কোন ধরনের মাথাব্যথায় কী করা উচিত?
সাইনোসাইটিস, সারভাইক্যাল স্পনডাইলোসিস, ম্যাস্টয়ডাইটিস, গ্লুকোমা, স্ট্রোক, মাথায় আঘাতজনিত কারণে বা মস্তিস্কের টিউমারের জন্য মাথাব্যথা হওয়া, পোস্ট কনকাশন সিন্ড্রোম, মস্তিষ্ক আবরণীতে রক্তক্ষরণ প্রভৃতি হলো মাথাব্যথার বিভিন্ন ধরনের সেকেন্ডারি কারণ। মাথাব্যথা প্রতিরোধ এবং সঠিক চিকিৎসার জন্য আক্রান্ত ব্যক্তি কী ধরনের মাথাব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন- তা নিয়ে সম্যক ধারণা থাকা জরুরি।
চোখের সমস্যাজনিত মাথাব্যথা: এটি মাথাব্যথার সেকেন্ডারি কারণের মধ্যে একটি। শতকরা প্রায় ৫ ভাগ মাথাব্যথা চক্ষুরোগজনিত। চোখের দৃষ্টিক্ষমতা ব্যাহত হলে মাথাব্যথা হতে পারে। দীর্ঘক্ষণ কোনো সূক্ষ্ম কাজ করলে, অনেকক্ষণ ধরে পড়াশোনা বা সেলাই করলে, টিভি, মোবাইল বা কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকলেও মাথাব্যথা হতে পারে। এ ছাড়া চোখের কোনো রোগের কারণে, যেমন- গ্লুকোমা, কর্নিয়া কিংবা আইরিশের প্রদাহ, রেট্রোবালবার নিউরাইটিস ইত্যাদি ক্ষেত্রেও মাথাব্যথা হতে পারে। চক্ষুজনিত মাথাব্যথা সাধারণত চোখে, কপালের দু’দিকে বা মাথার পেছনে হয়ে থাকে। চক্ষুরোগজনিত কারণে সংঘটিত মাথাব্যথায় অবশ্যই চক্ষু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া আবশ্যক।
সাইনোসাইটিস ও অ্যালার্জিজনিত মাথাব্যথা: মুখমণ্ডলের হাড়ের মধ্যে অবস্থিত কিছু ফাঁকা জায়গা রয়েছে- একে বলা হয় সাইনাস। চোখের পেছনে ও নাকের হাড়ের দুই পাশে এ রকম ফাঁকা জায়গা রয়েছে। যাদের ক্রোনিক কিংবা সিজনাল অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, বিশেষত তাদের এই সাইনাসে সর্দি জমে প্রদাহ হয়। ফলে সাইনোসাইটিসে সাইনাসে বাতাস আটকা পড়ে যায় এবং মাথাব্যথা শুরু হয়। এ মাথাব্যথা কপালে বা গালের দুই দিকে কিংবা চোখের পেছনে হয় এবং সাথে কিছুটা জ্বরবোধ, হাঁচি, কাশি প্রভৃতিও থাকে।
অনেক সময়ই মাইগ্রেন এবং সাইনোসাইটিসজনিত মাথাব্যথার মাঝে বেশ সাদৃশ্য দেখা যায়। অ্যালার্জি ও সাইনোসাইটিসজনিত মাথাব্যথায় অ্যান্টিবায়োটিকের পাশাপাশি অ্যান্টিহিস্টামিন জাতীয় ওষুধ বেশ ভালো কাজ করে। পাশাপাশি ন্যাজাল ডিকনজেস্ট্যান্ট জাতীয় স্প্রে বা ড্রপও ব্যবহার করা যায়। এ ছাড়া গরম পানি দিয়ে গোসল করলে অথবা গামলায় গরম পানি নিয়ে নাক দিয়ে বাষ্প টেনে নিলেও বেশ আরাম পাওয়া যায়। খুব বেশি মাথাব্যথা করলে এক টুকরো কাপড় গরম পানিতে ভিজিয়ে কপাল, চোখের ওপর বা নাকের দুই পাশে সেঁক দিলে সাইনাসের বদ্ধতা কাটার পাশাপাশি কিছুটা উপকার পাওয়া সম্ভব।
হরমোন পরিবর্তনজনিত মাথাব্যথা: নারীদের ক্ষেত্রে রজঃস্রাব, গর্ভধারণ এবং রজঃনিবৃত্তির সময় ইস্ট্রোজেন ও প্রোজেস্টেরন হরমোনের মাত্রার পরিবর্তন হয়। তখন মন-মেজাজ পরিবর্তন, খিটখিটে মেজাজ, এমনকি মাথাব্যথাও হতে পারে। রজঃস্রাবের কিছু পূর্বে, রজঃস্রাব চলাকালীন বা রজঃস্রাবের অব্যবহিত পরেই অথবা ডিম্বপাতের সময়ে এ ধরনের মাথাব্যথা তীব্র আঘাত হানতে পারে। এজন্য অনেক ক্ষেত্রেই একে রজঃকালীন মাইগ্রেন বলা হয়ে থাকে। এ ছাড়া যারা আগে থেকেই মাইগ্রেনে ভুগছেন, তাদের ক্ষেত্রে এ ধরনের মাথাব্যথা আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে। জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনের পর হরমোনের পরিমাণের তারতম্যের কারণেও অনেকের মাথাব্যথা বেড়ে যায়। এ ধরনের মাথাব্যথার চিকিৎসায় ন্যাপ্রোক্সেন জাতীয় ব্যথানাশক ওষুধ সেবনের পাশাপাশি হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি উপকারী ফল বয়ে আনতে পারে। এ ছাড়া টেনশনমুক্ত দৈনন্দিন জীবন নিশ্চিত করা, পর্যাপ্ত ঘুম ও পানি পান ইত্যাদিও বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।
রিবাউন্ড মাথাব্যথা: অনেক দিন ধরে কেউ মাথাব্যথার ওষুধ নিয়মিত খেলে তার রিবাউন্ড হেডেক হতে পারে। বিশেষ করে যাদের মাইগ্রেন আছে; তারা যদি দীর্ঘদিন ধরে মাইগ্রেনের ওষুধ খান, তাহলে তাদের এ ধরনের মাথাব্যথা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তবে ব্যথার ওষুধ খাওয়া কমিয়ে দিলে সাধারণত এ ব্যথা কমে যায় কিন্তু ব্যথার ওষুধ আবার সেবন করলে পুনরায় মাথাব্যথা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সাধারণত প্রায় প্রতিদিনই মাথাব্যথা হয়, বিশেষ করে সকালে হাঁটলে এ ব্যথার তীব্রতা আরও বেশি অনুভূত হয়। সেইসাথে বমি বমি ভাব, উদাসীনতা, খিটখিটে মেজাজ, অস্থিরতা, অমনোযোগিতা ইত্যাদিও পরিলক্ষিত হয়। রিবাউন্ড হেডেক প্রতিরোধ করতে পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। যেসব ওষুধ সেবনে মাথাব্যথা হয়- সেগুলো না খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। নিয়মিত পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ ও ব্যায়াম করার অভ্যাস করতে হবে। মানসিক চাপ ও ধূমপান পরিহার করার পাশাপশি স্থূলতা প্রতিরোধেও সজাগ থাকতে হবে।
পরিশ্রম সম্পর্কিত মাথাব্যথা: কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের পরে কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মিলনের সময় বা আগে ও পরে মাথাব্যথা হতে পারে। একে বলা হয় এক্সারশনাল হেডেক বা পরিশ্রম সম্পর্কিত মাথাব্যথা। সাধারণত প্রচণ্ড এক্সারশনে এ মস্তিষ্কে রক্তচাপ বেড়ে গিয়ে এ ধরনের ব্যথা হয়। এ ব্যথা খুব একটা তীব্র হয় না এবং সেরে যায় কিছুক্ষণের মধ্যেই। তবে পরিশ্রমের পর বা শারীরিক মিলনে হঠাৎ যদি কখনো তীব্র মাথাব্যথা হয় এবং সেই সাথে বমি ভাব, খিঁচুনি, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া ইত্যাদি উপসর্গ থাকে। তবে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। কারণ মস্তিষ্কের রক্তনালীর এনিউরিজম বা ম্যালফরমেশন জাতীয় ত্রুটির জন্য এ ব্যথা তীব্রতর হয় এবং এ থেকে অনেক সময় স্ট্রোক হয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।
উচ্চরক্তচাপজনিত মাথাব্যথা: উচ্চরক্তচাপজনিত মাথাব্যথা সাধারণত মাথার দুইপাশেই শুরু হয় এবং কপালের সামনে একটি দপদপে অনুভূতি সৃষ্টি হয় ও মাথা ঝিমঝিম করে। কিছু ক্ষেত্রে এ ব্যথা থেকে ঘাড়ও রেহাই পায় না। রক্তচাপ হঠাৎ করেই বিপৎসীমার উপরে উঠে গেলে এ ধরনের ব্যথার সূত্রপাত হয়। দৈনন্দিন কাজকর্মের সাথে সাথে এবং মাথা ঝোঁকালে উচ্চরক্তচাপজনিত মাথাব্যথাও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। সেইসাথে দৃষ্টিসীমার পরিবর্তন, হাতে-পায়ে ঝিন-ঝিন করা, বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, নাক দিয়ে রক্তক্ষরণ প্রভৃতি উপসর্গ দেখা দিতে পারে। বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এ ব্যথার প্রকোপ বেশি দেখা যায়। উচ্চরক্তচাপজনিত মাথাব্যথায় অবহেলা না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন। রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে গেলে এ ধরনের মাথাব্যথাও প্রশমিত হয়ে যায়।
মাথাব্যথা যে কারণেই হোক না কেন- সময়মত যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবার্তা মেনে চললে দৈনন্দিন এ সমস্যার হাত থেকে অনেকাংশেই মুক্ত থাকতে পারব। তথাপি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
এসইউ/এমকেএইচ