ধর্ষণের দায়ে যাবজ্জীবন, বহন করতে হবে শিশুর ভরণ-পোষণ: হাইকোর্ট

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৫০ এএম, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিয়ের আশ্বাসে একাধিকবার ধর্ষণ। কিন্তু ভিকটিমের পেটে সন্তান আসার পর অস্বীকার। এমন পরিস্থিতিতে ভিকটিম আইনের দ্বারস্থ হলেন। এর মধ্যে সন্তানেরও জন্ম দিলেন ভিকটিম। বিচার শেষে বিচারিক আদালত আসামিকে খালাস দিলেন। কিন্তু আসামিকে ছাড় দেননি হাইকোর্ট বিভাগ। দিয়েছেন যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড। পাশাপাশি জন্ম নেওয়া শিশুর ভরণ-পোষণের ভারও নেওয়ার কথা বলেছেন।

শিশুটি তার বাবা বা মা, কিংবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকারী হবে। আর শিশুটি মাতৃকুলের পরিবারে থাকতে পারবে বলেও রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি হাইকোর্টের দেওয়া এই রায়ের অনুলিপি সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন তৎকালীন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল শরীফুজ্জামান মজুমদার। আবেদনকারী ভিকটিমের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আমিনুল ইসলাম। আসামি পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মো. আক্তার হোসেন ও সৈয়দ আলতাফ হোসেন।

রাষ্ট্রপক্ষ এজাহার থেকে জানায়, বিয়ের কথা বলে ভিকটিমকে হবিগঞ্জের চুনারুঘাটের টিলাগাঁও এলাকার ছিদ্দিক আলীর ছেলে কাছুম আলী একাধিকবার ধর্ষণ করেন। ২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ সেন্ট্রাল হসপিটাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করান তিনি। এতে গর্ভে সন্তান থাকার বিষয়টি নিশ্চিত হন। গর্ভধারণের পর কাছুম আলী তাকে বিয়ে করতে অস্বীকার করেন। এরপর ২০০৬ সালের শুরুতে কাছুম আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। এর মধ্যে ভিকটিম একটি সন্তানের জন্ম দেন।

ওই মামলার চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০২১ সালের ২০ জানুয়ারি হবিগঞ্জের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২ এর বিচারক জিয়া উদ্দিন মাহমুদ আসামিকে খালাস দেন। এ রায় বাতিল চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করেন ভিকটিম। ওই আবেদনের পর হাইকোর্ট রুল জারি করেন। ২৭ ফেব্রুয়ারি সেই রুল মঞ্জুর করেন বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি ফাহমিদা কাদেরের হাইকোর্ট বেঞ্চ।

রাষ্ট্রপক্ষ জানায়, আসামিপক্ষ স্থানীয়ভাবে আপসের কথা বলে। এরপর অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ না হওয়ার কথা বলে হবিগঞ্জের নারী ও শিশু দমন ট্রাইব্যুনাল-২ আসামিকে খালাস দেন। সেই রায়ের বিরুদ্ধে ভিকটিম হাইকোর্টে ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৬১ এ ধারায় আবেদন করেন। হাইকোর্ট ২০২১ সালের ৩০ মে রুল জারি করেন এবং নিম্ন আদালতের নথি তলব করেন। হাইকোর্ট রুল শুনানি শেষে বিচারিক আদালতের রায় বাতিল এবং আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। পাশাপাশি এক লাখ টাকা জরিমানা অনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দেন। আর ভিকটিমের সন্তানের লালন-পালন করার বিষয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ১৩ ধারা মোতাবেক নির্দেশনা দিয়েছেন।

রায়ে আদালত বলেন, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের রায় রদ ও রহিত করা হলো। এক থেকে চার নম্বর সাক্ষীর আলোকে অভিযুক্ত কাছুম আলীর বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় তাকে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ৯(১) ধারায় তাকে দোষী-সাব্যস্ত করা হলো এবং তাকে সশ্রম যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো এবং অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো, যা ভিকটিম প্রাপ্য হবেন। অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাভোগ করার জন্য আদেশ দেওয়া হলো। পাশাপাশি আসামিকে সংশ্লিষ্ট ট্রাইব্যুনালে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেওয়া হলো।

আদালত রায়ের আদেশে আরও বলেন, আইনের ১৩ ধারা মোতাবেক ভিকটিমের আজীবন ভরণ-পোষণের দায়-দায়িত্ব ধর্ষকের ওপর বর্তাবে। তাদের সন্তানের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে। আইনের ১৩(১)(গ) ধারায় বিধান কার্যকর করার নিমিত্তে এ রায় ও আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট জেলার জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হোক। তিনি এই বিষয়ে ১৩(২) ধারায় প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করিবেন এবং সেটি প্রদানের যথাযথ নির্দেশ দেবেন ও তা বাস্তবায়নে যথাযথ পদক্ষেপ নেবেন। প্রয়োজনে তিনি এই আদালতের সাহায্য নেবেন। আর সন্তানটি তার মায়ের নিকট বা মাতৃকুলের আত্মীয়ের কাছে থাকতে পারে বলে রায়ে উল্লেখ করেন হাইকোর্ট।

আইনের ১৩ (১) ধারায় বলা হয়েছে, অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যা কিছুই থাকুক না কেন, ধর্ষণের কারণে কোনো সন্তান জন্মলাভ করলে-(ক) ওই সন্তানকে তার মা কিংবা তার মাতৃকূলীয় আত্মীয় স্বজনের তত্ত্বাবধানে রাখা যাবে; (খ) ওই সন্তান তার মা বা বাবা কিংবা উভয়ের পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার অধিকারী হবে; (গ) ওই সন্তানের ভরণ-পোষণের ব্যয় রাষ্ট্র বহন করবে; (ঘ) ওই সন্তানের ভরণ-পোষণের ব্যয় তার বয়স ২১ বছর পূরণ না হওয়া পর্যন্ত প্রদেয় হইবে, তবে ২১ বছরের অধিক বয়স্ক কন্যা সন্তানের ক্ষেত্রে তার বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত এবং পঙ্গু সন্তানের ক্ষেত্রে তিনি স্বীয় ভরণ-পোষণের যোগ্যতা অর্জন না করা পর্যন্ত প্রদেয় হবে। (২) সরকার বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে উপ-ধারা (১) এ উল্লিখিত সন্তানের ভরণপোষণ বাবদ প্রদেয় অর্থের পরিমাণ নির্ধারণ করবে।

(৩) এই ধারার অধীন কোনো সন্তানকে ভরণ-পোষণের জন্য প্রদেয় অর্থ সরকার ধর্ষকের কাছ থেকে আদায় করতে পারবে এবং ধর্ষকের বিদ্যমান সম্পদ হতে ওই অর্থ আদায় করা সম্ভব না হলে, ভবিষ্যতে তিনি যে সম্পদের মালিক বা অধিকারী হবেন সেই সম্পদ হতে তা আদায়যোগ্য হবে।

এফএইচ/এমএএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।