শিশুর ডাউন সিনড্রোম হওয়ার কারণ কী?
সুস্থতা সৃষ্টিকর্তার সবচেয়ে বড় আশীর্বাদ। কেননা অনেক শিশু জন্মগতভাবেই নানা ধরনের সমস্যা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। এসব সমস্যার জন্য পরবর্তী জীবনে তাকে ও পরিবারকে বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেক সময় সমস্যাগুলোর সমাধান হয়, অনেক সময় কোনো সমাধান পাওয়া যায় না। জেনেটিক ত্রুটিগুলোর বেশিরভাগ সময়ই কোনো সমাধান পাওয়া যায় না।
আমাদের দেহে কোষের মধ্যকার ক্রোমোজমের ভেতর অবস্থিত ডিএনএকে বলা হয় বংশগতির ধারক ও বাহক। বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য যেমন আচার, আচরণ, বুদ্ধিমত্তা, চেহারা, উচ্চতা, গায়ের রং সবকিছুই এ ডিএনএর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এ ডিএনএ কিংবা ক্রোমোজমে কোনো অসামঞ্জস্যতা দেখা দিলে বিভিন্ন রকমের শারীরিক ও মানসিক ত্রুটি দেখা দেয়। এগুলোকে বলা হয় জেনেটিক ত্রুটি। ডাউন সিনড্রোম এ রকমই একটি জন্মগত জেনেটিক ত্রুটি।
পৃথিবীতে প্রায় ৭০ লাখ ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তি রয়েছেন। মানব ভ্রুণকোষে ২৩ জোড়া ক্রোমোজম থাকে- এরকম প্রতি জোড়া ক্রোমোজমে বিদ্যমান দুটি ক্রোমোজমের একটি আসে বাবার কাছ থেকে। আর আরেকটি আসে মায়ের কাছ থেকে। ডাউন সিনড্রোম হলে আরও একটি বাড়তি ক্রোমোজম ২১ নম্বর ক্রোমোজম জোড়ের জায়গায় ঢুকে পড়ে৷ তখন ২১তম স্থানে ক্রোমোজমের সংখ্যা ২টির বদলে হয়ে যায় ৩টি। একে ‘ট্রাইসোমি ২১’ বলা হয়৷ ৯৫ শতাংশ ডাউন সিনড্রোমই এ কারণে হয়ে থাকে বলে গবেষকরা মনে করেন৷ ২১ নম্বর ক্রোমোজম সংখ্যায় তিনটি থাকে বলে ২১/৩ অর্থাৎ একুশ মার্চ বিশ্ব ডাউন সিনড্রোম দিবস হিসাবে পালিত হয়।
আমাদের দেশে প্রায় দুই লাখ শিশু এ সমস্যায় ভুগছে। ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত শিশু প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি এক বিশেষ শিশু। প্রতি ৫০০ থেকে ৭০০ শিশুর মধ্যে একটি শিশু ডাউন সিনড্রোমে আক্রান্ত হিসেবে জন্মগ্রহণ করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, আমাদের দেশে প্রতিবছর ৫০০০ বা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫টি ডাউন শিশুর জন্ম হয়। আমাদের চারপাশে একটু খেয়াল করলে কোনো কোনো শিশুর মাঝে কিছু নির্দিষ্ট শারীরিক বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়, যেমন- মাংসপেশীর শিথিলতা, কম উচ্চতা, চোখের কোণা উপরের দিকে উঠানো, চ্যাপ্টা নাক, ছোট কান, হাতের তালুতে একটি মাত্র রেখা, জিহ্বা বের হয়ে থাকা ইত্যাদি।
এগুলো শিশুর সম্মিলিতভাবে ডাউন সিনড্রোমের লক্ষণ। এ ছাড়া শিশুগুলো খুব নরম তুলতুলে হয়। মাংসপেশীর শৈথিল্যের কারণে শরীরটাও একটু ফোলা ফোলা হয়, মুখমণ্ডল ও গলা ছোট হয়, থুতনিও সেভাবে বোঝা যায় না। ১৮৩৮ সালে Jean-Étienne Dominique Esquirol এবং ১৮৪৪ সালে Édouard Séguin এই রোগ সম্পর্কে অল্পবিস্তর বর্ণনা দিয়েছিলেন। তবে ১৮৬৬ সালে ব্রিটিশ নিউরোলজিস্ট জন ল্যাংডন ডাউন সর্বপ্রথম বিষয়টি সবিস্তারে বর্ণনা করেন৷ তাই তার নামানুসারে এ সামগ্রিক সমস্যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ডাউন সিনড্রোম’৷
বেশি বয়সে মা হলে বিশেষ করে ৩৫ বছর বয়সের পরে সন্তান নিলে সেই সন্তানের মধ্যে এমন বৈশিষ্ট্য থাকতে পারে। অন্যদিকে কোনো মায়ের আগে এমন বৈশিষ্ট্যের সন্তান থাকলে পরবর্তী সন্তানও এরকম ডাউন শিশু হতে পারে। পরিবেশদূষণ, তেজস্ক্রিয়তা ইত্যাদি কারণেও ডাউন শিশুর জন্ম হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। অন্য শিশুর চেয়ে ডাউন শিশুরা শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে বিলম্ব দেখা যায়। অর্থাৎ শারীরিক ও মানসিকভাবে বেড়ে ওঠার মাইলফলকগুলো যেমন বসতে শেখা, দাঁড়াতে শেখা, হাঁটতে শেখা, কথা বলতে শেখা- এসব দেরিতে ঘটে।
এ শিশুর জন্মগত হৃদরোগ, ত্রুটিযুক্ত খাদ্যনালী, দৃষ্টিশক্তি ও শ্রবণশক্তির সমস্যা, ঘনঘন শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ, থাইরয়েড গ্রন্থির অকর্মণ্যতা ইত্যাদিও হতে পারে। টেস্টিকুলার ক্যান্সার ও লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। এ ছাড়া দাঁতে সংক্রমণ বা দাঁত পড়ে যাওয়া এবং অ্যানেটশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাকটিভিটি হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। একটা সময় পর এসব শিশুদের দেখা দেয় অ্যালঝাইমার’স রোগের উপসর্গ। ডাউন শিশু যে পরিবারে জন্ম নেয়, সেই পরিবারকেও নানারকম সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও হেনস্থার মধ্যদিয়ে যেতে হয়।
দুঃখের বিষয়, ডাউন সিনড্রোমের কোনো নির্দিষ্ট চিকিৎসা কিংবা প্রতিরোধের উপায় কোনোটাই নেই। জন্মের পর কোনো জটিলতা দেখা দিলে সে অনুযায়ী তার চিকিৎসা করতে হয়। তবে আগে থেকেই রোগ শনাক্ত করা সম্ভব হলে জটিলতা কম হয়। শিশুর শরীরে ক্রোমোজম সংখ্যা বা ক্যারিওটাইপিং পরীক্ষার মাধ্যমে ডাউন সিনড্রোম নিশ্চিত হওয়া যায়। গর্ভাবস্থার ১১ থেকে ১৪ সপ্তাহের মধ্যে প্রাথমিক গর্ভফুল হতে কোষকলা সংগ্রহের মাধ্যমে অথবা গর্ভকালীন ১৫ থেকে ১৮ সপ্তাহের মধ্যে গর্ভের শিশুর চারপাশের অ্যামনিওটিক তরলের ডিএনএ পরীক্ষা করে গর্ভের বাচ্চাটি ডাউন শিশু কি না- তা নিশ্চিত করা যায়। তারপর বাবা-মা গর্ভাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
সঠিক সময়ে লক্ষণগুলো চিহ্নিত করে সঠিক পরিচর্যা, পুষ্টিকর খাবার, স্পিচ, ল্যাঙ্গুয়েজ ও ফিজিক্যাল থেরাপি দিলে ডাউন শিশুরা অন্য স্বাভাবিক শিশুর মতোই পড়ালেখা করে কর্মক্ষম বা স্বনির্ভর হতে পারে। অথবা প্রয়োজনীয় পরিচর্যায় শারীরিক সমস্যাগুলো কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। বাংলাদেশে ডাউন সিনড্রোমে ভুগতে থাকা ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়ার উদ্দেশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে ২০১৬ সালে গঠিত হয় বাংলাদেশ ডাউন সিনড্রোম সোসাইটি। সরকারি বিভিন্ন প্রকল্প ছাড়াও ব্যক্তিগত বা প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায় থেকে সবাই যদি সচেতনতা সৃষ্টি করতে এগিয়ে আসে, তবেই আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি সুস্থ ও সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরি হবে।
ডাউন শিশুদের প্রতি আমাদের মমতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তারা সমাজের বোঝা নয়। পর্যাপ্ত যত্ন এবং সহযোগিতাই পারে তাদের সমাজের সম্পদ হিসাবে গড়ে তুলতে।
এসইউ/এমএস