বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত-স্বাধীন

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১১:২৫ এএম, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বাংলাদেশের বিচার বিভাগ নির্বাহী বিভাগ থেকে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথক হয়েছিল ২০০৭ সালে। উদ্দেশ্য ছিল নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা হওয়ার মাধ্যমে বিচার বিভাগ রাজনৈতিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে প্রভাবমুক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। কিন্তু সব সরকারের সময়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অভিযোগ ছিল, বিচার বিভাগ সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হচ্ছে এবং এটি আসলে স্বাধীন নয়।

ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিচারকরা যদি স্বাধীন বা মুক্ত না থাকতে পারেন তাহলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগের ওপর নির্ভরশীল দেশের জনগণের স্বাধীনতা। এজন্য বিচার বিভাগকে সব সময় সব ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক প্রভাব এবং সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত থাকতে হবে।

তবে, আইনজ্ঞরা বলছেন, বিচার বিভাগ স্বাধীন মানে এই নয় যে স্বাধীনতার নামে আলাদা সচিবালয় ঘোষণা করে সেখানে বসতে বিল্ডিং, চেয়ার-টেবিল হলো। আলাদা সচিবালয় মানে হস্তক্ষেপমুক্ত বিচার, বিচারক নিয়োগ ও ন্যায়বিচারের ব্যবস্থা করা।

কাগজে-কলমে বিচার বিভাগ আলাদা হলেও বাস্তবে স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও আইন মন্ত্রণালয় ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে রয়েছে বলে মনে করছেন আইনজ্ঞরা। আর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করে ২৫ বছর আগের চূড়ান্ত রায়ের ১২ দফা নির্দেশনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন মামলার বাদী সাবেক বিচারক মাসদার হোসেনসহ অন্যরা।

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অভ্যুত্থানে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ বিভিন্ন মহল থেকে রাষ্ট্র ও সরকারের সব ক্ষেত্রে সংস্কারের দাবি উঠেছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তী সরকার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোর সংস্কারের জন্য কমিশন গঠনের যে ঘোষণা দিয়েছে, বিচার বিভাগ তার অন্যতম।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংক্রান্ত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পূর্ণ বাস্তবায়ন, বিগত স্বৈরশাসককে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করা বিচারপতিদের অপসারণ করে বিচারের আওতায় আনা, স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতাকাঠামো বিলুপ্ত করা এবং সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংবিধানের আমূল সংস্কারের দাবি জানিয়েছে সংগঠনের পক্ষ থেকে। এর আগেই অবসরপ্রাপ্ত বিচারক ফোরাম বিচার বিভাগ নিয়ে ১২ দফা দাবি পেশ করেছে।

এছাড়া ‘ইয়াং জাজেস ফর জুডিসিয়াল রিফর্ম’ ব্যানারে তরুণ বিচারকরাও সংস্কারের দাবি তুলেছেন। গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে ১২ দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন তারা। এসব দাবির মধ্যে বিচার বিভাগের বাজেটে সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণ স্বাধীনতা, বিচারকদের পদায়ন ও বদলিতে গ্রহণযোগ্য নীতিমালা, জনসংখ্যা ও মামলার অনুপাতে বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারকদের নিরাপত্তা ও পৃথক আবাসনের ব্যবস্থা, জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে সরকারি আইন কর্মকর্তা নিয়োগ, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তিতে দেওয়ানি ও ফৌজদারি কার্যবিধিসহ আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশের নাগরিক সমাজের পাশাপাশি আইনজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ মানুষের শেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগকে রাজনীতি ও দলীয়করণসহ সব সমস্যার শৃঙ্খলমুক্ত করতে পারলেই প্রকৃত স্বাধীনতা ফিরবে। এজন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয়ের দাবি আবারো প্রথমেই রয়েছে।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণের ইতিহাস

মূলত বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার জন্য ১৯৯৪ সালে রিট করেছিলেন জেলা জজ ও জুডিসিয়াল অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন। সেই মামলাটি ‘মাসদার হোসেন মামলা’ নামে পরিচিত, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ থেকে যার চূড়ান্ত রায় হয়েছিল ১৯৯৯ সালে। রায়ের আট বছর পর ২০০৭ সালে মূল নির্দেশনাটি বাস্তবায়ন করে বিচার বিভাগকে আলাদা করা হয়েছিল। তবে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথক করার কথা দীর্ঘদিন ধরে হয়ে আসছে।

জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়া বলছে, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলের শুরু থেকে বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করার বিতর্ক বা আলোচনা শুরু হয়। ১৭৯৩ সালে প্রণীত রেগুলেশন ৩-এর মাধ্যমে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস কালেক্টরের বিচার করার ক্ষমতা রহিত করেন। ফলে দেওয়ানি আদালতের বিচারক জজ-ম্যাজিস্ট্রেট নামে অভিহিত হন। জেলা পর্যায়ে এ দুই বিভাগকে পৃথকীকরণের বিষয়টি ১৮২৮ সাল পর্যন্ত বহুল বিতর্কিত ছিল বলে বলছে বাংলাপিডিয়া।

এরপর আরও অনেক বছর আলোচিত হওয়ার পর অবশেষে ২০০৭ সালে বিচার বিভাগ পৃথক হওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়।

বিচার বিভাগ স্বাধীন ঘোষণা হয় সেনা সমর্থিত সরকারের সময়

১৯৯৪ সালে বিচার বিভাগকে সরকারের নির্বাহী বিভাগ থেকে স্বাধীন করতে রিট আবেদন করেন জেলা জজ ও জুডিসিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন মহাসচিব মাসদার হোসেন। হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালে ওই আবেদনের পক্ষে রায় দেন। এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার। ১৯৯৯ সালে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ। সেই সঙ্গে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণসহ ১২ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আপিল বিভাগের ওই নির্দেশনার সময় ও পরের মেয়াদে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের কেউই বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে পৃথক করেনি। পরে ২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ বাস্তবায়ন করে।

পরবর্তী দেড় দশকের বেশি টানা ক্ষমতায় ছিল আওয়ামী লীগ। তখন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় করা হয়নি। থমকে আছে বিচার বিভাগের পূর্ণ স্বাধীনতা বাস্তবায়নের কাজ।

১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্রের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ নিয়ে এরকম প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও তা বাস্তবায়নের জন্য ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল। বহুল আলোচিত মাসদার হোসেন মামলার রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে বিচার বিভাগ আলাদা হয়। পরিহাসের বিষয় হলো, বাংলাদেশে কোনো নির্বাচিত বা গণতান্ত্রিক সরকার নয়, একটি সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করে।

বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনসাবেক বিচারক মাসদার হোসেন

রাজনীতিবিদদের মুখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা নেই

পৃথক সচিবালয় ও স্বাধীন বিচার বিভাগের বিষয়ে সাবেক বিচারক মাসদার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আলাদা পে-কমিশন করার কথা ছিল, সেটাও হয়নি। একইভাবে বিচারকদের নিয়োগের ক্ষেত্রে লোয়ার জুডিসিয়ারিতে তুলনামূলকভাবে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে মেরিট যাচাই করে জজ নিয়োগ হয়। কিন্তু হায়ার জুডিসিয়ারিতে সেটা হয় না। এটা কিন্তু রায়ের সেই নির্দেশনার পরিপন্থি।’

মাসদার হোসেন জানান, বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ মামলার চূড়ান্ত রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা ছিল। তার মধ্যে ৮ দফায় ছিল সংসদ এবং নির্বাহী বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত ও স্বাধীন বিচার বিভাগ হবে। কিন্তু এখনও নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে জজদের বদলি, বেতন, ছুটি, প্রমোশন সব কিছু হয়। এটা এখনও কার্যকর হয়নি।

মাসদার হোসেন বলেন, ‘কর্মপরিবেশ, লজিস্টিক বাজেট এগুলোও যথাযথভাবে হয় না। সর্বোপরি বিচারকদের সংখ্যা বৃদ্ধি না পাওয়ায় সাধারণ মানুষ বিচারপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বর্তমানে লাখ লাখ মামলা আদালতে ঝুলছে। বিচারকদের সংখ্যা বাড়িয়ে দিলে এ সমস্যার অনেকটা সমাধান হয়। সংখ্যা বেশি হওয়ায় প্রতিটা মামলার শুনানি ছয় মাস বা তারও বেশি সময় লাগে। এ কারণে বিচার শেষ হতেও অনেক দিন চলে যায়। এভাবে চললে বিচারপ্রার্থীরা বিচার বিভাগের ওপর আস্থা হারাবে।’

এজন্য জরুরি ভিত্তিতে বিচারকের সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে মনে করেন সাবেক এই বিচারক। রায়ের নির্দেশনা সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়ন না করায় সরকারের অবহেলা রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার এটাতে গুরুত্ব দিচ্ছে না। জনস্বার্থে এটার অবশ্যই গুরুত্ব দেয়া উচিত।’

মাসদার হোসেন আরও বলেন, ‘আগে বা এখন রাজনীতিবিদ যারা আছেন তাদের মুখে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার কথা নাই। এটা নিয়ে তারা সোচ্চারও ছিল না।’

বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন

বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে কখনো স্বৈরাচার সৃষ্টি হবে না

সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিয়ে জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় চাই, নিম্ন আদালতকে আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। মেধাবী, সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন যোগ্যদের বিচারক হিসেবে নিয়োগ করতে অবশ্যই আইন বা নীতিমালা করতে হবে। বিচার বিভাগ স্বাধীন হলে কখনো স্বৈরাচার সৃষ্টি হবে না, আইনের শাসন নিশ্চিত হবে। আওয়ামী লীগ সরকারের আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রীর মতো ফোন করে রায় ও আদেশ বদলানোর প্রবণতাও কমবে।’

চেয়ার-টেবিলই কি স্বাধীন ও পৃথক সচিবালয়?

শুধু কি চেয়ার-টেবিল হলেই বিচার বিভাগ আলাদা সচিবালয় হয়ে যাবে বলে প্রশ্ন তোলেন মাহবুব উদ্দিন খোকন। তবে পৃথক সচিবালয় করতে হবে। তিনি বলেন, ‘শুধু আলাদা সচিবালয় করলেই হবে না, সচিবালয়কে হস্তক্ষেপমুক্ত করতে হবে। তা হলেই বিচার বিভাগ স্বাধীন বলা যাবে। এছাড়া বিচারপতি অপসারণ ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে অ্যামেন্ডমেন্ট করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতায় মাসদার হোসেন মামলার স্পিরিট নিয়ে আসতে হবে। এটাকে শিউর করতে হবে।’

মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, ‘বিচারক হিসেবে তদবিরে চলে আসে। কোন ম্যাজিস্ট্রেট ঘুস খায়, না খায় সেটাও অনেকেই জানেন। কিন্তু সেটার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় না। বিচারাঙ্গন নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করা দরকার।’

‘এখন তো প্রেসক্রিপশন দেওয়া হয়। আগে গ্রামে জ্বর হয়েছে, এটা সেটা হয়েছে, ওষুধ দিয়েছে। কিন্তু এখন আগে ডায়াগনস্টিক চেক করে, রোগ নির্ণয় করে, এর পরে ওষুধ দেয়। আপনি যদি জুডিসিয়ারিতে ডায়াগনস্টিক না করেন, রোগ নির্ণয় না করেন, কী সংস্কার আর কী স্বাধীন করবেন?’ বলেন খোকন।

বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনঅ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়নি

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে সুপ্রিম কোটের সিনিয়র আইনজীবী অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা পরিপূর্ণতা পায়নি। সরকার এটাকে কুক্ষিগত করে রেখেছে। মাসদার হোসেন মামলার আলোকে সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা বারবার তাগিদ দিলেও পরে আর সেটি টিকল না। পৃথক সচিবালয় থেকে শুরু করে নিম্ন আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে এস কে সিনহা সাহেব তাগিদ দিলেও কোনো কাজ হয়নি।’

সুব্রত চৌধুরী জানান, সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট উভয় বিভাগে বিচারপতি নিয়োগের আইন হওয়া দরকার। এছাড়া দলীয় বিবেচনা ও তদবির এসবের লাগাম টানা দরকার। নইলে নিয়োগের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ থাকে। বিচার বিভাগে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে। এজন্য সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় করে নিম্ন আদালতের বিচারকদের সব কিছু সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করতে হবে। এছাড়া মামলার তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। তাই নিম্ন আদালতে মামলার তূলনামূলক বিচারক নিয়োগ এবং উচ্চ আদালতে আরও বিচারক নিয়োগ দেওয়া প্রয়োজন।

‘বিচার বিভাগের সংস্কারের অংশ হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের কোনো বিচারপতির অবসরে যাওয়ার অন্তত এক বছরের মধ্যে সরকার কর্তৃক তাকে কোনো পদায়ন না করা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগে জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন বন্ধ করা, প্রধান বিচারপতির ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে সিনিয়র আইনজীবী নিয়োগের নীতিমালা নিয়ে জ্যেষ্ঠ আইনজীবীদের ভিন্ন মত আছে।’ বলেন সুব্রত চৌধুরী।

বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনঅ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ

মাসদার হোসেন মামলার আলোকে পৃথকীকরণ হয়নি

পৃথক সচিবালয় ও স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ (এইচআরপিবি) চেয়ারম্যান ও সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগ সত্যিকার অর্থে যেভাবে পৃথক হওয়া দরকার ছিল, সেভাবে হয়নি। অধস্তন (নিম্ন) আদালতের বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে আইন মন্ত্রণালয় যে খসড়া করেছিল, সে সময় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ তাতে আপত্তি দিয়েছিল। পরে বিভিন্ন টানাপোড়েনে সেটি আর হলো না। এরপর যেটা হয়েছে সেটা তো মন্ত্রণালয়ের এক ধরনের কর্তৃত্ব রেখেই করা হয়েছে। পরে অবশ্য ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি আব্দুল ওয়াহহাব মিঞার সময় সেটি অনুমোদন দেওয়া হয়। কাজেই তারা (আইন মন্ত্রণালয়) বলতে পারে এটি সুপ্রিম কোর্ট অনুমোদন দিয়েছে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে মাসদার হোসেন মামলার আলোকে যেভাবে হওয়ার কথা ছিল সেটি আসলে হয়নি বলেই আমার মনে হচ্ছে।’

বিচার বিভাগের সচিবালয় হতে হবে হস্তক্ষেপমুক্ত স্বাধীনঅ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব

আলাদা বিল্ডিং করলেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে যাবে?

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার বিষয়ে সুপ্রিম কোটের সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, সুপ্রিম কোর্টের অধীনে পৃথক সচিবালয় আর আলাদা বিল্ডিং করলেই কি বিচার বিভাগ স্বাধীন হয়ে গেছে বলা যাবে? সেখানে সচিবালয়ের হস্তক্ষেপমুক্ত করে তাদের কাজকে নিজেদের মতো করে করতে দেওয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। প্রধান বিচারপতির নিজস্বতা থাকতে হবে। আর আইন মন্ত্রণালয়ের কাজ হবে শুধু কাজী নিয়োগ দেওয়া ও অন্যান্য আইন প্রণয়নে হেল্প করা জুডিসিয়ারিতে। তাদের কোনো মাদবরি থাকবে না।

সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, ‘সচিবালয় মানে একটা আলাদা বিল্ডিং যদি লাগে সরকার তা করবে। এখানে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল যারা আসেন তারা কীভাবে উচ্চ আদালতের বিচারক হওয়া যাবে এই তদবিরে ব্যস্ত থাকেন। ডেপুর্টি রেজিস্ট্রাররা চিন্তা করেন কীভাবে ভালো আদালতের জজ হয়ে পোস্টিং পাবেন। কিন্তু সত্যিকার অর্থে জনসাধাণের জন্য কাজ করা দরকার।’

তিনি জানান, সুপ্রিম জুডিসিয়াল অধ্যাদেশ নিয়ে কোনো কিছু করেনি গত আওয়ামী লীগ সরকার।

বিচারক নিয়োগে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ১১ সদস্যের কমিটি করা যেতে পারে বলে মতামত দেন আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব। তিনি জানান, রাজনৈতিক দল করাটা বিচারক হওয়ার যোগ্যতা বা অযোগ্যতা মাপকাঠি হবে না। বিচারপতি হওয়ার মিনিমাম যোগ্যতা হবে, সাবলীল বাংলা ও ইংরেজি ভাষা জানা, সৎ, স্বাধীন চিন্তা থাকা। একই ভাবে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারক অপসারণ করতে হবে।

বিচার বিভাগ স্বাধীনতায় সংবিধানের যে ধারাকে বাধা মনে করা হয়

বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে আলোচিত বিষয়গুলোর একটি অধস্তন আদালতের বিচারকদের বিষয়ে এখতিয়ার। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ২০১১ সালে সংযুক্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, অধস্তন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি দান, ছুটি মঞ্জুরসহ শৃঙ্খলাবিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত থাকবে। রাষ্ট্রপতি সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে তা প্রযুক্ত করবেন।

সংবিধানের এই অনুচ্ছেদকে বিচারকদের স্বাধীনতার জন্য অনেকেই বাধা মনে করেন।

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণসংশ্লিষ্ট উল্লিখিত বিষয়গুলোর দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর ন্যস্ত ছিল। ১৯৭৪ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে তা রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত করা হয়। ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতির সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করার বিষয়টি যুক্ত করা হয়।

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ নিয়ে ১৯৯৯ সালের রায়

বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে এক রিট মামলায় ১৯৯৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ চূড়ান্ত রায় দেন। রায়ে ১২ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। ১২ দফা নির্দেশনা হচ্ছে:

১. সংবিধানের ১৫২ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় সব বিভাগের কাজ সার্ভিস অফ রিপাবলিকের ভেতরে পড়বে। তবে বিচার বিভাগের কাজ ও অবকাঠামোর সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের সিভিল সার্ভিসের অনেক ভিন্নতা রয়েছে। বিচার বিভাগকে অন্যান্য সিভিল সার্ভিসের সঙ্গে একত্রিত করা যাবে না।

২. বিচারিক (জুডিসিয়াল) ম্যাজিস্ট্রেটদের নির্বাহী বিভাগ থেকে আলাদা করতে হবে এবং নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেটরা বিচারিক কাজ করতে পারবেন না। সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের পদ সৃষ্টি, নিয়োগ পদ্ধতি, নিয়োগ বদলিসহ অন্য কাজের বিধিমালা প্রণয়ন করতে পারবেন।

৩. সিভিল সার্ভিস অর্ডার ১৯৮০ অনুযায়ী সব ম্যাজিস্ট্রেটকে পিএসসির অধীনে বিসিএস পরীক্ষার মাধ্যমে একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া হয়। একসঙ্গে নিয়োগ দেওয়া সংবিধান পরিপন্থি।

৪. এই রায় পাওয়ার পর যত দ্রুত সম্ভব জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশন বিধিমালা এবং কমিশন গঠন করতে হবে। এই কমিশনে সুপ্রিম কোর্টের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকবে। এই কমিশনে নারী ও পুরুষ বলে কোনো বৈষম্য থাকবে না।

৫. সংবিধানের ১১৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিসিয়ারির সবার চাকরির বিধিমালা (নিয়োগ, পদায়ন, বদলি পদোন্নতি ও ছুটিসহ অন্যান্য) প্রণয়ন করবেন।

৬. সংবিধানের ১১৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি জুডিসিয়াল সার্ভিস পে-কমিশন বিধিমালা প্রণয়ন করবেন।

৭. সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের থাকবে।

৮. বিচার বিভাগ জাতীয় সংসদ বা নির্বাহী বিভাগের অধীনে থাকবে না এবং জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটসহ সব বিচারক স্বাধীনভাবে কাজ করবেন।

৯. জুডিসিয়ারির (নিম্ন আদালত) বার্ষিক বাজেট প্রণয়নের ওপর নির্বাহী বিভাগের কোনো হাত থাকবে না। এই বাজেট সুপ্রিম কোর্ট প্রণয়ন এবং বরাদ্দ করবে।

১০. জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্যরা প্রশাসনিক আদালতের আওতাভুক্ত থাকবেন।

১১. এই রায় অনুযায়ী বিচার বিভাগ পৃথককরণের জন্য সংবিধানে কোনো সংশোধন করার প্রয়োজন নেই। তবে পৃথককরণ আরও অর্থবহ করতে যদি সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন হয়, তবে তা করা যাবে।

১২. জুডিসিয়াল পে-কমিশন: জুডিসিয়াল পে-কমিশন জুডিসিয়ারির সদস্যদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সুবিধা বাড়ানোর বিষয়ে যতদিন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ না করবে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান অবকাঠামো অনুযায়ী তার সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন।

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে রিট

অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদোন্নতি ও বদলির ক্ষমতা এককভাবে সুপ্রিম কোর্টের হাতে না থাকায় ‘দ্বৈতশাসন’ সৃষ্টি হচ্ছে বলে সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা মন্তব্য করেছিলেন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১১৬ অনুচ্ছেদ চ্যালেঞ্জ করে গত ২৫ আগস্ট রিট আবেদন করেন সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী।

রিট আবেদনে বলা হয়েছে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এ মৌলিক কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে। একই সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধির বাস্তবায়ন কার্যত আইন মন্ত্রণালয়ের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী ইতিমধ্যে বিলুপ্ত হয়েছে। পঞ্চম সংশোধনী অসাংবিধানিক ঘোষিত হয়েছে। এবং পঞ্চদশ সংশোধনীতে ১১৬ এর বিধান বহাল রাখা হয়েছে, যা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনের পরিপন্থি।

পৃথক সচিবালয় না থাকায় বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বলে রিটে উল্লেখ করা হয়।

রিটকারী সুপ্রিম কোর্টের ১০ জন আইনজীবী হলেন মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন, মো. আসাদ উদ্দিন, মো. মুজাহিদুল ইসলাম, মো. জহিরুর ইসলাম, মোস্তাফিজুর রহমান, শাইখ মাহাদী, আবদুল্লাহ সাদিক, মো. মিজানুল হক, আমিনুল ইসলাম শাকিল এবং যায়েদ বিন আমজাদ।

আবেদনকারীদের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জাগো নিউজকে বলেন, ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে এ মৌলিক কাঠামো নষ্ট করা হয়েছে। নিম্ন আদালতের বিচারকরা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছেন আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। এর থেকে বের হয়ে প্রধান বিচারপতির অধীনে বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে।’

এফএইচ/এমএমএআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।