বেশি আমিষ খেয়ে ফেলছেন কি

মোটাদাগে আমরা বাঙালি আমিষাশী, অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ মাছ-মাংস, ডিম-দুধ খাই। শুধু খাই না, এগুলো আমরা বেশ পছন্দও করি। অনেকে আবার প্রতি বেলায় একাধিক পদের আমিষ খান। অনেকের মধ্যে ধারণা আছে যে ভাত-রুটি কম খেতে হবে, আর প্রোটিন যেহেতু ভালো জিনিস তাই এটি ইচ্ছামতো খাওয়া যাবে। তবে কোনো কিছুই আসলে মাত্রাতিরিক্ত ভালো না। আমিষের মতো পুষ্টিকর খাবারও না।
প্রোটিন আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি শারীরিক বৃদ্ধি, টিস্যু মেরামত এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করে। তবে প্রোটিনের পরিমাণ ও উৎস স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী সঠিকভাবে নির্বাচন করা জরুরি।
প্রোটিন কী করে?
প্রোটিন অ্যামিনো এসিড দ্বারা গঠিত, যা আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য। এর প্রধান কাজগুলো হলো-
পেশি গঠন ও মেরামত: ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের পর পেশির টিস্যু মেরামত করতে প্রোটিন প্রয়োজন।
এনজাইম ও হরমোন উৎপাদন: বিপাকক্রিয়া, হজমশক্তি এবং বিভিন্ন শারীরিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করা।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: অ্যান্টিবডি তৈরি করে সংক্রমণ ও রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করা।
শক্তি সরবরাহ: কার্বোহাইড্রেট ও ফ্যাটের অনুপস্থিতিতে প্রোটিন শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে।
যেসব খাবারে প্রোটিন থাকে-
প্রাণীজ প্রোটিন: ডিম, মাছ, মাংস, দুধ, দই, পনির ইত্যাদি।
উদ্ভিজ্জ প্রোটিন: ডাল, বাদাম, সয়াবিন, ছোলা, কিনোয়া, মসুর ডাল ইত্যাদি।
হিউম্যান এইড বাংলাদেশ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি, ডা: শেখ মইনুল খোকন বলেন, ‘প্রোটিনের উৎসের মধ্যে বৈচিত্র আছে। যেমন ডিমে আছে ছয় গ্রাম প্রোটিন, এক ছটাক মাছ বা মুরগির মাংসে থাকে ১২ গ্রাম প্রোটিন। মুগডালে থাকে প্রায় ১৮ গ্রাম প্রোটিন। এগুলো হিসেব করে খেতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, প্রাপ্তবয়স্ক একজন মানুষের শরীরের ওজন অনুযায়ী কেজি প্রতি দৈনিক ০.৮ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, ৬০ কেজি ওজনের একজন মানুষের দিনে ৪৮ গ্রাম প্রোটিন প্রয়োজন।
বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যায় প্রোটিন গ্রহণের নির্দেশিকা
১. কিডনি রোগী: ডা: শেখ মইনুল খোকন বিশেষভাবে সতর্ক করে বলেন, ‘কিডনিজনিত সমস্যা যাদের আছে, তাদের কোনোভাবেই ০.৬ থেকে ০.৮ গ্রাম পার কেজি বডি ওয়েটের বেশি প্রোটিন খাওয়া উচিত না। ধরেন একজন ৬০ কেজি ওজনের সুস্থ মানুষকে দিনে ন্যূনতম ৬০ গ্রাম প্রোটিন খেতে হয়। কিন্তু কারো কিডনির সমস্যা থাকলে তার হিসেবটা আলাদা। তার ০.৮-০.৬ গ্রাম পার কেজি বডি ওয়েটের সমান প্রোটিন খেতে হবে। শরীরের ওজন ৬০ কেজি হলে তারা খাবেন ৩৬-৪৮ গ্রাম প্রোটিন।’
দুধ সম্পর্কে ডা: শেখ মইনুল খোকন বলেন, ‘কিডনির সমস্যা থাকলে এক কাপ দুধ খেতে পারবেন, তবে সে দুধটি বেশি ঘন হওয়া যাবেনা। অনেকেই বেশি জ্বাল দিয়ে দুধ ঘন করে এক গ্লাসকে এক কাপে পরিণত করেন, তা করা যাবেনা। স্বাভাবিক ঘনত্বের দুধ এক কাপ খাবেন। বরং কিছুটা পানি মিশিয়ে দুধ পতলা করে নিলে আরও ভালো হয়। কারণ দুধে বেশ ভালো পরিমাণের প্রোটিন থাকে।’
২. ডায়াবেটিস রোগী: ডায়াবেটিকদের জন্য উচ্চ ফাইবারযুক্ত প্রোটিন যেমন ডাল, বাদাম, মাছ খাওয়া ভালো। রেড মিট ও প্রক্রিয়াজাত মাংস এড়িয়ে চলুন, কারণ এগুলো ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়াতে পারে।
৩. হৃদরোগী: চর্বিহীন প্রোটিন যেমন মাছ, সয়াবিন, বিনস খেতে পারেন। রেড মিট ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন, এগুলো কোলেস্টেরল বাড়ায়।
৪. আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) রোগী:
ডা: শেখ মইনুল খোকনের মতে, যাদের আইবিএস (ইরিটেবল বাওয়েল সিন্ড্রোম) আছে তাদের রোজার সময় দুধ জাতীয় খাবার কম খাওয়া উচিত।
৫. স্থূলতা: প্রোটিন পেট ভরা রাখে এবং মেটাবলিজম বাড়ায়। গ্রিলড চিকেন, পনির, ডাল এবং লো-ফ্যাট দুগ্ধজাত খাবার বেছে নিন।
অত্যধিক প্রোটিন খাওয়ার ঝুঁকি
প্রোটিন শরীরের জন্য ভালো হলেও অতিরিক্ত প্রোটিন ক্ষতিকর হতে পারে। অতিরিক্ত প্রোটিন কিডনির উপর চাপ তৈরি করে। কিডনিকে অতিরিক্ত বর্জ্য নিষ্কাশন করতে হয়, যা দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতি করতে পারে। অত্যধিক প্রোটিন ক্যালসিয়াম নিঃসরণ বাড়িয়ে হাড় দুর্বল করতে পারে। প্রোটিন ক্যালোরি সমৃদ্ধ, অতিরিক্ত খেলে ওজন বাড়তে পারে। প্রোটিন বিপাকের জন্য বেশি পানি প্রয়োজন, যা পানিশূন্যতা তৈরি করতে পারে।
ডা: খোকন ইফতারের সময় প্রোটিন গ্রহণ সম্পর্কে বলেন, ‘প্রথাগতভাবে আমরা ইফতারে ভারী খাবার খেয়ে থাকি। যেমন পুরান ঢাকার মানুষ প্রোটিন ও মাংস জাতীয় খাবার বেশি খান। এক্ষেত্রে একটু রেস্ট্রিকশনের বিষয় আছে।"
প্রোটিনের চাহিদা বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক পরিশ্রম এবং স্বাস্থ্যের অবস্থা অনুযায়ী পরিবর্তিত হয়। তাই গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা থাকলে পুষ্টিবিদ বা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে ডায়েট চার্ট তৈরি করে নিন। সুষম খাদ্য গ্রহণ করুন, কারণ প্রোটিনের পাশাপাশি কার্বোহাইড্রেট, ফাইবার ও স্বাস্থ্যকর ফ্যাটও প্রয়োজন।
প্রোটিন আমাদের শরীরের জন্য অপরিহার্য, তবে এর পরিমাণ ও উৎস সঠিকভাবে বাছাই করা জরুরি। বিশেষ করে কিডনি, হৃদরোগ বা হজম সংক্রান্ত সমস্যা থাকলে প্রোটিন গ্রহণের ক্ষেত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত।
এএমপি/জেআইএম