আমি কখনো আয়নাঘরে চাকরি করিনি: জিয়াউল আহসান
গণহত্যার এক মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় আসামিদের মুখে চিন্তার ভাঁজ দেখা গেছে, কারও চোখের পানি গড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু কাঠগড়ায় বেশ খোশমেজাজে ছিলেন ‘আয়নাঘরের’ কারিগরখ্যাত বরখাস্ত মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান।
হাসিনা সরকারের পতনের পর সেনাবাহিনীর পদ থেকে অব্যাহতি পাওয়া এই মেজর জেনারেল ছিলেন ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টারের (এনটিএমসি) মহাপরিচালক।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যার অভিযোগে বুধবার (২০ নভেম্বর) জিয়াউল আহসান, পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ আট আসামিকে হাজির করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে।
আট আসামির মধ্যে জিয়াউল আহসান ছাড়া সবাই পুলিশের সাবেক কর্মকর্তা। এদিন ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় যখন তোলা হচ্ছিল এই আট আসামিকে তখন সবার মুখে ছিল চিন্তার ছাপ। কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে কান্না করেছেন গুলশান থানার সাবেক ওসি মাজহারুল হক। তবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েও বেশ হাশিখুশি দেখা গেছে জিয়াউল আহসানকে।
এদিন সোয়া এক ঘণ্টার বেশি সময় ধরে শুনানি চলে। কাঠগড়ায় প্রবেশ থেকে বের হওয়া পর্যন্ত পুরোটা সময় জিয়াউল আহসান ছিলেন হাশিখুশি।
ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বিচারকের সামনে এবং প্রিজনভ্যানে করে কারাগারে যাওয়ার আগে সেনাবাহিনীর সাবেক এই কর্মকর্তা চিৎকার করে বলেন, ‘আমি কখনো আয়নাঘরে চাকরি করিনি। আমার নামে ফেসবুকে মিথ্যা প্রপাগান্ডা ছড়ানো হচ্ছে। আমি যেখানে কাজ করেছি, সেটা সম্পূর্ণ টেকনিক্যাল ছিল।’
কাঠগড়ায় ওঠানোর পর থেকে অন্যরা যখন চিন্তিত, অনেকে আবার দুশ্চিন্তায় ঠোঁট নাড়িয়ে দোয়া পড়েছেন। সেখানে জিয়াউল আহসান আশপাশে থাকা লোকজন ও সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে চোখে চোখ রেখে ইশারায় খোঁজখবর নেন ও কথা বলতে চান। মাঝেমধ্যে চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে চারদিকে থাকা সবাইকে ভালোমতো পর্যবেক্ষণ করেন।
শুনানির শুরুতে আইনজীবী নাজনীন আহসান দাঁড়ান জিয়াউল আহসানের পক্ষে। আইনজীবী নাজনীন জিয়াউল আহসানের আপন বোন। এজলাসের মধ্যে ওকালতনামায় জিয়াউল আহসানকে স্বাক্ষর করানোর জন্য আইনজীবী নাজনীন আদালতের অনুমতি চান।
ওকালতনামায় সই করাতে হলে আদালতে আসার আগে প্রশাসনের মাধ্যমে করাতে হয়, এমন প্রশ্ন তুলে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম। পরে আদালত অনুমতি দিলে জিয়াউল আহসানের স্বাক্ষর নেওয়া হয়।
এরপর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতের সামনে সাবেক আট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে, সেসব ঘটনার পটভূমি তুলে ধরেন।
প্রথমে চিফ প্রসিকিউটর পুলিশের সাবেক আইজিপি আবদুল্লাহ আল-মামুনের ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন। এরপর ‘সার্বিয়ান কসাই’ কারাদজিচের সঙ্গে জিয়াউল আহসানের তুলনা করে তার ওপর আনা অভিযোগগুলো আদালতের সামনে তুলে ধরেন তিনি।
- আরও পড়ুন
- জিয়াউল আহসানকে ‘বসনিয়ার কসাই’ কারাদজিচের সঙ্গে তুলনা
- কাঁদলেন গুলশানের সাবেক ওসি, বললেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ছিলেন
তাজুল ইসলাম বলেন, সার্বিয়ান কসাই কারাদজিচের সঙ্গে জিয়াউল আহসানের তুলনা করলে কম হবে। আয়নাঘর বানানোর পেছনে তার ভূমিকা ছিল। পাশাপাশি দেশে যত কলরেকর্ড ফাঁস হতো তার পেছনে জিয়াউল আহসানের হাত থাকতো। একই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এনটিএমসির সবার ওপর আঁড়িপাতার যে টেকনোলজি ছিল, তা বাংলাদেশে প্রথম আনেন তিনি।
চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, জিয়াউল আহসানের বিরুদ্ধে গুম-খুনের অভিযোগ আছে। বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীসহ আরও অনেক গুম-খুনের পেছনে তার হাত ছিল। তিনি এনটিএমসির মাধ্যমে আওয়ামী লীগের বিরোধীদের নজরদারি করতেন। জুলাই আন্দোলনে ইন্টারনেট বন্ধের পেছনেও তার হাত ছিল।
এদিন জিয়াউল আহসানসহ আট আসামিকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে আগামী ১৯ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়াসহ আসামিদের আদালতে হাজির করার নির্দেশ দেওয়া হয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এ আদেশ দেন। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া আসামিরা হলেন- সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি আবুল হাসান, এনটিএমসির সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান, ঢাকা জেলা সাবেক পুলিশ সুপার মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি, মিরপুরের সাবেক ডিসি মো. জসিম উদ্দিন মোল্লা, সাবেক অতিরিক্ত সুপার (সাভার সার্কেল) মো. শাহিদুল ইসলাম, গুলশান থানার সাবেক ওসি মো. মাজহারুল হক ও ঢাকা উত্তর ডিবির সাবেক পরিদর্শক মো. আরাফাত হোসেন।
এফএইচ/বিএ/এএসএম