কোটা আন্দোলন থেকে সরকার পতন, যেমন ছিল আদালত অঙ্গন
সময়ের পরিক্রমায় বিদায় নিচ্ছে ২০২৪ সাল। তবে বছরজুড়েই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল দেশের সর্বোচ্চ আইন অঙ্গন। যেখানে বছরের সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের রায়। হাইকোর্টের সেই রায়ের পর শুরু হয় সংক্ষিপ্ত আকারে কোটাবিরোধী আন্দোলন। শিক্ষার্থীদের সেই আন্দোলন ঘিরে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এরপর সরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের চাকরির সব গ্রেডে মেধার ভিত্তিতে ৯৩ শতাংশ ও কোটায় ৭ শতাংশ নিয়োগের রায় দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
কিন্তু কোটাবিরোধী আন্দোলন এক পর্যায়ে সরকার পতনের এক দফায় রূপ নেয়। যার চূড়ান্ত পর্বে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গণআন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ৮ আগস্ট গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর গত সাড়ে চার মাসে বিভিন্ন সময় এ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের আকার ও দপ্তরে পরিবর্তন বা রদবদল আসে।
সরকার পতনের পর আদালতপাড়ায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে প্রধান বিচারপতি ও অ্যাটর্নি জেনারেলসহ আরও অনেক পদে। ঢেলে সাজানো হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত বিষয় ছিল সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা। এছাড়া বিগত সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও প্রশাসনের লোকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি-অর্থপাচারের মতো অভিযোগগুলো প্রকাশ্যে আসতে থাকে। এ নিয়েও গত কয়েক মাস বেশ সরব ছিল আদালত অঙ্গন।
সরকার পতনের পর ইতিহাস পাল্টে হাইকোর্ট থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগসহ সুপ্রিম কোর্টে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি হয়। এরপর সর্বোচ্চ আদালত থেকে আসে বেশ কিছু আলোচিত রায় ও আদেশ। যার মধ্যে বাতিল হওয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, বিচারপতির অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়া, সংবিধান সংশোধন ও বিচার বিভাগ সংস্কারের পদক্ষেপ সবচেয়ে বেশি আলোচিত।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গণআন্দোলনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ৮ আগস্ট গঠিত হয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার
সরকার পতনের পরই প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের ছয় বিচারপতি পদত্যাগ করেন। ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সুপ্রিম জুডিসিয়াল পুনর্বহালের রায়, ১৫ আগস্টের সরকারি ছুটি সংক্রান্ত অধ্যাদশে বাতিল, বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত ও খালাসের আদেশ, বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাসের রায়সহ আলোচিত অনেক রায় ও আদেশ চলতি বছরে এসেছে উচ্চ আদালত থেকে।
আরও পড়ুন
- সরকারি চাকরিতে ৯৩ শতাংশ নিয়োগ মেধার ভিত্তিতে
যেভাবে বাতিল হয়েছিল কোটা
অবরোধ তুলে ফের ‘বাংলা ব্লকেডের’ ডাক
বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে এজলাস কক্ষে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয় এবং পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় দেশের বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগে এ বছরই উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি।
কোটা পুনর্বহাল, হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়
কোটা সংস্কার আন্দোলনের মুখে সরকারি চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত) কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। পরিপত্র চ্যালেঞ্জ করে বৈধতা নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্ম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের সভাপতি অহিদুল ইসলাম তুষারসহ সাতজন।
চূড়ান্ত শুনানি শেষে হাইকোর্ট নির্দেশনাসহ এই পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে গত ৫ জুন রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত) ক্ষেত্রে কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। এরপর আপিল বিভাগে আবেদন করেন ঢাবির দুই শিক্ষার্থী। ওই আপিল তড়িঘড়ি করে শুনানি করেও শেষরক্ষা হয়নি।
রায়ে বলা হয়, ২০১২ সালে করা এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া রায় ও আদেশ, ২০১৩ সালের লিভ টু আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগে তা বহাল ও সংশোধিত আদেশ এবং ২০১১ সালের ১৬ জানুয়ারির অফিস আদেশের (মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনির কোটা) আলোকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান/নাতি-নাতনিদের জন্য কোটা পুনর্বহাল করতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়া হলো। একই সঙ্গে জেলা, নারী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, উপজাতি-ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটাসহ, যদি অন্যান্য থাকে, কোটা বজায় রাখতে নির্দেশ দেওয়া হলো। ওই রায়কে কেন্দ্র করে কোটাবিরোধী আন্দোলনে ফের প্রকম্পিত হয় রাজপথ। ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে একপর্যায়ে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
সুপ্রিম কোর্টের মতামতে অন্তর্বর্তী সরকার ও প্রধান উপদেষ্টা
বছরের শুরুটা খুব বেশি ভালো না কাটলেও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ও বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে ঠুনকো অভিযোগে শ্রম আদালতের রায়ে দণ্ড দেওয়া হয়। সেই দণ্ড থেকে খালাস দিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের (রেফারেন্স) মতামতের পরিপ্রেক্ষিতে তাকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা করা হয়। যদিও বিচার প্রক্রিয়া ও সাক্ষীদের বিষয়টি প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছেন কূটনীতিকসহ অনেক বিদেশি। এরপর তার মামলাগুলো পর্যায়ক্রমে রায় ও আদেশের মাধ্যমে চূড়ান্ত নিষ্পত্তি করা হয়েছে।
‘জুডিসিয়ারি ক্যু’র চেষ্টা ও ছয় বিচারপতির পদত্যাগ
সরকার পতনের পরপরই সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগের সব বিচারপতির অংশগ্রহণে ফুলকোর্ট সভা ডেকেছিলেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। পরে তা স্থগিত ঘোষণা করেন তিনি। প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সকাল থেকে সুপ্রিম কোর্টের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক রহমানসহ সব আসামিকে খালাসের রায়, জিয়া অরফানেজ ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত এবং খালাসের আদেশ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাস
১০ আগস্ট এই ফুলকোর্ট সভা ডাকাকে ‘জুডিসিয়ারি ক্যু’ সন্দেহ করে হাইকোর্ট ঘেরাওয়ের কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরে মিছিল নিয়ে আদালত প্রাঙ্গণে জড়ো হয়ে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের বিচারপতিদের পদত্যাগের আলটিমেটাম দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘পদত্যাগ না করলে আমরা প্রধান বিচারপতিসহ দলবাজ বিচারপতিদের বাসভবন ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করবো।’ এরপর প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেন।
ওইদিনই (১০ আগস্ট) সন্ধ্যায় আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর পদত্যাগপত্র জমা দেন তারা। পদত্যাগ করা পাঁচ বিচারপতি হলেন বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম, বিচারপতি আবু জাফর সিদ্দিকী, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. শাহিনুর ইসলাম ও বিচারপতি কাশেফা হোসেন। এর আগে ১০ আগস্ট বিকেলে পদত্যাগ করেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান।
হাইকোর্ট বিভাগ থেকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ
গত ১০ আগস্ট ওবায়দুল হাসানের পদত্যাগের পর কে হবেন প্রধান বিচারপতি, তা নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে। তখন আপিল বিভাগে মাত্র একজন বিচারপতি অবশিষ্ট ছিলেন। তিনি হলেন বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম। তবে ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তিনিই প্রথম বিচারপতি যিনি হাইকোর্ট বিভাগ থেকে সরাসরি প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান।
যদিও ১০ আগস্ট বিকেলে গুঞ্জন ওঠে, ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি হচ্ছেন বিচারপতি আশফাকুল ইসলাম। মুহূর্তের মধ্যে সেই খবর ছড়িয়ে পড়ে। তখন রাজপথ থেকে দাবি ওঠে, ছাত্র-জনতা প্রধান বিচারপতি হিসেবে বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে চান। অন্য কোনো বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হলে তা মেনে নেওয়া হবে না—বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা এমন ঘোষণা দেন। ১০ আগস্ট রাতেই বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদকে দেশের ২৫তম প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
বিচারপতিদের চায়ের দাওয়াত ও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল গঠন
গত ১৬ অক্টোবর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল আজিজ আহমদ ভূঞা জানিয়েছিলেন, ১২ জন বিচারপতিকে বেঞ্চ না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। এই বিচারপতিদের তখন ছুটিতে পাঠিয়েছিলেন প্রধান বিচারপতি এবং তারপর থেকে তাদের বিচারকার্য পরিচালনা থেকে বিরত রাখা হয়েছে। এরমধ্যে একজন অবসরে চলে গেছেন, রয়েছেন ১১ জন।
২০ অক্টোবর আপিল বিভাগ বিচারপতি অপসারণে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল পুনরুজ্জীবিত করে রায় দেন। এসব কারণে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই ১২ জন বিচারপতির বিষয়েই তদন্ত সম্পন্ন করেছে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিল।
আজিজ আহমদ ভূঞা বলেন, আমাদের হাইকোর্টে কিছু বিচারক আছেন। ওনাদের ব্যাপারে সমাজের বিভিন্ন স্তরে প্রচুর কমপ্লেইন রয়েছে যে, ওনারা জুলাই-আগস্টের গণবিপ্লবে যে পতিত ফ্যাসিস্ট শক্তি ছিল, সেই শক্তির একটা নিপীড়ক যন্ত্রে পরিণত হয়েছিল। তাছাড়া কারও কারও বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আছে। ছাত্র-জনতার অনেকের এ ব্যাপারে ক্ষোভ রয়েছে।
তিনি বলেন, এসব ক্ষোভ সাংবিধানিকভাবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে নিষ্পত্তির একটা অ্যাভিনিউ খুলে গেছে। এরপরও উচ্চ আদালত স্বাধীন। উচ্চ আদালত তার মতো করেই ব্যবস্থা নেবেন।
হাইকোর্ট বিভাগে ২৩ বিচারপতি নিয়োগ
সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ থেকে ১২ জন বিচারপতিকে ছুটি দেওয়ার পর সেখানে ২৩ জনকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন রাষ্ট্রপতি। ৮ অক্টোবর নিয়োগ পাওয়া বিচারপতিরা হলেন- মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদার, সৈয়দ এনায়েত হোসেন, মো. মনসুর আলম, সৈয়দ জাহেদ মনসুর, কে এম রাশেদুজ্জামান রাজা, মো. যাবিদ হোসেন, মুবিনা আসাফ, কাজী ওয়ালিউল ইসলাম, আইনুন নাহার সিদ্দিকা, মো. আবদুল মান্নান, তামান্না রহমান, মো. শফিউল আলম মাহমুদ, মো. হামিদুর রহমান, নাসরিন আক্তার, সাথিকা হোসেন, সৈয়দ মোহাম্মদ তাজরুল হোসেন, মো. তৌফিক ইনাম, ইউসুফ আব্দুল্লাহ সুমন, শেখ তাহসিন আলী, ফয়েজ আহমেদ, মো. সগীর হোসেন, শিকদার মাহমুদুর রাজী ও দেবাশীষ রায় চৌধুরী।
১৫ আগস্ট সরকারি ছুটি বাতিল
১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে স্থগিতাদেশ দেন আপিল বিভাগ। হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সরকারের করা লিভ টু আপিল আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
৫১ বিচারকের বিরুদ্ধে তদন্ত চেয়ে করা রিট খারিজ
গত ১০ ডিসেম্বর অধস্তন আদালতের অর্ধশত বিচারক-কর্মকর্তার ‘অবিশ্বাস্য সম্পদ’ বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত অভিযোগ তদন্তের নির্দেশনা চেয়ে করা রিট সরাসরি খারিজ করেন হাইকোর্ট। ‘অবিশ্বাস্য সম্পদ অর্ধশত বিচারক-কর্মকর্তার’ শিরোনামে গত ১৪ অক্টোবর একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে রিট করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আমিমুল এহসান জুবায়ের। সে রিটের শুনানি শেষে রিটটি (সামারিলি রিজেক্ট) করে আদেশ দেন বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল সংক্রান্ত বিধান অবৈধ
১৭ ডিসেম্বর বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে আনেন উচ্চ আদালত। তবে, পঞ্চদশ সংশোধনীর পুরোটা বাতিল করা হয়নি এ রায়ে।
আরও পড়ুন
- নতুন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ
পদত্যাগ করেছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান
ভোটার হওয়ার বয়স ১৭ করার পক্ষে ড. ইউনূস
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পঞ্চদশ সংশোধনীর বিধানের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্ত করার ফলে তিনটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে) নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অনুপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত হয়, যা জনগণের আস্থার প্রতিফলন ঘটাতে ব্যর্থ হয়েছে। সর্বশেষ দেশে গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। এতে হাজারো মানুষের আত্মদান, হাজারো মানুষ স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বিগত সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয় সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে আপিল বিভাগের রেফারেন্সের ভিত্তিতে এবং জনগণের অভিপ্রায়ে। এখন জাতির প্রত্যাশা, এমন একটি পদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করা, যেটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, নতুন গণতন্ত্র, নতুন স্বাধীনতা ও নতুন বাংলাদেশ কার্যকরভাবে নিশ্চিত করবে।
বিদায়ী বছরে উচ্চ আদালতের একজন বিচারপতিকে লক্ষ্য করে এজলাস কক্ষে ডিম ছুড়ে মারার ঘটনাও ঘটে, যা নিয়ে ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি হয় এবং পরে প্রধান বিচারপতির নির্দেশনায় দেশের বিচারাঙ্গনের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। শেখ হাসিনা সরকারের সহযোগী হিসেবে কাজ করার অভিযোগে এ বছরই উচ্চ আদালতের ১২ বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠান প্রধান বিচারপতি
পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা বাতিল ঘোষণা করে রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত আরও বলেন, ধারা দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো ধ্বংস করেছে। সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের পর ৭ক ও ৭খ অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যা পরিষ্কারভাবে সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যেখানে জনগণের ইচ্ছা, সংবিধানের শ্রেষ্ঠত্বসহ স্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। ৭ক ও ৭খ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করা হলো।
টাকা ছিনতাই ও আইফোন লুটের মামলা
সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে ভোট গণনাকে কেন্দ্র করে হট্টগোল, হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনায় গত ৮ মার্চ রাতে হত্যাচেষ্টা মামলা হয়। এতে আইনজীবী নাহিদ সুলতানা যুথিসহ ২০ জনকে আসামি করা হয়। সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সাইফুর রহমান সিদ্দিকী সাইফ তাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় এ মামলা করেন। মামলায় ২০ জন আসামির মধ্যে বিএনপি সমর্থিত প্যানেলের সম্পাদক প্রার্থী রুহুল কুদ্দুসও ছিলেন।
নাহিদ সুলতানা যুথি যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের স্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের সদস্য সচিব ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের ভাবি। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ৪০ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় ভোট গণনা ছাড়াই জোর করে সম্পাদক পদের ফলাফল ঘোষণা, একটি আইফোন, পকেট থেকে ১৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেওয়া এবং রড, লাঠি ও চেয়ার দিয়ে হামলার অভিযোগ করা হয়।
এ মামলার পর ওই রাতেই বিএনপিপন্থি আইনজীবী ব্যারিস্টার ওসমান চৌধুরীকে গ্রেফতার করে পুলিশ। ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজলও গ্রেফতার হন।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বাবরসহ ৭ আসামির খালাস
বিদায়ী বছরে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সাত আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। এছাড়া উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার সাজা কমিয়ে মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়। গত ১৮ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এ রায় ঘোষণা করেন।
এ মামলায় খালাস পাওয়া অন্য আসামিরা হলেন—এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) এ কে এম এনামুল হক, জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী (অন্য মামলায় ফাঁসি কার্যকর), সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমীন, এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম মারা যাওয়ায় তার ক্ষেত্রে মামলা অকার্যকর ঘোষণা করেন আদালত। তবে, তার ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বহাল রাখা হয়। ১০ বছরের সাজাপ্রাপ্তরা হলেন—আকবর হোসেন, লিয়াকত, সাহাবুদ্দিন, হাফিজ, মঈনুদ্দিন ও হাজি আব্দুস সোবহান।
গ্রেনেড হামলা মামলায় তারেক-বাবরসহ সব আসামির খালাস
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলা মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইকোর্ট বলেন, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার ছিল অবৈধ। আইনে এটি টেকে না। যে চার্জশিটের ভিত্তিতে নিম্ন আদালত বিচার করেছিলেন তা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না।
বহুল আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে গত ১ ডিসেম্বর হাইকোর্ট এ রায় দেন। বিচারিক আদালত এ মামলায় ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ১১ পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছিলেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় খালেদার সাজা স্থগিত
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ১০ বছরের সাজার বিরুদ্ধে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার লিভ টু আপিল (আপিলের অনুমতি চেয়ে করা আবেদন) মঞ্জুর করে গত ১১ নভেম্বর আদেশ দেন আপিল বিভাগ। একই সঙ্গে খালেদা জিয়াকে দেওয়া ১০ বছরের সাজাও স্থগিত করেন আদালত। আপিল শুনানি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত স্থগিত থাকবে সাজা। পাশাপাশি আপিলের সারসংক্ষেপ দুই সপ্তাহের মধ্যে দাখিল করতে নির্দেশ দেন সর্বোচ্চ আদালত। আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় খালেদার খালাস
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের দণ্ড থেকে গত ২৭ নভেম্বর খালাসের রায় দেন হাইকোর্ট। সাজার বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার আপিল মঞ্জুর করে ওইদিন হাইকোর্ট এ রায় দেন। এ মামলায় সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গত ২০ নভেম্বর আপিল শুনানি শুরু হয়। ৩ নভেম্বর এ মামলায় খালেদা জিয়ার সাজার বিরুদ্ধে আপিল শুনানির জন্য নিজ খরচে পেপারবুক তৈরির অনুমতি দেন হাইকোর্ট।
এফএইচ/এমকেআর/জেআইএম