সংবিধান ১৭ বার সংশোধন

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সংশোধনী ছিল রাজনৈতিক

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৬:৪৯ পিএম, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪
বাংলাদেশের সংবিধান

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে এখন পর্যন্ত ১৭ বার। এর মধ্যে একমাত্র যৌক্তিক ভোট ও নির্বাচনী পদ্ধতি তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রণয়ন ছাড়া বাকি সবই ছিল তখনকার সরকারের হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করেন আইনজ্ঞরা।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হয়। এরপর তাতে আনা হয় একের পর এক সংশোধনী। প্রথম থেকে চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন প্রথম আওয়ামী লীগ আমলে। পঞ্চম ও ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয় যথাক্রমে জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি আবদুস সাত্তার ক্ষমতায় থাকাকালে।

সপ্তম, অষ্টম, নবম ও দশম সংশোধনী আনা হয় হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ সরকারের সময়ে। একাদশ, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ সংশোধনী আনা হয় খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের দুই আমলে। পঞ্চদশ, ষোড়শ ও সপ্তদশ সংশোধনী আনা হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ আমলে।

সংবিধান সংশোধন শুধু তাত্ত্বিক বিষয় নয়। সব সময়ই এর একটি প্রেক্ষাপট ও উদ্দেশ্য থাকে এবং এর সঙ্গে রাজনীতির সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশের সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়া পর্যালোচনা করলেও সেটি স্পষ্ট হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের অভাব, সামরিক শাসন, নেতৃত্বের ক্ষমতালিপ্সা, রাষ্ট্রের কর্তৃত্ববাদী প্রবণতা—এ সবকিছুই সংবিধান সংশোধনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলাদেশের ৫৩ বছরে সংবিধানে কাটাছেঁড়া করা হয়েছে ১৭ বার। সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে একদলীয় শাসনব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দুবার সামরিক শাসন বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে।

সামরিক শাসকের ছাতার তলায় ‘নির্বাচিত’সংসদে সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮৮ সালে। পরে রাজনৈতিক সরকার বিভিন্ন সংশোধনী আনলেও তারা রাষ্ট্রধর্মের জায়গায় আর হাত দেয়নি।

গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের বিজয়ের পর ৯০ এর দশকের শুরুতে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়েছে। আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনী পাস হয়েছিল।

৫৩ বছরে দেশের সংবিধান বার বার সংশোধন করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। একমাত্র বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (পরে আগে) প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা ছাড়া বাকি সব সংবিধান সংশোধন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য করা।

নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আবার পরে পাল্টা সংশোধনী এনে সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের গণপরিষদের (সংসদ) যাত্রা শুরু হয়েছিল। গণপরিষদে সংবিধান বিল গৃহীত হয়েছিল ৪ নভেম্বর। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে কার্যকর হয়েছিল সংবিধান। এত অল্প সময়ে আর কোনো দেশে সংবিধান প্রণয়নের নজির নেই বলে জানা গেছে।

সংশোধনী নিয়ে বিতর্ক

সংবিধানে বার বার সংশোধনী আনার পর অনেক বিষয় নিয়ে এখনও বিতর্ক রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে চারবার। শুধু একটি সংসদে অর্থাৎ ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদের সপ্তম সংসদে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।

স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নের জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণপরিষদের সদস্য এবং রাজনীতিকদের নিয়ে ৩৪ সদস্যের কমিটি করা হয়েছিল ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল। আট মাসের মধ্যেই কমিটি সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছিল।

সেই কমিটির প্রধান ড. কামাল হোসেন বলেন, মূল সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোতে বার বার সংশোংধন যে করা হয়েছে, তা অনাকাঙ্ক্ষিত।

সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী জাগো নিউজকে বলেন, ৫৩ বছরে দেশের সংবিধান বার বার সংশোধন করা হয়েছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে। একমাত্র বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট (পরে আগে) প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমেদের সময়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা ছাড়া বাকি সব সংবিধান সংশোধন রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য করা।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সৈয়দ মামুন মাহবুব জাগো নিউজকে বলেন, সংবিধান সংশোধনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন এই একটা দুটো ছাড়া বাকি সব সংশোধনীই হয়েছে তদানীন্তন সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এই দুটো ছাড়া ১৯৭৩ সাল থেকে সংবিধান সংশোধন হয়েছে তখনকার সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য। জনগণের অধিকার হরণ করার জন্য।

সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী মনে করেন, বেশিরভাগ সংশোধনী হয়েছে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি এবং দলের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে।

প্রথম সংশোধনী: যুদ্ধাপরাধীদের বিচার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার সংবিধান কার্যকর করার পর সাত মাসের মধ্যেই তাতে প্রথম সংশোধনী আনেন। এই সংশোধনীর মূল কারণ ছিল সদ্য স্বাধীন দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন তৈরি এবং তা কার্যকর করার বিষয় আনা হয় এই সংশোধনীতে। পরে এর আওতায় আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধ আইন করা সম্ভব হয়।

সংবিধানের এই প্রথম সংশোধনী বিল পাস হয় ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই। এর দু’দিন পরই রাষ্ট্রপতি তা অনুমোদন করেছিলেন। সংসদে বিলটি এনেছিলেন সে সময় আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। সংসদে উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে শুধু তিনজন সদস্য ভোট দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন।

দ্বিতীয় সংশোধনী: মৌলিক অধিকার স্থগিত এবং জরুরি অবস্থা

সংবিধানে প্রথমে নিবর্তনমূলক আটক এবং জরুরি অবস্থা ঘোষণার বিধান ছিল না। দ্বিতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে সংযোজন করা হয় জরুরি অবস্থা ঘোষণা এবং নিবর্তনমূলক আটকের বিধান। জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হলে সে সময় মৌলিক অধিকারগুলো স্থগিত করার বিধানও আনা হয়।

কোন প্রেক্ষাপটে বা পরিস্থিতিতে এমন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে, সে সম্পর্কে সংশোধনীতে বলা হয়, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ বা বহিরাক্রমণে দেশের নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক জীবন বাধাগ্রস্ত হলে তখন জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা যাবে।

প্রথম সংশোধনী আনার দুই মাস পরই ১৯৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর এই দ্বিতীয় সংশোধনী বিল পাস করা হয়। প্রথম সংসদে এই বিলটিও উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর। বিলটি পাসের সময় তৎকালীন বিরোধীদল এবং স্বতন্ত্র কয়েকজন সংসদ থেকে ওয়াকআউট করেছিলেন।

তৃতীয় সংশোধনী: বাংলাদেশ-ভারত সীমানা

বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমানা নির্ধারণ সম্পর্কিত একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য এই সংশোধনী আনা হয়। দুই দেশের সীমান্ত চুক্তিতে ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি বিনিময়ের কথা ছিল। সে ব্যাপারেই বিধান করা হয় সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনীর মাধ্যমে।

সংশোধনী বিলটি ২৬১টি ভোট পেয়ে পাস হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ২৩ নভেম্বর। আর বিপক্ষে ভোট পড়েছিল ৭টি। সে সময়ের আইনমন্ত্রী মনোরঞ্জন ধর বিলটি সংসদে এনেছিলেন।

এই সংশোধনী আনার ৪০ বছর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ছিটমহলগুলো বিনিময় হয়েছে।

চতুর্থ সংশোধনী: একদলীয় শাসন বাকশাল

এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থার আমূল বদলে ফেলা হয়েছিল। বহুদলীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে প্রবর্তন করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা। সর্বময় ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতির হাতে। চারটি পত্রিকা রেখে অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। সেই শাসনব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত। সংশোধনী বিলটি সংসদে পাস হয় ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি। সেদিনই রাষ্ট্রপতি বিলটি অনুমোদন করেছিলেন। তখনকার সরকারি দল আওয়ামী লীগেরই দু’জন সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানী এবং মঈনুল হোসেন সংসদে ভোটের সময় অধিবেশন বর্জন করেছিলেন। আর সংশোধনীর পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন ২৯৪ জন সংসদ সদস্য।

সংসদীয় পদ্ধতির বদলে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থার জন্য সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনা হয়েছিল।

সংবিধান সংশোধনগুলো তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এবং সংসদীয় সরকার ব্যবস্থার প্রবর্তন এই একটা দুটো ছাড়া বাকি সব সংশোধনীই হয়েছে তদানীন্তন সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার লক্ষ্যে। সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় ফিরে আসা এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা এই দুটো ছাড়া ১৯৭৩ সাল থেকে সংবিধান সংশোধন হয়েছে তখনকার সরকারের ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার জন্য। জনগণের অধিকার হরণ করার জন্য।

এই মৌলিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের যে পদক্ষেপ নিয়ে এখনও সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়, তা হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্রের সুফল মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি। সে কারণে রাজনীতি এবং অর্থনীতি সব দিক থেকেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ নেতাদের অনেকে প্রেক্ষাপটকে ব্যাখ্যা করেন ভিন্নভাবে।

তারা বলেন, দুর্নীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ সব মিলিয়ে ভয়াবহ সংকটের মুখে বাধ্য হয়ে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল।

শেখ মুজিব ১৯৭৫ সালের ২৫ মার্চ ঢাকায় এক জনসভায় বাকশাল নিয়ে বক্তব্যে ঘুনেধরা সমাজ পাল্টানোর কথা বলেছিলেন।

তবে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তা পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার আগেই পটপরিবর্তন হয়। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট সেনাবাহিনীর একদল সদস্য শেখ মুজিবকে সপরিবারে হত্যা করে।

পঞ্চম সংশোধনী: সামরিক শাসনের বৈধতা

শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসন যে জারি করা হয়েছিল, তার বৈধতা দেওয়া হয়েছিল এই সংশোধনীর মাধ্যমে।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে সামরিক শাসন জারি করেছিলেন।

শেখ মুজিবের হত্যাকারীদের বিচার যাতে করা না যায়, সে ব্যাপারে তিনি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশও জারি করেছিলেন। তিনি মাত্র ৮৩ দিন ক্ষমতায় ছিলেন।

সে সময় সেনাবাহিনীতে একের পর এক অভ্যুত্থান পাল্টা অভ্যুত্থানে ভেঙে পড়েছিল চেইন অব কমান্ড।

এমন প্রেক্ষাপটে এক অভ্যুত্থানের মধ্যে (সিপাহী অভ্যুত্থান হিসাবে পরিচিত) তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসেন ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর।

তিনি একদলীয় শাসনব্যবস্থার বদলে বহুদলীয় ব্যবস্থা আবার চালু করেন। তবে সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে না গিয়ে তিনি রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পদ্ধতি বহাল রাখেন। তিনি জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রেও পরিবর্তন আনেন। বাঙালির বদলে করা হয় বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল পর্যন্ত সামরিক শাসনের সব কর্মকাণ্ডকে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বৈধতা দেওয়া হয়। বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম একটি মৌলিক বিষয় ছিল ধর্ম নিরপেক্ষতা।

জিয়াউর রহমানের সরকার সেখানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ‘বিসমিল্লহির রাহমানির রাহিম’যুক্ত করে।

১৯৭৯ সালের ৬ এপ্রিল বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে তখনকার সংসদ নেতা শাহ আজিজুর রহমান পঞ্চম সংশোধনী বিলটি উত্থাপন করেছিলেন। এটি পাস হয়েছিল ২৪১-০ ভোটে।

তবে দীর্ঘ সময় পর ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের এক রায়ে এই পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে।

ষষ্ঠ সংশোধনী: বিচারপতি সাত্তারের বৈধতা

জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর সংসদে সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথ নিশ্চিত করা হয়েছিল। উনিশ’শ একাশি সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে সেনাবাহিনীর একদল সদস্য রাষ্ট্রপতি এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানকে হত্যা করে।

এক ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানে তার নিহত হওয়ার ঘটনার পর তৎকালীন উপ-রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আব্দুস সাত্তার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেন।

উনিশ’শ একাশি সালের ৮ জুলাই দ্বিতীয় সংসদের অধিবেশন ডেকে সংবিধানের ষষ্ঠ সংশোধনী বিল পাস করা হয়। এর মাধ্যমে বিচারপতি সাত্তারের উপ-রাষ্ট্রপতি পদে বহাল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচনের বিধান নিশ্চিত করা হয়।

সপ্তম সংশোধনী: বৈধতা পায় এরশাদের সামরিক শাসন

বিচারপতি আব্দুস সাত্তারের নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারকে হটিয়ে ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন দেন তৎকালীন সেনাপ্রধান জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।

তিনি ক্ষমতা দখলের পর থেকে ১৯৮৬ সালের ১০ নভেম্বর পর্যন্ত সামরিক শাসন বহাল রেখেছিলেন। তৃতীয় সংসদে সপ্তম সংশোধনীর মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের সেই সামরিক শাসন এবং সে সময়ের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেওয়া হয়েছিল।

সামরিক শাসনের বৈধতা দেওয়ার এই সপ্তম সংশোধনীকেও উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করে ২০১০ সালে।

অষ্টম সংশোধনী: রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম

এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি পুরোপুরি পাল্টে দেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের শাসনে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করা হয়েছিল। আর জেনারেল এরশাদের শাসনামলে সংবিধানে এই অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করা হয়।

জেনারেল এরশাদ ক্ষমতায় থেকে ছোট ছোট কয়েকটি দল নিয়ে ১৯৮৮ সালে সংসদ নির্বাচন করেছিলেন। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত চতুর্থ সংসদে অষ্টম সংশোধনী বিলটি পাস করা হয়েছিল। তার শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল ১৯৮৮ সালের ওই সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল।

বিএনপির সিনিয়র নেতা মওদুদ আহমদ সে সময় জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির নেতা হিসেবে সংসদ নেতা হয়েছিলেন। তিনিই অষ্টম সংশোধনী বিলটি সংসদে তুলেছিলেন। বিলটি পাস হয়েছিল ২৫৪-০ ভোটে।

জেনারেল এরশাদের শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী বামপন্থি দলগুলো ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং এমনকি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপিও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করার ওই সংশোধনীর বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলন করেছিল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সব দলের তীব্র আন্দোলনের মুখে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে জেনারেল এরশাদ তখন সংবিধানে এই অষ্টম সংশোধনী এনেছিলেন।

অষ্টম সংশোধনীতে আরেকটি বড় বিষয় আনা হয়েছিল। সেটি হচ্ছে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা। তবে সে সময়ই সর্বোচ্চ আদালত ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের বেঞ্চ গঠনের বিষয়টি বাতিল করে দেন।

নবম সংশোধনী: একজন কতবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন

উনিশ’শ উননব্বই সালের ১১ জুলাই এই সংশোধনী পাসের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে কিছু বিধান যুক্ত করা হয়। ফলে রাষ্ট্রপতি পদে কোনো ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না। এছাড়া রাষ্ট্রপতি এবং উপ-রাষ্ট্রপতির নির্বাচন একই সাথে করার বিষয়টিও ছিল।

দশম সংশোধনী: রাষ্ট্রপতি নির্বাচন

জেনারেল এরশাদের শাসনের শেষদিকে ১৯৯০ সালের ১২ জুন সংশোধনীটি সংসদে পাস করা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান আনা হয়েছিল এই সংশোধনীতে।

একাদশ সংশোধনী: বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দায়িত্ব

গণঅভ্যুত্থানে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর জেনারেল এরশাদ সরকারের পতনের পর পঞ্চম সংসদের নির্বাচন পরিচালনার জন্য তিন মাসের অন্তর্বর্তীকালীন বা অস্থায়ী একটি সরকার গঠন করা হয়েছিল।

সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল। সেজন্য বিচারপতি আহমদকে প্রথমে উপ-রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং এরপর তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এছাড়া তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর নির্বাচন শেষে প্রধান বিচারপতির পদে ফিরে গিয়েছিলেন। এই দুটি বিষয়ে বৈধতা দেওয়া হয়েছিল সংবিধানের একাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। ১৯৯১ সালে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত পঞ্চম সংসদে এই সংশোধনী পাস করা হয়।

দ্বাদশ সংশোধনী: সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরত

দীর্ঘ ১৬ বছর পর রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার ব্যবস্থা পাল্টিয়ে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনরায় প্রবর্তন করা হয় দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে। জেনারেল এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে সংসদ নির্বাচনে জয়ী বিএনপি সরকার গঠন করলে দলটির নেত্রী খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ নেতা হয়েছিলেন।

বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীর সমর্থন নিতে হয়েছিল। তবে সরকার গঠনে সমর্থন দিলেও জামায়াত সেই সরকারে অংশীদার ছিল না, সেটি ছিল বিএনপির সরকার।

এরশাদবিরোধী আন্দোলনের সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নেতৃত্বে দুটি জোট ও বামপন্থি পাঁচটি দলের জোট-এই তিনটি জোটের রূপরেখায় সংসদীয় পদ্ধতিতে ফিরে যাওয়ার কথা বলা হয়েছিল। ফলে ১৯৯১ এর নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সংসদের শুরুতেই সেই উদ্যোগ নেওয়া হয়।

সংসদীয় পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য দ্বাদশ সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন সংসদ নেতা খালেদা জিয়া।

এই সংশোধনী বিল পাস হয়েছিল সরকারি এবং বিরোধীদলের সদস্যদের ঐকমত্যের ভিত্তিতে। ১৯৯১ সালের ৬ আগস্ট সংসদে সংশোধনীটি পাসের ক্ষেত্রে ৩০৭-০ ভোট পড়েছিল।

ত্রয়োদশ সংশোধনী: তত্ত্বাবধায়ক সরকার

এই সংশোধনীর মাধ্যমে সাধারণ নির্বাচন ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিন মাস মেয়াদের ‘নির্দলীয়’-‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল। একজন প্রধান উপদেষ্টা এবং দশ জন উপদেষ্টা নিয়ে এই সরকার গঠিত হতো। এরশাদ সরকারের পতনের পর একটি অস্থায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ক্ষমতায় এসেছিল।

সেই সরকারের সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগসহ বেশিরভাগ দল এবং অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে সংসদে এবং রাজপথে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

আন্দোলনের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগসহ সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী বিরোধীদলগুলোর ১৪৭ জন সংসদ সদস্য একযোগে সংসদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন ১৯৯৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর।

বিরোধী সদস্যদের আসন শূন্য করা না করার প্রশ্নে সিদ্ধান্ত অনেকদিন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ১৯৯৫ সালের আগস্ট মাসে আসনগুলো শূন্য ঘোষণা করে উপ-নির্বাচন করার উদ্যোগও নেওয়া হয়েছিল।

উপ-নির্বাচন করতে না পেরে বিরোধীদলগুলোর আন্দোলনের মুখে বিএনপি সরকার ১৯৯৫ সালের ২৪ নভেম্বর পঞ্চম জাতীয় সংসদ ভেঙে দিয়েছিল।

আওয়ামী লীগ, বামপন্থি দলগুলো এবং জামায়াতে ইসলামীসহ আন্দোলনকারী দলগুলোর বর্জনের মুখে বিএনপি ষষ্ঠ সংসদ নির্বাচন করেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বিএনপি ছাড়া ওই নির্বাচনে শুধু একটি দল ফ্রিডম পার্টির নেতা চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা এবং ১০ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে সংসদে এসেছিলেন।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ছাড়া বাকি সংশোধনী ছিল রাজনৈতিক
একনজরে সংবিধানের যত সংশোধনী

ষষ্ঠ সংসদে বিএনপির বাইরে একটি দল থেকে একজন সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। ফলে এ সংসদে কোনো বিরোধীদল ছিল না। তবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান হত্যাকাণ্ডে জড়িত (পরে পলাতক অবস্থায় মৃত্যুদণ্ডের সাজাপ্রাপ্ত) এবং চাকরিচ্যুত সেনা কর্মকর্তা খন্দকার আবদুর রশিদকে ওই সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার চেয়ারে বসানো হয়েছিল। সংসদ নেতা এবং প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খালেদা জিয়া।

আওয়ামী লীগসহ বিরোধীদলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য ষষ্ঠ সংসদে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বিল পাস করা হয় ১৯৯৬ সালের ২৭ মার্চ। বিলটি এনেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী জমিরউদ্দিন সরকার।

এরপর ৩০ মার্চ সংসদ ভেঙে দিয়ে সংশোধনী অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল বিএনপি সরকার। ১৯৯৬ সালের ১৯ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ পর্যন্ত মাত্র ১২ দিন টিকেছিল সেই ষষ্ঠ সংসদ।

চতুর্দশ সংশোধনী: সংরক্ষিত মহিলা আসন

খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে ২০০১ সালে বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসার পর এই সংশোধনীর মাধ্যমে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা হয়েছিল।

তবে এই সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেওয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়েছিল। সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শনের বিধানও করা হয়েছিল এর মাধ্যমে।

২০০৪ সালের ১৬ মে সংসদে এই সংশোধনী বিল সংসদে উত্থাপন করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ।

কিন্তু বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানোর ব্যাপারে বিএনপি সরকারের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিল তখনকার বিরোধীদল আওয়ামী লীগ।

নির্বাচন পরিচালনার তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধানে প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগের শর্তগুলোর মধ্যে এক নম্বরেই ছিল যে, সর্বশেষ অবসর নেওয়া প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হবেন। তিনি অসম্মতি জানালে তখন আরও চারটি উপায় নির্ধারণ করা ছিল।

ফলে বিচারপতিদের অবসরের বয়স বাড়ানোর পর তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন নিয়ে জটিলতা দেখা দিলে রাজনৈতিক দলগুলো বিরোধ সংঘাতে রূপ নিয়েছিল।

শেষ পর্যন্ত ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারি করে সেনাবাহিনীর সমর্থনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল।

পঞ্চদশ সংশোধনী: ধর্মনিরপেক্ষতা

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় দফায় সরকার গঠনের দুই বছর পর ২০১১ সালে এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয় ফিরিয়ে আনা হয়। রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি সংযোজন করা হয়। সংবিধানে ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং ধর্মীয় স্বাধীনতা পুনর্বহাল করা হয়। তবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রাখা হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জাতির পিতা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দুই বছর ক্ষমতায় থেকে তারপর নির্বাচন দিয়েছিল। সেই নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়।

বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং ২০১১ সালের মে মাসে সর্বোচ্চ আদালত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সর্ম্পকিত ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে। আদালত অবশ্য বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আরও দুটি সংসদ নির্বাচন হতে পারে।

কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার সেই ব্যবস্থায় আর কোনো নির্বাচন করার সুযোগ না রেখে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। সেখানে ফিরিয়ে আনা হয়েছে রাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন ব্যবস্থা।

এই সংশোধনীতে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার কথা বলা হয়। সে সময় সংসদ ভেঙে না গেলেও কোনো অধিবেশন বসবে না। রাজনৈতিক সেই সরকার শুধু রাষ্ট্রের রুটিন কাজ করবে বলে বিধান রাখা হয়েছে।

তবে বিএনপি এবং জামায়াতে ইসলামীসহ বিভিন্ন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের বিরোধিতা করেছিল। নবম জাতীয় সংসদে সংশোধনীটি পাসের সময় বিএনপি-জামায়াতের সংসদ সদস্যরা অধিবেশনে অনুপস্থিত ছিলেন। তখন সংসদে একমাত্র স্বতন্ত্র সদস্য ফজলুল আজিম বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। আর পক্ষে ভোট পড়েছিল ২৯১টি।

পঞ্চদশ সংশোধনী বিলটি তৎকালীন আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ সংসদে এনেছিলেন ২০১১ সালের জুন মাসে। শুধু একটি সংসদে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত মেয়াদের সপ্তম সংসদে কোনো সংশোধনী আনা হয়নি।

ষোড়শ সংশোধনী: বিচারপতি অপসারণ

এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিলটি সংসদে পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিলটি সংসদে উত্থাপন করেছিলেন।

তবে আপিল বিভাগ ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে অপসারণের ক্ষমতা সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের হাতে ফিরিয়ে নিয়েছিল। পরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সঙ্গে আওয়ামী লীগ সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল।

আওয়ামী লীগ সরকার আপিল বিভাগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করে। দীর্ঘ সময়ে রিভিউ আবেদনের নিষ্পত্তি হয়নি। আর এই রিভিউ আবেদন আদালতে নিষ্পত্তির অপেক্ষায় থাকলেও বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে থাকার সেই সংশোধনী বহাল রয়েছে।

সপ্তদশ সংশোধনী: নারী আসন

এই সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আরও ২৫ বছর বহাল রাখার বিধান আনা হয়। ২০১৮ সালের ৮ জুলাই সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য নির্বাচনের বিধি আরও ২৫ বছর বহাল রাখার প্রস্তাবসংবলিত সংবিধানের সপ্তদশ সংশোধনী বিল পাস হয়েছে। সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে ২৯৮-০ ভোটে বিলটি পাস হয়। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এ প্রস্তাব উত্থাপন করেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সংসদের ২১তম অধিবেশনে দুই দফা বিভক্তি ভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ‘সংবিধান (সপ্তদশ সংশোধন) আইন-২০১৮’ নামে বিলটি পাস হয়।

বিলের সংশোধনীর পক্ষে ‘হ্যাঁ’ভোট পড়ে ২৯৮টি এবং বিলের বিপক্ষে কোনো ‘না’ ভোট পড়েনি। ফলে সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সুপারিশকৃত আকারে বিলটি পাস হয়।

এর আগে সংশোধনীগুলোর ওপর হ্যাঁ ভোট পড়ে ২৯৫টি। সংসদের ৩৫০ জন সংসদ সদস্যের মধ্যে স্পিকার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করার কারণে এবং মৃত্যুজনিত কারণে একটি আসন শূন্য থাকায় মোট ভোট পড়ার কথা ছিল ৩৪৮টি। কিন্তু নারী সদস্যসহ সংসদে ৫০-৫৩ জন সংসদ সদস্য অনুপস্থিত ছিলেন। বিলের ওপর নয়জন স্বতন্ত্র ও বিরোধীদলীয় সদস্যরা জনমত যাচাই-বাছাই কমিটিতে প্রেরণ ও সংশোধনী প্রস্তাব আনলেও কেউ না ভোটে অংশ নেননি।

এফএইচ/এসএইচএস/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।