মনের ওপর কোন রঙের কেমন প্রভাব?
শরীর ও মন মিলেই আমাদের সমগ্র সত্তা। সুস্থ শরীর ছাড়া সুন্দর মন, সুস্থ মন ছাড়া সুস্থ শরীর কোনোটাই সম্ভব নয়। বিভিন্ন ধরনের শারীরিক অবস্থা যেমন মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করে; তেমনই নানাবিধ মানসিক অস্থিরতাও শারীরিক সুস্থতার ওপর আঘাত হানে। আধুনিক যান্ত্রিক জীবনে মানসিক অবসাদ, বিষণ্নতা, হতাশা প্রভৃতি যেন নিত্যসঙ্গী। আমরা শারীরিক সুস্থতা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন থাকি; মনের সুস্থতার ব্যাপারে ঠিক ততটাই উদাসীন। মানসিক স্বাস্থ্য কিন্তু কোনো অংশেই শারীরিক স্বাস্থ্যের চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপনের জন্য শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের সংযোগ আবশ্যক। একটিকে অবহেলা করে কখনোই সামগ্রিক সুস্থতা অর্জন করা সম্ভব নয়।
দীর্ঘদিন ধরেই মানসিক অবস্থার ওপর রঙের প্রভাব সম্পর্কে বহুমুখী গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। প্রাচীনকাল থেকেই মানুষ বিভিন্ন রংকে যোগাযোগ ও বিভিন্ন ধরনের সংকেত হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। কিছু কিছু গবেষণায় উঠে এসেছে, রং মানসিক অবস্থার নাটকীয় পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম। পাশাপাশি রং মানুষের আবেগ, অনুভূতি, সিদ্ধান্ত এবং বোধশক্তিতেও বিরাট পরিবর্তন নিয়ে আসে। এমনকি কিছু রং রয়েছে, যা রক্তচাপ ও শরীরবৃত্তীয় বিপাক বৃদ্ধিতেও ভূমিকা পালন করে। বিশিষ্ট চিত্রকর পাবলো পিকাসোর মতে, আবেগের পরিবর্তনকে অনুসরণ করাই রঙের বৈশিষ্ট্য। রং সম্পর্কে অনুভূতিগুলো প্রায়ই ব্যক্তিগত এবং তা নিজ নিজ অভিজ্ঞতা বা সংস্কৃতির সাথে জড়িত। যেমন- পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি সাদা রঙের ব্যবহার দেখা যায় পশ্চিমা দেশগুলোয়। পশ্চিমাদের বিশ্বাস, এটি তাদের বিশুদ্ধতা ও সরলতার প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু প্রাচ্যের দেশগুলোয় সাদা একসময় শোকের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
ক্রোমোথেরাপি হলো অল্টারনেটিভ মেডিসিন বা বিকল্প ওষুধ প্রয়োগের এক পদ্ধতি। যেখানে সমস্যার প্রকৃতি বিচার না করে ব্যক্তিবিশেষের কর্মশক্তিতে ভারসাম্য আনতে এবং মানসিক সংবেদনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ করে শারীরিক অবস্থার উন্নতি সাধন করতে বিভিন্ন বর্ণের আলো প্রয়োগ করা হয়। তবে কোনো কোনো সমালোচকদের মতে, এটি ছদ্মবৈজ্ঞানিক। কারণ ক্রোমোথেরাপি হলো মনোবিজ্ঞান, শিল্প, পদার্থবিজ্ঞান এবং ওষুধের সংমিশ্রণে এক বিশেষ ধরনের প্রায়োগিক জ্ঞান। কালার থেরাপি, ক্রোমোথেরাপি, ক্রোমাথেরাপি, কালার লাইট থেরাপি প্রভৃতি সবই সমার্থক বিষয়।
হিন্দু দার্শনিক অভিসেনা সর্বপ্রথম সুস্বাস্থ্যে রঙের তাৎপর্য উপলব্ধি করেন। ‘দ্য ক্যানন অব মেডিসিন’ নামক বইয়ে তিনি ক্রোমোথেরাপির বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। তার বর্ণনা অনুসারে রং হলো উচ্চাঙ্গের কম্পনে রাসায়নিক শক্তির প্রতীক। সুতরাং বিভিন্ন ব্যক্তির জন্য কোন রংটি বেশি কার্যকর হবে, তা জানা গেলে এর সাহায্যে কয়েকটি রাসায়নিক প্রতিক্রিয়ায় ভারসাম্য আনা সম্ভব। পরবর্তীতে নিউরোসাইকিয়াট্রিস্ট এবং আকুপাংচারিস্ট ডা. ক্রিশ্চিয়ান আগ্রাপার্ট দ্বারা ক্রোমোথেরাপির ব্যাপারটি আরও বিকাশিত হয়। ক্রোমোথেরাপির নীতি অনুসারে বিভিন্ন রং আমাদের ব্যতিক্রমী উদ্দীপনা নিয়ে আসতে পারে। যেমন- নির্দিষ্ট মানসিক অবস্থার সংশোধন, যা ব্যক্তির সামগ্রিক ভারসাম্যকে প্রভাবিত করে। রংগুলো মানসিক স্থিতাবস্থাকে শান্ত রাখতে পারে। এমনকি বিবিধ অত্যাবশ্যক শক্তিও বৃদ্ধি করতে পারে এবং বেশ কিছু ব্যাধি নিরাময়ও করতে পারে।
বিজ্ঞানী স্যার আইজাক নিউটন ১৬৬৬ সালে একটি পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, একটি প্রিজম আকৃতির স্বচ্ছ বস্তুর মধ্যদিয়ে সাদা আলোকরশ্মি যাওয়ার সময় সাতটি রঙে বিভক্ত হয়ে যায়। তখন তিনি দেখেন, প্রতিটি রঙেরই আলাদা আলাদা তরঙ্গদৈর্ঘ রয়েছে। পরবর্তীতে আরও কিছু পরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়, দুই বা ততধিক ভিন্ন রঙের আলো একসাথে মিলিয়ে আরেকটি সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী বর্ণের আলোয় পরিণত করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, লাল আলো এবং হলুদ আলোকে একত্র করলে এর ফলস্বরূপ কমলা রঙের আলো পাওয়া যাবে। আবার সবুজ এবং ম্যাজেন্টাকে একত্র করলে এরা পরস্পরকে বাতিল করে সাদা আলোয় পরিণত হয়। মূলত ছবি আঁকার ক্ষেত্রে বিষয়গুলো বেশি ব্যবহৃত হয়। রঙের উপলব্ধিগুলো কিছুটা বিষয়ভিত্তিক হলেও কিছু রং রয়েছে। যার নির্দিষ্ট সার্বজনীন অর্থ রয়েছে।
আলোক বর্ণালির লাল অঞ্চলের রংগুলো উষ্ণ রং হিসেবে পরিচিত এবং এতে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে লাল, কমলা ও হলুদ। রংগুলো উষ্ণতা, উত্তেজনা, ভালোবাসা, আবেগ এবং স্বাচ্ছন্দ্যের অনুভূতি থেকে শুরু করে রাগ এবং শত্রুতা পর্যন্তও প্রভাবিত করে। লাল রং আমাদের স্নায়ুকোষকে উদ্দীপ্ত করে এবং মনোযোগ আকর্ষণের জন্য লাল রঙের ব্যবহার অনেক আগে থেকেই লক্ষ্যণীয়। আবার বর্ণালির নীল অংশের অন্তর্ভুক্ত রং হলো নীল, গোলাপি ও সবুজ। যাদের শীতল রং হিসেবে বিবেচনা করা হয়। রংগুলো প্রশান্তির পাশাপাশি মনে উদাসিনতার ছাপও ফেলতে পারে। কেউ কেউ আবার নীলকে বিশ্বস্ততা ও শান্তির প্রতীক এবং সবুজকে স্নিগ্ধতা ও প্রশান্তির প্রতীক হিসেবেও বিবেচনা করেন। এ ছাড়া সংবেদনশীল রং হিসেবে ভালোবাসা ও আবেগের এক অপরূপ সংমিশ্রণ গোলাপি রঙেই খুঁজে পাওয়া যায়। আর পবিত্রতা, নিরপেক্ষতা, সরলতা ও শূন্যতার প্রতীক হিসেবে সাদাকেই বিবেচনা করা হয়। যেখানে ভয়, উৎকণ্ঠা, আক্ষেপ, মৃত্যু, শোক কিংবা রহস্যময়তা খুঁজে পাওয়া যায় কালোর মাঝে।
থেরাপি হিসাবে রঙের ব্যবহারে তিনটি প্রাথমিক রং এবং তাদের বিভিন্ন সমন্বয় থেকে উদ্ভুত আটটি রং ব্যবহার করা হয়। কেউ কেউ গোলাপি, ম্যাজেন্টা বা নীল রংকেও এ তালিকায় যোগ করে থাকেন। ক্রোমোথেরাপিস্টগণ বিভিন্ন রঙের আলোর ল্যাম্প বা ফ্ল্যাশলাইটগুলো আকুপাংচার বা ক্রোমোপাংচার মোড হিসাবে ব্যবহার করেন অথবা স্লাইডগুলো রোগীর শরীরে সরাসরি প্রয়োগ করা হয়। এ প্রয়োগের সময়কাল সাধারণত দশ থেকে ত্রিশ মিনিট সময় ব্যবধানে হয়ে থাকে। ক্রোমোথেরাপির সম্পূর্ণ ফলাফল পেতে দুই থেকে তিন সপ্তাহ সময়ের প্রয়োজন পড়ে। মিশরীয় এবং চীনসহ বেশ কয়েকটি প্রাচীন সংস্কৃতি ক্রোমোথেরাপি বা রোগ নিরাময়ের জন্য রঙের ব্যবহার অনুশীলন করেছিল।
লাল রং যেহেতু শক্তি এবং উদ্যোগের সঞ্চার করে, তাই উদাসীনতা, শারীরিক শিথিলতা এমনকি ঠান্ডাজনিত সর্দির ক্ষেত্রেও লাল ক্রোমোথেরাপির সুপারিশ করা হয়। অ্যাথলেটিক ক্রিয়াকলাপের সময়ও লাল রঙের কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে। তবে অতিরিক্ত প্রয়োগে এটি বিরক্তি, আগ্রাসন এবং ক্লান্তি সৃষ্টি করতে পারে। হলুদ স্পষ্টতা, আনন্দ, উদ্দীপনা ও উৎসাহ জোগায় বলে থেরাপি হিসাবে এটি কার্যকর এন্টিডিপ্রেসেন্ট। পাশাপাশি হজমজনিত অসুস্থতার ক্ষেত্রেও এটি সুপারিশ করা হয়। তবে অতিরিক্ত প্রয়োগে এটি বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে। কমলা রং ফুসফুসের নিরাময় ও শক্তির মাত্রা বৃদ্ধিতে ব্যবহার করা হয়।
হাইপারথাইরয়েডিজম নিয়ন্ত্রণ এবং টিস্যু মেরামত করতেও কমলা ক্রোমোথেরাপির জুড়ি নেই। তবে অতিরিক্ত প্রয়োগে নার্ভাসনেস ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। নীলকে অসুস্থতা প্রশমন, অপরাধ প্রবণতা দমন ও ব্যথা উপশমে কার্যকর বলে বিশ্বাস করা হয়। পাশাপাশি নীল ক্রোমোথেরাপি অনিদ্রা, মানসিক অবসাদ, স্ট্রেস, উচ্চ রক্তচাপ, তীব্র ব্যথা, জ্বর প্রভৃতি উপশমেও ভূমিকা পালন করে। এ ছাড়া হালকা নীল ত্বকের সমস্যা হ্রাস করতে পারে বলে মনে করা হয় এবং সবুজের সঙ্গে মিলিত হয়ে নীল অন্তর্দৃষ্টি এবং প্রতিভা জাগ্রত করতেও সাহায্য করে। সবুজ ক্রোমোথেরাপি কোষের বৃদ্ধি এবং ক্ষয়পূরণকে উদ্দীপিত করে। এ ছাড়া সবুজ আলো টনিক হিসাবে কাজ করে স্নায়বিক এবং সংবহনতন্ত্রকে ভারসাম্যপূর্ণ করে তোলে। তবে এটির অতিরিক্ত প্রয়োগ দুর্বলতার বা হতাশার জন্ম দিতে পারে।
ক্রোমোথেরাপির সীমাবদ্ধতা হলো, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি, রয়েল কলেজ, সোসাইটি অব মেডিসিন কিংবা ডিজিএইচএস কোনোটি দ্বারাই বৈজ্ঞানিকভাবে স্বীকৃত নয়। এ ছাড়া পিয়ার-পর্যালোচিত বৈজ্ঞানিক জার্নালেও কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ বা প্রকাশনা এর কার্যকারিতা প্রদর্শন করতে পারেনি। এটি একটি বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি যা অ্যালোপ্যাথিক ওষুধের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে মনোবিজ্ঞানীগণ বিষয়টি আরও ভালোভাবে পর্যালোচনার জন্য নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এসইউ/জেআইএম