চিকেন পক্স কেন হয়, কী দেখে বুঝবেন এর সংক্রমণ

ছোটবেলায় চিকেন পক্স হয়নি এমন মানুষের সংখ্যা খুব বেশি না। সাধারণত শিশুদের মধ্যে এই রোগ বেশি দেখা গেলেও এবছর অনেক প্রাপ্তবয়স্করাও আক্রান্ত হচ্ছেন। চিকেন পক্স একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা একাধিক উপায়ে ছড়াতে পারে।
চিকেন পক্স ভেরিসেলা-জোস্টার ভাইরাস সংক্রমণ (ভিজেডভি) দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস, যা সহজেই একজন থেকে আরেকজনের দেহে ছড়িয়ে পড়তে পারে। ফুসকুড়ি শুরু হওয়ার তিন দিন আগে থেকেই শ্বাস-প্রশ্বাসের সংস্পর্শে এটি সংক্রমণ ঘটাতে পারে। একবার আপনি ভিজেডভিতে আক্রান্ত হলে, ভাইরাসটি সারাজীবন আপনার শরীরে থাকে। এটি পরবর্তী জীবনে পুনরায় সক্রিয় হতে পারে। তবে সাধারণত একবার চিকেন পক্স হয়ে সেরে গেলে একই তীব্রতায় এটি আবার ফিরে আসে না।
চিকেন পক্সের লক্ষণ
এটি একটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে রোগ, তাই পরিবেশে ভিজেডভি ভাইরাসের প্রকোপ বছরের যে সময়টিতে বেড়ে যায়, সে সময় অনেক মানুষ এতে আক্রান্ত হয়। তবে ভয়ের কিছু নেই, কিছু সাবধানতা অবলম্বন আর উপসর্গ নিরাময়ের চিকিৎসা নিলে আপনার শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা নিজেই এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়তে শুরু করবে। তবে কীভাবে বুঝবেন যে আপনার শরীরে সক্রিয় ভিজেডভি ভাইরাসে ঢুকে পড়েছে কিনা? এর জন্য জানতে হবে বিভিন্ন স্তরে পক্সের লক্ষণগুলো। এক নজরে দেখে নিন এই মৌসুমে কোন কোন লক্ষণ দেখা দিলে সতর্ক হতে হবে-
১. প্রাথমিক উপসর্গ: হঠাৎ জ্বর, ১০১ থেকে ১০৩ ডিগ্রি; মাথাব্যথা ও শরীর ব্যথা, গলা ব্যথা, অবসাদ ও ক্ষুধামন্দা।
২. চর্মের লক্ষণ: জ্বর শুরুর ১-২ দিন পর লাল দানার মতো ফুসকুড়ি দেখা দেয়। এরপর বুক, পিঠ, মুখসহ সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়। ফুসকুড়ি ধীরে ধীরে পানিভর্তি ফোস্কায় পরিণত হয়। ফুসকুড়িগুলোতে তীব্র চুলকানি হওয়া স্বাভাবিক।
দুর্বলতা, ক্লান্তি ও কিছু ক্ষেত্রে বমি বমি ভাব হতে পারে।
চিকেনপক্স যেভাবে সংক্রমিত হয়
এয়ারবর্ন ট্রান্সমিশন: চিকেনপক্স বাতাসের মাধ্যমে ছড়াতে পাড়ে। আক্রান্ত ব্যক্তির হাঁচি-কাশিতে ভিজেডভি ভাইরাস থাকে। সেই বাতাসে শ্বাস নেওয়ার মাধ্যমে আশেপাশের মানুষ সংক্রমিত হতে পারে। ভাইরাসটি স্কুল এবং অফিসের মতো জনাকীর্ণ জায়গায় সহজে ছড়িয়ে পড়ে।
সরাসরি যোগাযোগ: চিকেন পক্স সংক্রামিত হওয়ার আরেকটি সাধারণ উপায় হল সংক্রামিত ব্যক্তির সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ বা স্পর্শ। এমনকি যদি ফোসকা শুকিয়ে যায় এবং চুলকানি হয়, তবুও তারা সংক্রামক হতে পারে।
দূষিত পৃষ্ঠতল: ভেরিসেলা-জোস্টার ভাইরাস অল্প সময়ের জন্য পৃষ্ঠে বেঁচে থাকতে পারে। আপনি যদি একটি দূষিত পৃষ্ঠ স্পর্শ করেন এবং তারপর আপনার মুখ স্পর্শ করেন, আপনি ভাইরাস সংক্রামিত হতে পারে। তবে ভ্যারিসেলা-জোস্টার ভাইরাস সংক্রমণের এই ধরনটি বায়ুবাহিত এবং সরাসরি যোগাযোগের তুলনায় কম।
চিকেন পক্স হলে যা করবেন
১. আইসোলেশন বা বিচ্ছিন্নতা: রোগীকে আলাদা ঘরে রাখুন। অবশ্যই পরিবারের গর্ভবতী সদস্য, বয়স্ক ও শিশুদের সংস্পর্শে আসতে দেবেন না।
২. চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা: প্রাপ্তবয়স্করা প্রথমে বাড়িতে জ্বর কমানোর ব্যবস্থা নিতে পারেন। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে অবশ্যই আগে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
৩. ত্বকের যত্ন: ফোস্কা ফাটাবেন না, এতে ফুসকুড়ি বাড়তে পারে। ফুসকুড়ি না চুলকানোর চেষ্টা করুন, এতে ত্বকে বেশি দাগ হয়। নখ ছোট করে রাখুন। প্রতিদিন হালকা গরম পানিতে গোসল করুন। সম্ভব হলে গোসলের পানিতে নিমের পাতা ব্যবহার করুন। নরম সুতি কাপড় পরুন, এতে কিছুটা আরাম পাবেন।
৪. খাদ্যাভ্যাস: প্রচুর তরল ও পুষ্টিকর খাবার খান। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (যেমন- পেয়ারা, লেবু, আমলকী) খাবেন। মসলাদার ও পেট গরম হওয়ার মতো খাবার এড়িয়ে চলুন।
৫. জরুরি অবস্থা:
জ্বর ১০৪ ডিগ্রির বেশি উঠলে, ফোস্কা থেকে পুঁজ বের হলে, শ্বাসকষ্ট বা বুক ব্যথা করলে ও অতিরিক্ত দুর্বলতা বা পানিশূন্যতা দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তার দেখান।
চিকেনপক্সের জটিলতা
যদিও চিকেন পক্স সাধারণত নিজেই ঠিক হয়ে যায়, তবে এটি কিছু ক্ষেত্রে গুরুতর জটিলতার কারণ হতে পারে। যেমন-
১. ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন: ফোস্কা আঁচড়ালে ত্বকে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হতে পারে, যা থেকে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।
২. নিউমোনিয়া
চিকেন পক্স নিউমোনিয়ার কারণ হতে পারে, বিশেষ করে প্রাপ্তবয়স্কদের, গর্ভবতী মহিলাদের এবং দুর্বল রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পন্ন ব্যক্তিদের। শ্বাস নিতে সমস্যা, বুকে ব্যথা, এবং ক্রমাগত কাশি নিউমোনিয়ার লক্ষণ।
৩. মস্তিষ্কপ্রদাহ
বিরল ক্ষেত্রে, চিকেন পক্স থেকে হতে পারে মস্তিষ্কের প্রদাহ। গুরুতর মাথাব্যথা, বমি, বিভ্রান্তি এবং খিঁচুনি মস্তিষ্ক প্রদাহের লক্ষণ। এমন সময় অবিলম্বে চিকিৎসকের মনোযোগ প্রয়োজন।
গর্ভবতী নারীদের চিকেন পক্স
গর্ভবতী নারীদেরা যারা চিকেন পক্সে আক্রান্ত হয় তাদের নিজেদের এবং তাদের অনাগত শিশু উভয়ের জন্যই জটিলতার ঝুঁকি থাকে। গর্ভবতী নারীদের নিউমোনিয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা গুরুতর হতে পারে।
গর্ভাবস্থার প্রথম ২০ সপ্তাহে মা চিকেন পক্সে আক্রান্ত হলে, শিশুর জন্মগত ভেরিসেলা সিন্ড্রোমের ঝুঁকি থাকে। এই অবস্থায় শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে পারে।
প্রতিরোধ ব্যবস্থা
আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যবহৃত জিনিস আলাদা করুন ও হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করুন। টিকাদানের মাধ্যমে চিকেনপক্স প্রতিরোধ করা যেতে পারে। এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সাধারণত হালকা হয়, যেমন ইনজেকশনের স্থানে কিছু ব্যথা বা ফোলাভাব। অনেক দেশেই ভ্যারিসেলা টিকা সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক টিকাদানের পাঁচ বছর পর দ্বিতীয় ডোজ নিতে হয়। টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তি সংক্রামিত হলে তাদের চিকেনপক্সের সংক্রমণ তেমন মারাত্মক হয়না।
চিকেন পক্স সাধারণত ৭-১৪ দিনে সেরে যায়, তবে সঠিক যত্ন না নিলে নিউমোনিয়া ও মস্কিষ্কের প্রদাহ বা এনসেফালাইটিসের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে। মনে রাখবেন, চিকেন পক্সে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। সঠিক পরিচর্যা ও চিকিৎসকের পরামর্শে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ সুস্থ হওয়া সম্ভব।
এএমপি/এমএস