিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে মার্কেটিং বিভাগে এমবিএ শেষ করেন তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুটা বাংলাদেশ টেলিভিশনে (বিটিভি)।

পরে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে উপস্থাপক হিসেবে কাজ করেন। এখন কাজ করছেন সমাজ উন্নয়নের জন্য। কৈশোর সুস্বাস্থ্য নিয়ে বর্তমানে পিএইচডি গবেষক হিসেবে আছেন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসে।

jagonews24

ফারজানা ব্রাউনিয়া বলেন, ‘আমার চোখে নিজের স্বপ্ন পূরণের বাধা হলো চারটি। পরিবার, সমাজ, প্রেম ও সবচেয়ে কঠিন বাধা ভেতরের আমি। সেই বাধা যদি কেউ অতিক্রম করতে না পারে, তাহলে সে স্বপ্ন পূরণের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না। আমি খুব বিক্ষিপ্ত ছিলাম! আমি কী চাই, কেন চাই সেটা বুঝতে পারতাম না। আমি যখন উপস্থাপনা করি; তখন অনেক প্রশংসা পেতাম কিন্তু ভালো লাগা পেলেও আত্মতৃপ্তি খুঁজে পেতাম না।’

‘দুবাইয়ে এক বেসরকারি টিভির একটি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের মঞ্চে আমার সামনে ৪০ হাজার মানুষ ছিল, আমি ছিলাম উপস্থাপক। আমি চিৎকার দিলে সবাই চিৎকার দিচ্ছে, নিঃসন্দেহে এটি ভালো লাগার। তবে দিনশেষে আমার অপূর্ণতা থেকেই যেত, তৃপ্তি পেতাম না। আমি তখন দ্বিতীয় সন্তান নিয়ে গর্ভবতী অর্থাৎ আমি মা হতে চলেছি। পরিচিত মানুষ হিসেবে সব জায়গা থেকে আমি সব ধরনের সুবিধা পাচ্ছি। কিন্তু যারা প্রান্তিক গর্ভবতী মা, তারা কি আমার মতো সুবিধা পান?’

jagonews24

‘এ চিন্তা থেকেই টিভিতে আমি একটা অনুষ্ঠান করি ‘আমি মা হতে চলেছি’। অনুষ্ঠানটি করে আমি প্রথমবারের মতো আত্মতৃপ্তি পাই। শত বাধার পরেও আমি সফলভাবে ৪০টি পর্ব করতে সক্ষম হই, আমি নিজেও যেহেতু গর্ভবতী ছিলাম; সেহেতু অনুভূতিটা ছিল তীব্র ও সফলতার। তৃপ্তির দিক থেকেও কাজটি আমার ভালো লাগার মধ্যে জায়গা করে নিলো।’

ফারজানা ব্রাউনিয়া আরও বলেন, ‘অনুষ্ঠানটি অনেক গবেষণা করে বানিয়েছিলাম। অনুষ্ঠানের শেষ পর্বের দিকে বুঝতে পারলাম, সমস্যাটি গর্ভাবস্থায় মাকে সহযোগিতা করলেই হবে না বরং সমস্যাটি শুরু হয় একটি মেয়ে যখন বড় হয়। তার যখন প্রথম পিরিয়ড হয়। সে যখন ধীরে ধীরে কৈশোরে পদার্পণ করে ও নারীতে রূপান্তর হয়; সেই সময় তার কোনো সাপোর্ট থাকে না। সেই জায়গাতে যদি কিছু করা যায়, তাহলেই বড় কাজ হবে।’

jagonews24

‘তখনই নিরাপদ মাতৃত্ব অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ২০১২ সালে যাত্রা শুরু হয় স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্কের। পরে ২০১৪ সালে একটি ফাউন্ডেশনের নিবন্ধন করি। ২০২২ সালের ২৮ অক্টোবর ১০ বছরের পূর্ণতা পাবে শিক্ষার্থীদের এ সংস্থা।’

‘শুরুতে সবাই আমাকে বলেছে পাগল। আমি বলেছি একটা বড় স্বপ্ন নিয়ে যাত্রা শুরু করে যদি ব্যর্থ হই, সমস্যা নেই। আমাদের যেসব বাধা আসবে বলে ভেবেছিলাম, সেগুলোর কোনোটাই আসেনি। আমরা সফলভাবে একটা শীর্ষ জায়গাতে নিয়ে যেতে সক্ষম হই স্বর্ণ কিশোরীকে।’

jagonews24

আলাপচারিতায় ফারজানা ব্রাউনিয়া জানান, সারাদেশে স্বর্ণ কিশোরীর ৫ হাজার ক্লাব আছে। প্রতি ক্লাবে ৩০ জন সদস্য। করোনাকালীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কার্যক্রম চালাতে পারিনি। তবে স্বর্ণ কিশোরী ও সূর্য কিশোররা সৌহার্দ নামে একটি কার্যক্রম পরিচালনা করে, কিশোরীদের বাসায় খাদ্যসামগ্রী ও করোনা প্রতিরোধে সুরক্ষা সামগ্রী দিয়ে আসে।

৬৪টি জেলায় প্রত্যেকে এক শতাধিক পরিবারের মাঝে এ উপহারসামগ্রী পৌঁছে দেয়। স্বর্ণ কিশোরীরা ৬টি বিষয় নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে- বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ, প্রজনন স্বাস্থ্য সচেতনতা, অপুষ্টি দূরীকরণ, পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করণ, শিক্ষায় ঝরেপরা রোধ, ডিজিটাল শিক্ষার মাধ্যমে মাদকমুক্ত আধুনিক সমাজ বির্নিমাণ।

jagonews24

তিনি বলেন, ‘করোনাকালীন আমরা অনেক মানুষকে হারিয়েছি। আমি মনে করি, বেঁচে থাকাটাই অবাক প্রাপ্তি। বেঁচে থাকলে সামাজের জন্য দেশের জন্য কাজ করতে পারবো। কাজ করে যাচ্ছি, কাজ করে যেতে চাই আমরণ।’

তিনি আরও বলেন, ‘মেয়েদের পাশাপাশি ছেলেরাও আছে আমাদের সঙ্গে। ২০১৬ সালে স্বর্ণ কিশোরীতে ছেলেদের যুক্ত করার কথা ভাবলে ছেলেরা মেয়েদের নেটওয়ার্কের কথা বলে আপত্তি জানায়। পরে সূর্য কিশোর যুক্ত হয়ে ছেলে-মেয়ে উভয়ের সুবিধার্থে একটি নাম দেই, নির্ভীক।

স্বর্ণ কিশোরী ক্লাবের নতুন নাম দেই ‘নির্ভীক কৈশোর ক্লাব’। কিশোর নেতা সূর্য কিশোর অংকুর, সাইফুল, লুমিন, সাইদী, জামিল, লিমন, রাব্বি এমন আরও অনেক সফল নাম ছড়িয়ে আছে দেশজুড়ে। তাদের স্বপ্ন একটাই! কৈশোর বান্ধব বাংলাদেশ। আর শত বাধা পেরিয়ে যে কোনো মূল্যে সে স্বপ্ন আমরা সফল করবোই।’

স্বর্ণ কিশোরী নেটওয়ার্ক ফাউন্ডেশন নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? কিশোরীদের নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী? তাদের কোন অবস্থানে দেখতে চান? এসব বিষয়ের প্রশ্ন করতেই তিনি বলেন, ‘এই সোনালি কৈশোরকে জয় করার অনেক গল্প আমাদের আছে।

jagonews24

বরগুনার শারমিন, তার ঝরে পড়ার কথা ছিল, স্বর্ণ কিশোরীর নেতৃত্ব দেওয়া এই কিশোরী আমেরিকা থেকে পুরস্কার নিয়ে এসেছে। এটি একটি মেয়ের জীবনে অনেক বড় সফলতা। দীপ্তি মনামি, আনিকা, নওশিন, ঐশী, তিফলা, তোয়া, সোনালি, তাদের প্রত্যেকেরই এমন সফলতার গল্প আছে।

ডচিংনুর কথাও বলতে চাই, পাহাড়ি জনপদের এই মেয়ে স্বর্ণ কিশোরী জেলা আয়োজনে আসে। তার বাবা কিছুদিন আগে ইহলোক ত্যাগ করেন। সে চিন্তায় থাকে তার পড়াশোনা চলবে কি চলবে না, স্বর্ণ কিশোরীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে-ও এগিয়ে যায়।

এখন মেয়েটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে। আমি এখন তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছি। আমি আশা করি তাদের জায়গা থেকে তারা সহমর্মিতার সঙ্গে এ দেশের প্রতিটি কিশোর-কিশোরীকে এগিয়ে নেবে।’

জেএমএস/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।