২০০০ বছরের পুরোনো বাটিক ফ্যাশন আজও নতুন
কানিছ সুলতানা কেয়া
হাল
ফ্যাশনে বাটিক প্রিন্টের জুড়ি নেই। টিনএজদের থেকে শুরু করে বয়স্ক যারা আছেন, এমনকি ছোটদের পছন্দের তালিকায় আছে বাটিকের পোশাক। সব বয়সী এবং সব ধরনের গায়ের রঙের মানুষের জন্য মানানসই বাটিক। নানা রঙের ছড়াছড়ি আকর্ষণীয় করে তোলে এই কাপড়কে।
তবে দেশীয় ঐতিহ্য বললেও বাটিকের জন্ম ইন্দোনেশিয়ার জাভা বালিতে।
শাড়ি থেকে শুরু করে সেলোয়ার-কামিজ, স্কার্ট, ফতুয়া, শার্ট, ওড়না, হিজাব, ছেলেদের পাঞ্জাবি, ফতুয়াও বাটিকের ছোঁয়া। বাটিকের পোশাক দেখতে যেমন ফ্যাশনেবল; তেমনিই আরামদায়কও বটে। যেকোনো জায়গায় এই পোশাকে দারুণ মানিয়ে যায়।
বিশ্বজুড়ে শিল্প ও নৈপুণ্যের অনেকগুলো পদ্ধতি আছে। সেগুলো আবার বহু শতাব্দী ধরে আবিষ্কার এবং অনুশীলন করা হয়েছে। যা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আবার বিবর্তিত হয়েছে। বিশ্বায়নের যুগে নতুন নতুন সৃজনশীল শিল্পে আমরা জড়িয়ে গেলেও ঘুরে ফিরে কীভাবে যেন সেই আগের জিনিসগুলোকেই নতুনত্ব দিচ্ছি। তেমনই এক শিল্প হচ্ছে বাটিক।
মূলত কাপড়ের কিছু অংশে নকশা এঁকে তারপর নকশাটি মোম দিয়ে ঢেকে সেটা রঙে ডুবিয়ে যে পদ্ধতিতে কাপড় রং করা হয় তাকে বাটিক প্রিন্ট বলে। এক্ষেত্রে মোম লাগানো অংশে রং ঠিকমতো প্রবেশ করতে পারে না। ফলে তা অনবদ্য রূপলাভ করে। এটি দুই হাজার বছর আগে প্রথম শুরু হয় ইন্দোনেশিয়ার জাভা অঞ্চলে।
‘বাটিক’ শব্দটি জাভানিজ শব্দ ‘অম্বাটিক’ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘বিন্দু দিয়ে চিহ্নিত করা’।
বাটিক অনেক ধরনের হয়ে থাকে। আসলে অনেক ধরনের বলতে, বাটিক প্রিন্ট করার পদ্ধতিই একে ভাগ করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
রিটেন বাটিক:
হাতে বাটিকের যে নকশা করা হয় সেটিতে মোম লাগাতে ক্যান্টিং নামে এক ধরনের যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই বাটিকগুলো করতে এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত সময় লাগে। এটি একটি সঙ্গে অন্যটির কোনো মিল থাকে না। অর্থাৎ একেকটি ইউনিক পিস বলা যায়।
স্ট্যাম্পড বাটিক:
এই বাটিক তৈরি করতে ডায়েচ ব্যবহার করা হয়। একেক ডায়েচে একেক নকশা। অনেক সময় ক্যানিং ক্যাপ দিয়েও করা হয় এই বাটিক। সেক্ষেত্রে এখানে রঙ বা কালির পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় মোম।
পেইন্টিং বাটিক:
সাদা কাপড়ে ব্রাশ বা তুলি দিয়ে ডালপালা, ফুল, লতাপাতা আঁকা হয়। একে বলে পেইন্টিং বা আঁকা বাটিক। এই ক্ষেত্রে কালি এবং রঙ সরাসরি কাপড়ে ব্যবহার করা হয়। এই বাটিক যেহেতু হাতে করা হয়; তাই একেকটি একেক রকম হয়ে থাকে। এর প্রতিটি পিস হয় ইউনিক।
ঘরে যেভাবে কাপড়ে বাটিক প্রিন্ট করবেন-
এজন্য প্রথমেই কাপড়ে আপনার পছন্দমতো ফুল কিংবা লতাপাতা একে নিন। এবার একটি বাটিতে মোম গলিয়ে নিন। আরেকটি বাটিতে কিছুটা পানি চুলায় দিয়ে ফুটতে দিন। এবার এর সঙ্গে কিছুটা রক সল্ট এবং রং মেশান। নামিয়ে হালকা ঠান্ডা হতে দিন। এই ফাঁকে আপনার কাপড়ে নকশার উপর ক্যানিং দিয়ে মোম লাগিয়ে নিন।
রঙের বাটির ভেতর কাপড়টি ডুবিয়ে নিন। শুকানো পর্যন্ত অপেক্ষা করুণ। এবারে নকশা করা জায়গার উপর কাগজ দিয়ে আয়রন করে নিন। এতে মোম কাপড়ে খুব ভালোভাবে বসে যাবে। ব্যস, হয়ে গেলো আপনার পেইন্টিং বাটিক। এ ছাড়াও ডায়েচ দিয়ে আপনি কাপড়ে পছন্দমতো রঙে রাঙাতে পারেন।
বাঙালি ফ্যাশনে বাটিক
বাটিকের শাড়ি যেমন আপনি অফিসে পরে যেতে পারবেন; তেমনিই যেকোনো উৎসব-অনুষ্ঠানেও। বিশেষ করে বাটিক প্রিন্টের সিল্কের শাড়ি আপনাকে করে তুলবে সবার থেকে আলাদা। বাটিক সুতি ছাড়াও সিল্ক, গরদ, তসর, মসলিন, অ্যান্ডিকটন এমনকি খাদি কাপড়েও বাটিক প্রিন্ট করা হয়।
ফলে আরামদায়ক ও ফ্যাশনেবল পোশাক হিসেবে সবার মনে সহজেই স্থান করে নিয়েছে।
বাঙালি মেয়েরা শাড়ির পাশাপাশি প্রতিদিনের ব্যবহারে বাটিকের সালোয়ার-কামিজ পরে থাকেন।
কামিজের ক্ষেত্রে বাটিকের অনবদ্য কাজ পোশাকে এনে দেয় ঐতিহ্যের ছোঁয়া। এই কামিজ বা ফতুয়া আপনি অনায়াসে জিন্স, লেংগিস বা জেংগিসের সঙ্গে পরে ফেলতে পারেন।
সঙ্গে থাকতে পারে বাটিক প্রিন্টেরই স্কার্ফ।
বাটিক প্রিন্টের স্কার্ট বর্তমানে বেশ জনপ্রিয় সবার কাছে। এই স্কার্টের সঙ্গে বাটিক প্রিন্টের কিংবা একরঙা টপস পরতে পারেন। সঙ্গে বাটিক প্রিন্টের ওড়না ও পুতির গয়না ও হালকা সাজে আপনাকে দেখাবে অতুলনীয়।
ছেলেদের পোশাকের ক্ষেত্রেও বাটিক প্রিন্টের পাঞ্জাবি যেকোনো উৎসবে মানিয়ে যাবে। চাইলে সঙ্গীর শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং করে একই রং বা ডিজাইনের পাঞ্জাবি পড়তে পারেন। এখন এটা একটি ট্রেন্ড বলা চলে।
এ ছাড়াও বাটিক প্রিন্টের শার্ট ও ফতুয়া যেমন আরামদায়ক এবং ফ্যাশনেবল; তেমনিই আপনাকে আলাদা একটি ব্যক্তিত্ব এনে দেব। ক্যাজুয়াল বা সেমি-ক্যাজুয়াল পোশাক হিসেবে বাটিক প্রিন্টের হাওয়াই শার্ট অনেকেই বেছে নিতে পারেন।
কোথায় পাবেন?
রেডিমেট পোশাকের পাশাপাশি বাটিকের কাপড় গজ হিসেবে কিনতে পারেন। এতে আপনি আপনার পছন্দ ও রুচি অনুযায়ী ডিজাইন করে পোশাক তৈরি করে নিতে পারবেন সহজে। যা অন্যদের থেকে হবে আলাদা। আমাদের দেশে এখন দেশীয় কাপড়ের জন্য বেশ অনেক ফ্যাশন হাউস আছে।
আড়ং থেকে শুরু করে দেশী দশ, দেশাল, নবরূপা, চরকা, সোর্স, আরণ্যক, প্রবর্তনা, যাত্রা, নোঙর ইত্যাদিতে অনেক ডিজাইন আর রঙের বাটিকের পোশাক পাবেন। এ ছাড়াও গাউসিয়া, চাঁদনী চক, নিউমার্কেটসহ শহরের প্রায় সব মার্কেটেই বাটিক প্রিন্টের পোশাক পাবেন।
বাটিক কাপড়ের দামদর
সব কাপড়ের থেকে বাটিক প্রিন্টের কাপড়ের দাম নির্ধারণ করা হয় একটু ভিন্নভাবে। এই কাপড়ের দাম নির্ভর করে এর রঙের ওপরে। কাপড়ে প্রাকৃতিক রঙের ব্যবহার হলে এর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি হয়।
বেশিরভাগ সময় বাটিকে প্রাকৃতিক রং ব্যবহার করা হয়। যেমন- নীল, তুঁতে, গাঁদাফুল, শিউলীফুল, পেঁয়াজের খোসা, হরতকী, খয়ের ইত্যাদি প্রাকৃতিক উপাদান থেকে বিশেষ উপায়ে রং তৈরি করে তা দিয়ে বাটিকের কাজ করা হয়।
বাটিকের সালোয়ার-কামিজ (সেলাইবিহীন) পাবেন ৪৫০-২৫০০ টাকা, সেলাইসহ ১২০০-৪৫০০ টাকা, শাড়ি ১২০০-৬০০০ টাকা, ফতুয়া ৪৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ট ২৫০-১২০০ টাকা, ওড়না ৩৫০-১৫০০ টাকা, স্কার্ফ ১৫০-৫৫০ টাকা, পাঞ্জাবি ৬৫০-২০০০ টাকা, শার্ট ৪৫০-১২০০ টাকা।
এ ছাড়াও প্রতি গজ কাপড় পাবেন ১১০-৪৫০ টাকার মধ্যে। তবে স্থানভেদে এর দামে তারতম্য হতে পারে। বর্তমানে অনলাইনেও অনেক পেইজ আছে, যেখান থেকে বাটিকের পোশাক কিনতে পারবেন ঘরে বসেই।
জেএমএস/জিকেএস