দায়িত্ব অর্পণ নিয়ে নতুন দ্বন্দ্বে খুলনা যুবলীগ

অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে এক যুগ ধরে খুলনা জেলা যুবলীগের সম্মেলন হয়নি। ওই সম্মেলনের মাধ্যমে যারা কমিটিতে এসেছিলেন তাদের অনেকেই এখন নেই। ফলে নেতৃত্ব শূন্যতায় থমকে আছে খুলনা জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড।
তারপর আবার নিয়ম-নীতির ব্যতয় ঘটিয়ে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পৃথকভাবে নিজ বলয়ের নেতাদের দিয়ে পাল্টা-পাল্টি ভারপ্রাপ্ত সভাপতি-সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়েছে।
অভিযোগ উঠেছে, ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখতে সংগঠনের সাবেক শীর্ষ দু’নেতা এমনটা করছেন। এদিকে, ত্যাগী ও পরীক্ষিতদের বাদ রেখে পৃথক দু’টি কমিটি কেন্দ্রে জমার গুঞ্জন আছে আগে থেকেই। সব মিলিয়ে উভয় গ্রুপের নেতা-কর্মীদের মাঝে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে।
সূত্র মতে, গত বছরের নভেম্বরে আ.লীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদক পদ পেয়েছেন জেলা যুবলীগের সভাপতি মো. কামরুজ্জামান জামাল ও সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জামান বাবু। এরপর থেকেই জেলা যুবলীগে নেতৃত্ব শূন্যতা বিরাজ করছে। তখন যুবলীগের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এক নির্দেশনায় জানান, জামাল ও বাবু সংগঠনের দায়িত্ব পালন করবেন।
বলা বাহুল্য, জামাল জেলা আ.লীগ সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদের অনুসারী এবং বাবু একই সাংগঠনিক জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এস এম মোস্তফা রশিদী সুজা এমপির অনুসারী বলে পরিচিত। এ দু’গ্রুপের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব এখন ওপেন সিক্রেট।
জেলার বিভিন্ন উপজেলার এদের মধ্যে সংঘাতের ঘটনাও রয়েছে। ইউপি নির্বাচনকালীন প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া নিয়ে এ দু’গ্রুপ পাল্টা-পাল্টি সংবাদ সম্মেলন ও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। এছাড়া কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জেলা যুবলীগের উভয় গ্রুপকে ১০ সদস্যের পৃথক আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে কেন্দ্রে জমার নির্দেশ দেন।
তা সত্ত্বেও উভয় গ্রুপ ২০ জনের নাম প্রস্তাব করে অনুমোদনের জন্য পাঠান। যা বিদ্যমান দ্বন্দ্বের ফল। এদিকে নেতৃত্ব শূন্যতা পূরণে সংগঠনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক জুলফিকার আলী জুলুকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম-সম্পাদক সরদার জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের নির্দেশ দেন দলটির সভাপতি কামরুজ্জামান জামাল।
এ ঘটনায় গত ৬ মে দলটির সাধারণ সম্পাদক আকতারুজ্জামান বাবু ও তার অনুসারীরা জেলা যুবলীগের কার্যনির্বাহী সভা করে নগরীর একটি অভিজাত হোটেলে। ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি মনিরুজ্জামান মনিরের (মূল দলে পদভুক্ত) সভাপতিত্বে সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন আকতারুজ্জামান বাবু।
ওই সভায় সর্বস্মতিক্রমে জেলার সহ-সভাপতি আজিজুল ইসলাম কাজলকে (শ্রমিক লীগের পদভুক্ত) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক সেলিম মাসুদকে (বাগেরহাটে প্রাইমারি স্কুলে চাকুরিরত) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মনোনীত করা হয়।
এর একদিন পর ৮ মে কামরুজ্জামান জামালের অনুসারীরা জেলা যুবলীগের নির্বাহী কমিটির সভা করে দলীয় কার্যালয়ে। ওই সভায় সংগঠনের সভাপতি-সম্পাদক জেলা আ.লীগের স্থলাভিষিক্ত হওয়ায় সাংগঠনিক কার্যক্রম সচল রাখতে সর্বসম্মতিক্রমে অধ্যাপক জুলফিকার আলী জুলুকে (দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সম্প্রতি সুস্থ হয়ে সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিচ্ছেন) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সরদার জাকির হোসেনকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা আ.লীগের উপ-দফতর সম্পাদক অ্যাড. শাহ আলম।
জানা গেছে, বর্তমানে সংগঠনের ৯ উপজেলার মধ্যে রূপসা, বটিয়াঘাটা ও ডুমুরিয়ায় আহ্বায়ক এবং বাকী ৬টিতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করাসহ ৬৮টি ইউনিয়ন, ২ পৌরসভা ও ৭ শতাধিক ওয়ার্ডে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে দীর্ঘদিন সম্মেলন না হওয়ায় জেলা যুবলীগের এক-তৃতীয়াংশ নেতা আজ নিস্ক্রিয়। এদের মধ্যে অনেকেই মূল দলে পদভুক্ত হয়েছেন। কেউ মারা গেছেন, কেউ বিদেশে আছেন। ফলে বর্তমান সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে।
নাম প্রকাশে অচ্ছিুক কতিপয় নেতা-কর্মী জানান, জেলা আ.লীগের সভাপতি ও সম্পাদক প্রকাশ্যে সু-সম্পর্ক থাকলেও অন্তঃকোন্দল চরমে পৌঁছেছে। তাদের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় অনুসারী যুবলীগ নেতারও দু’টি ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। সঙ্গত কারণেই চলমান দ্বন্দ্ব বিরাজ করছে জেলা যুবলীগে। তাদের অভিমত মূল দলের নেতাকে খুশি রাখতেই যুবলীগসহ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতারা দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে তাদের আশঙ্কা রয়েছে দ্রুত এ দু’টি গ্রুপের মধ্যে সমঝোতা না হলে কিংবা কেন্দ্রীয় যুবলীগ বিদ্যমান সংকট নিরসনের ব্যবস্থা না নিলে বড় ধরনের সংঘাত সৃষ্টি হতে পারে।
কেন্দ্রীয় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশীদ জানান, দলটির খুলনা জেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক না থাকায় সংগঠনটি অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে। আর অভিভাবকহীন সংগঠনের কোনাে ভিত্তি নেই। ফলে অচিরেই স্থানীয় আ.লীগ নেতৃবৃন্দ ও সংসদ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হবে। সেক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের হাল ধরে রাখা যুবনেতাদের মূল্যায়ন করা হবে।
কামরুজ্জামান জামাল বলেন, জেলা আ.লীগের শীর্ষ এক নেতাকে খুশি করার জন্যই অগণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছে কতিপয় বিচ্ছিন্ন নেতা।
তিনি জানান, মূল দলে স্থান পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় যুবলীগ দ্রুততম সময়ে সম্মেলন করার পরামর্শ দিয়েছে। সে মোতাবেক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চলছিল। কিন্তু হঠাৎ করে সাধারণ সম্পাদক নিজে উপস্থিত থেকে অগণতান্ত্রিক পন্থা অবলম্বন করে তার অনুসারীদের মধ্যে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব অর্পণ করেছেন। যার কারণে জেলার অপর নেতারাও একই কাজ করেছেন।
আকতারুজ্জামান বাবু জানান, নিয়ম অনুযায়ী সংগঠনের কার্যনির্বাহী কমিটির সভা আহ্বান করবেন সভাপতি। এরপর সভার উপস্থিত সংখ্যাগরিষ্ঠদের মতামতের ভিত্তিতে ক্রমানুসারে সহ-সভাপতি ও যুগ্ম-সম্পাদককে ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব অপর্ণ করা হবে। সভার রেজুলেশন করে তা কেন্দ্রে অনুমোদনের জন্য পাঠাতে হবে। সেখানে সভাপতি সভার আহ্বান না করেই ভারপ্রাপ্ত দায়িত্ব দিয়ে দেন। যা সম্পর্কে অধিকাংশ সদস্যই অবগত নন। বরং পরদিন পত্রিকায় বিবৃতি দেখে তারা বিস্মিত হয়েছেন।
এখানে তাকে নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি শোনেননি। সে অবস্থায় কমিটির কার্যনির্বাহী সভায় সর্বকনিষ্ঠ সহ-সভাপতি আজিজুল ইসলাম কাজলকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও ১ নং যুগ্ম-সম্পাদক সেলিম মাসুদকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছে এবং সভার রেজুলেশন করে তা অনুমোদনের জন্য কেন্দ্রে পাঠানোও হয়।
প্রসঙ্গত, ২০০৩ সালের ২৫ মে খুলনা জেলা যুবলীগের সর্বশেষ ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মো. কামরুজ্জামান জামাল সভাপতি ও মো. আক্তারুজ্জামান বাবু সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এর ৮ মাস পর ২০০৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ৭১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি অনুমোদিত হয়।
আলমগীর হান্নান/এসএস/এমএস