১৬ নারীর উদ্যোগে বদলে যাচ্ছে নওগাঁ


প্রকাশিত: ১১:০২ এএম, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫

এক মুঠো চালে যে একটি পরিবার ও সমাজের চিত্র পাল্টে দিতে পারে, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নওগাঁর পত্নীতলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নারীরা। যার নামকরণ হয়েছে মুষ্টি চাল সমিতি বা কমিউনিটি ফুড ব্যাংক।

গত পাঁচ বছরে উপজেলার বুজরুক মামুদপুর গ্রামের ১৬ জন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারী মুঠো মুঠো করে সঞ্চিত ৭০ মণ চাল মঙ্গা ও অভাবের সময় দিয়েছে তাদের পারিবারিক নিরাপত্তা। সমিতিতে চাল জমা থাকায় কর্মহীন ও বিপদের সময় আর তাদের আগাম শ্রম বিক্রি করতে হয় না। যেতে হয় না দাদন ব্যবসায়ীর কাছে। যে কোনো বিপদের সময় তারা এখন ফুড ব্যাংক থেকে চাল ধার নিচ্ছে এবং কাজের সময় কিছু অতিরিক্ত চালসহ আবার ফেরত দিচ্ছে। এই অতিরিক্ত চাল সমিতির লাভ হিসেবে জমা হচ্ছে।

কমিউনিটি ফুড ব্যাংকের কার্যক্রম পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, গ্রামের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী নারীরা এক জায়গায় সমবেত হয়েছেন সপ্তাহে সঞ্চিত কৌটার চাল নিয়ে। সমিতির সভাপতি প্রত্যেকের খাতায় হিসাব লিখে দিচ্ছেন। তারা জানান, প্রতিদিন চুলোয় ভাত চাপানোর আগে নির্ধারিত চাল থেকে এক মুঠো চাল তারা কৌটায় রাখেন। সমিতির সদস্যরা সপ্তাহে একদিন সুবিধা মতো সময়ে সভায় মিলিত হয়ে প্রত্যেকে ২৫০ গ্রাম করে চাল জমা দেন। কোনো সদস্য যদি চাল ঋণ নিতে চান বা গ্রহণ করা চাল ফেরত নিতে চান সেটিও এই সভায় আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয়।

সমিতির সভাপতি শুনিবালা উরাও বলেন, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরা সবাই দিন-মজুর। বছরের বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ ও আশ্বিন-কার্তিক মাসে মাঠে কোনো কাজ থাকে না। এ সময় তারা গৃহস্থ্যদের কাছে আগাম শ্রম বিক্রয় করতে বাধ্য হন। অনেকেই উচ্চ সুদে দাদন নিয়ে সংসার চালাতেন। এই দাদনের শর্ত হচ্ছে, এক হাজার টাকা নিলে তিন মাস পর দেড় হাজার টাকা এবং এক মণ চাল নিলে দেড় মণ চাল ফেরত দিতে হয়। যাকে স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ডেরা।

অন্যদিকে আগাম শ্রম বিক্রি করায় তাদের প্রতিদিন ৫০-৬০ টাকা লোকসান গুণতে হতো। ২০০৯ সালে স্থানীয় বেসরকারি সংগঠন বিএসডিও কর্মীরা গ্রামে অবস্থিত প্রাক-প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাসিক মা ফোরাম সভায় জেলার মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর গ্রামের ফুড ব্যাংকের সফলতার কাহিনী আলোচনা করেন। এ কাহিনী জানার পর ওই বছরই আমরা ১৬ জন নারী মিলে মুষ্টি চাল সমিতি গঠন করি এবং চাল জমা করতে থাকি। বর্তমানে আমরা ৭০ মণ চাল জমা করেছি।

তিনি আরও জানান, এখন নিজেদের ঘরেই চাল থাকার কারণে আমাদের আর দাদন ব্যবসায়ীদের কাছে যেতে হয় না। সমিতির সদস্যদের পাশাপাশি আমরা গ্রামের অন্যান্য পরিবারকেও চাল ঋণ দিয়ে থাকি। কেউ এক মণ চাল নিলে তাকে তিন মাস পর মাত্র পাঁচ কেজি চাল বেশি ফেরত দিতে হয়। সুদে ঋণ দেওয়ার লোক না পাওয়ায় দাদন ব্যবসায়ীরা এখন গরু ব্যবসায় নেমেছে।

সমিতির সদস্যরা জানান, বার্ষিক প্রয়োজনের উদ্বৃত্ত ১০ মণ চাল বিক্রি করে ১৫ হাজার টাকায় একটি বকনা গরু কিনে আমরা সমিতির একজন সদস্যকে বর্গা দিয়ে থাকি। আমাদের পরিকল্পনা হলো পর্যায়ক্রমে সব সদস্যকে একটি করে গরু কিনে দেওয়া। কমিউনিটি ফুড ব্যাংক শুধু আগাম শ্রম বিক্রয় ও দাদন ব্যবসা ঠেকিয়ে দিয়েছে, তাই নয়। সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করছে এই সমিতি। গ্রামের কেউ মারা গেলে, ছেলে-মেয়ের বিয়ে, সন্তানের পরীক্ষার ফরম ফিলাপ ও খাতা কলম ক্রয় করে দিচ্ছে চাল সমিতির সদস্যরা। যার মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে সমিতির সদস্যসহ গ্রামবাসী।

কমিউনিটি ফুড ব্যাংক বিষয়ে আদিবাসীদের নিয়ে কর্মরত সংগঠন বিএসডিওর নির্বাহী পরিচালক আবদুর রউফ বলেন, বিএসডিওর উদ্বুদ্ধকরণের ফলে সর্বপ্রথম ২০০৫ সালে জেলার মহাদেবপুর উপজেলার দেওয়ানপুর গ্রামে মুষ্টি চাল সমিতি বা কমিউনিটি ফুড ব্যাংক গঠন করা হয়। এর সফলতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বিভিন্ন গ্রামে আরও ৪০টি কমিউনিটি ফুড ব্যাংক গঠিত হয়েছে।

এমএএস/আরআই

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।