ট্রাইব্যুনালে ডা. ঈশিতা
৬ দিন আগে তুলে নিয়ে যায় র্যাব, ব্রিফিংয়ে জানায় সকালেই গ্রেফতার
চিকিৎসক ইসরাত রফিক ঈশিতাকে গুম ও নির্যাতনের অভিযোগে র্যাবের সাবেক ছয় সদস্যের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। ২০২১ সালের ওই ঘটনায় অভিযুক্তদের তিনজন হলেন র্যাবের সাবেক স্কোয়াড্রন লিডার আলী আশরাফ, আইটি স্পেশালিস্ট রাকীব ও অ্যাডিশনাল এসপি মো. আক্তারুজ্জামান। বাকি তিনজন অজ্ঞাত।
রোববার (২২ সেপ্টেম্বর) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ভুক্তভোগী ডা. ঈশিতার পক্ষে চিফ প্রসিকিউটর বরাবর এ সংক্রান্ত অভিযোগ দায়ের করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ কানিজ ফাতেমা। এসময় ডা. ঈশিতাও উপস্থিত ছিলেন।
গ্রেফতার, মামলা, নির্যাতন ও গুমের বিষয়ে যা জানালেন ডা. ঈশিতা
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দায়েরের পর আদালত প্রাঙ্গণে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন ডা. ঈশিতা। তিনি বলেন, ২০২১ সালের ২৮ জুলাই তাকে তুলে নিয়ে যায় র্যাব। এরপর ১ আগস্ট বিকেলে কারওরান বাজারে র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে নিয়ে গিয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন। ছয়দিন আগে ধরে নিয়ে যাওয়া হলেও সেখানে বলা হয় ওইদিন সকালেই আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
ডা. ঈশিতা সাংবাদিকদের বলেন, আমাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর পাঁচদিন র্যাব হেড কোয়ার্টারে আটকে রাখা হয়। পাঁচদিন আটকে রাখার পর ষষ্ঠদিনে র্যাব-৪ এ পাঠানো হয়। র্যাব-৪ এর অ্যাডিশনাল এসপি আক্তারুজ্জামান তখন সিনিয়র এসপি ছিলেন, তিনি আমাকে চোখ বেঁধে মাইক্রোতে করে এক জায়গায় নিয়ে যান। পরে আমি জানতে পারি যে এটা র্যাব-১ মিরপুরে। ওখানে নিয়ে গিয়ে মাদকসহ আমাকে ভিডিও করেন, এরপর আবার আমাকে র্যাব হেড কোয়ার্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগেই মেজারমেন্ট নিয়ে রেখেছিল। এরপর তারা তাদের পোশাক (ইউনিফরম), জুতা এগুলো পরায়। এগুলো পরিয়ে ছবি তুলে এবং ভিডিও করার পর কারওয়ান বাজারের মিডিয়া সেন্টারে নিয়ে যায়।
- আরও পড়ুন
- ৬ র্যাব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গুম-নির্যাতনের অভিযোগ
- আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ
আপনাকে সুনির্দিষ্ট কোন অভিযোগে আটক করা হয়েছিল সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে ঈশিতা বলেন, তাদের অভিযোগ আমি মাদক ব্যবসায়ী, প্রতারক ও জালিয়াত।
আপনাকে কেন ফাঁসানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দেখুন যখন র্যাব হেড কোয়ার্টারে ছিলাম ওই পাঁচদিন আমার চোখ বাঁধা ছিল। আমার সামনে যখন কথা বলেছে ওই সব শুনেই ধারণা করতে পেরেছি। তুলে নিয়ে যাওয়ার পর প্রথমদিন রাতে আমার চোখ খোলা ছিল। দ্বিতীয় দিন থেকেই আমার চোখ বাঁধা ছিল। আমাকে বারবারই এ রুম ওই রুম শিফট করা হতো। তখন বিভিন্ন অফিসার কথা বলেছেন, মাঝখানে আলী আশরাফ, রাকীব আক্তারুজ্জামান ওনাদের তিনজনকে আইডেন্টিফাই করতে পেরেছি। আমাকে চোখ বেঁধে তারা কথাবার্তা বলছিলেন। তাদের কথাবার্তায় আমি বুঝেছি। তখন তারা লাউড স্পিকারে কথা বলছিলেন, আমি যেটা বুঝেছি সেটা হচ্ছে এয়ারফোর্সের কোনো অফিসারের সঙ্গে।
ঈশিতা আরও বলেন, ঘটনার সময়টা ছিল আমি যখন এমবিবিএস পাস করে মেডিকেল অফিসার হিসেবে ছিলাম। তারা তাদের সেদিনের (২০২১ সালের) প্রেস ব্রিফিংয়ে একটা কথা উল্লেখ করেছেন যে, আমি একটা সরকারি সংস্থায় কর্মরত ছিলাম। ওখানে অনৈতিক কাজের জন্য আমাকে নাকি ডিসমিস করা হয়; যেটা সম্পূর্ণ মিথ্যা। আমি কিন্তু নিজেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলাম, কারণ সেখানে কাজের পরিবেশ ছিল না। বিভিন্ন অফিসারের আচরণ ও তাদের নিজের চরিত্র আমার কাছে ঠিক মনে হয়নি। সেখানে অ্যাডজাস্ট করার মতো ছিল না। সেইসঙ্গে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করার জন্য বাইরে যবো, লাইসেন্স করতে হবে অনেক চাপ।
- আরও পড়ুন
- ১০ সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন
- ৪০ মিনিটের মধ্যে দাফন না করলে লাশ নিয়ে যাবে পুলিশ
তারা কি আপনার সঙ্গে কেমন আচরণ করেছিল এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. ঈশিতা বলেন, তারা তো ভালো আচরণ করতে জানে না। খারাপ আচরণই করেছে। অবশ্যই তারা খারাপ আচরণ করেছিল। তখন আমার অপারেশনের পরবর্তী স্টেজ, আমি একটা পোস্ট অপারেটিভ পেসেন্ট ছিলাম। আমার একটা রি-কন্সাকশ্যান সার্জারি হয়েছে, যখন আমি বললাম পোস্ট অপারেটিভ পেশেন্ট, আমি কিন্তু তখন সিঙ্গেল স্ক্র্যাচ ইউজ করে হাঁটতাম। আমাকে স্ক্র্যাচটাও নিতে দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, যখন আমি বললাম আমার এই অপারেশন হয়েছে, এই সার্জারি, তখন আলী আশরাফ বললেন যে, ‘ক্যান বাংলায় কওন যায় না’ এটা যদি হয় একজন স্কোয়াড্রন লিডারের ল্যাঙ্গুয়েজ তা হলে তাদের বিহেবিয়ার কী হতে পারে? তাদের কাছে কী আশা করা যায়?
সেখানে কোনো নারী অফিসার ছিল না এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আমি তখন তাদের বার বার জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাদের পুরো ডিপার্টমেন্টে কি একজন নারী কর্মকর্তাও নেই। যে আমার সঙ্গে কথা বলতে পারে। তখন তারা আমাকে বিভিন্ন কথা বলেন, যেমন আইটি স্পেশালিস্ট রাকিবের কথা বললাম, যে কি না আমার সব কিছু-আমার টপ টু বটম...প্রেজেন্ট করেছে।
রাকিব ও অন্য ছয়জন র্যাবের কি না জানতে চাইলে ডা. ঈশিতা জানান, তখন ছয়জনই র্যাবের হেড কোয়ার্টারে ছিলেন। কোন ফোর্সের এটা আমার জানা নেই।
অভিযোগ নিয়ে চিফ প্রসিকিউটর যা বললেন
এ বিষয়ে চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, এ চিকিৎসক ইউএসএ’র একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএএচডি করছিলেন। ময়মনসিংহের কমিউনিটি বেজড হাসপাতালের চিকিৎসক ছিলেন তিনি। ২০২১ সালের ২৮ জুলাই ডা. ইশরাত রফিক ঈশিতাকে তুলে নিয়ে যায় র্যাব, তাকে পাঁচদিন গুম করে রেখেছিল ওই ঘটনায় অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। সেটা আমরা গ্রহণ করেছি, সেটা আমরা পর্যালোচনা করে দেখবো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার্য বিষয় কি না। যেহেতু আমাদের কাছে অভিযোগ এসেছে, এটা আমরা দেখবো। ডা. ঈশিতার বিরুদ্ধে তিনটি পৃথক মামলা দেওয়া হয়েছে। তাকে ১২ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল। সেই মামলায় জেল হয়েছিল, তিনি জেলও খেটেছেন। এখন মুক্ত আছেন। তিনি ট্রমাটাইজ, কারণ একজন ডাক্তারকে যখন এভাবে তুলে নেওয়া হয়েছে, তাকে মাদক দিয়ে মামলা দিয়ে স্ক্যান্ডালাইজ করা হয়েছে সমাজের কাছে। তিনি একজন প্রতিভাবান চিকিৎসক। তার জীবনটাকেই শেষ করে দেওয়া হয়েছে।
তিনি হাইকোর্টে এসেছিলেন এই মামলা নিয়ে সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে মামলায় দণ্ডিত হয়েছিলেন। সেটার বিরুদ্ধে আপিল করার পর তাকে উচ্চ আদালতে খালাস দিয়েছিলেন। সেখানে মন্তব্য করা হয়েছিল তাকে যে অভিযোগে তুলে নেওয়া হয়েছিল সেটা মিথ্যা ছিল। সেটা ছিল হাইকোর্টের ব্যাপার। সুতরাং গুম করে রাখার যে বিষয়টা এটা কিন্তু কোনো আদালতে বিচার্য বিষয় এখনো নয়। সে কারণে হয়তো আমাদের কাছে এই অভিযোগ নিয়ে এসেছেন।
২০২১ সালে র্যাবের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিবেদন
২০২১ সালের ১ আগস্ট দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘ডা. ঈশিতার শত পরিচয়-শত সনদের সবই ভুয়া! শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, কখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানী, কখনো বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কিংবা কখনো গবেষক। আরও রয়েছে কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, মানবাধিকারকর্মীসহ অসংখ্য পরিচয়। এত সব পরিচয় যার ঝুলিতে, সেই প্রতারক ডা. ইশরাত রফিক ঈশিতাকে গ্রেফতার করেছে র্যাব।
ওই বছরের ১ আগস্ট বিকেলে, কারওয়ান বাজারের র্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা জানান, সকালে ঈশিতাকে রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেফতারের সময় শহিদুল ইসলাম দিদার নামের এক সহযোগীকেও গ্রেফতার করেন তারা।
এফএইচ/এসএইচএস/জেআইএম