অভিমত আইন বিশেষজ্ঞদের

খুনের চেয়েও ভয়াবহ গুম, বিচারে প্রয়োজন আলাদা আইন

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৪ পিএম, ৩০ আগস্ট ২০২৪
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের মতে গত ১৭ বছরে গুম হয়েছেন ৬২৯ জন/ প্রতীকী ছবি

গুমের ঘটনা প্রতিরোধ বা বিচারে দেশে সুনির্দিষ্ট কোনো আইন নেই। এর ফলে গুমের শিকার ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত কিংবা গুম প্রতিরোধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। অপরাধ আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, অপহরণ আইনে বর্তমানে বিচার হলেও ৭ থেকে ৮ বছর গুম করে রাখার অপরাধ হত্যাকাণ্ডের চেয়ে কম নয়। এজন্য গুমের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে দ্রুত আইন করার তাগিদ আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের। আইনজীবীদের মতে, অপহরণ আইনে বিচার নয়, প্রতিটি গুমের সঠিক বিচারে এখনই আলাদা আইন জরুরি।

আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) জানিয়েছে, গত ১৭ বছরে গুম হয়েছেন ৬২৯ জন। তবে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের দাবি, গত ১৬ থেকে ১৭ বছরে দেশে গুমের শিকার ৬৫০ জনের মতো। এদের মধ্যে ৭৮ জনের মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। এখনো নিখোঁজ প্রায় ৪০০ জন। বিচারের যথাযথ কোনো আইন না থাকায় এসব গুমের ঘটনায় সঠিক বিচার করা যায়নি। গুম হওয়ার পর ভয়ঙ্কর বন্দিদশা থেকে ফিরে আসা ভুক্তভোগীরা বলছেন, গুম প্রতিরোধে আইন জরুরি।

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে যুক্ত হলো বাংলাদেশ

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ক্ষমতায় আসে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দল-মত, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষ দেশের সব নাগরিকের মানবাধিকার ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে চায়। বন্ধ করতে চায় দীর্ঘদিন ধরে দেশে চলে আসা গুমের সংস্কৃতি। এ লক্ষ্যে গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে কোনো ধরনের শর্ত ছাড়াই যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।

সমাজে এক ধরনের ভীতি এবং দায়মুক্তির অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই এবং এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সেই অপসংস্কৃতি থেকে উত্তরণে একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

এ সনদে সই করায় রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গুমের জন্য সরকার বা এর যে কোনো প্রতিষ্ঠানকে জবাবদিহির আওতায় আনার বিষয়ে ভূমিকা রাখবে জাতিসংঘ।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) মনে করে, আমাদের সমাজে এক ধরনের ভীতি এবং দায়মুক্তির অপসংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই এবং এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে সেই অপসংস্কৃতি থেকে উত্তরণে একটি দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার।

গুমের মতো অমানবিক অভিযোগ আসার শুরু থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়মিত ও নিয়মতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে এসব দাবি জানিয়ে আসছিল আসক। সংগঠনটি জানায়, জোরপূর্বক গুম থেকে সব নাগরিকের সুরক্ষা এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত ও জড়িতদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। গুম সংক্রান্ত অভিযোগ দায়েরের জন্য অন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা গুম ছিলেন ছয় মাস। এ ভুক্তভোগী বলেন, ‘ছয় মাস তিন দিন র‍্যাব আমাকে গুম করে রাখে। প্রতিটা সেকেন্ড আমি মৃত্যু আতঙ্কে ছিলাম। এই যন্ত্রণা আপনি কোনো কিছুর সঙ্গে মেলাতে পারবেন না। এটা খুন করার চেয়েও বড় অপরাধ।’

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বছরের পর বছর কাউকে অন্ধকার কক্ষে আটকে রাখা হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ। এজন্য গুমের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রেখে আইন করার সুপারিশ তাদের।

ছয় মাস তিন দিন র‍্যাব আমাকে গুম করে রাখে। প্রতিটা সেকেন্ড আমি মৃত্যু আতঙ্কে ছিলাম। এই যন্ত্রণা আপনি কোনো কিছুর সঙ্গে মেলাতে পারবেন না। এটা খুন করার চেয়েও বড় অপরাধ।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান জাগো নিউজকে বলেন, ‘গুম খুনের চেয়ে মারাত্মক। এর বিচার বতর্মানে প্যানাল কোর্টে চলছে। গুমের শিকার ভিকটিমদের পরিবার দাবি জানিয়েছে জড়িতদের বিচারের। অপরাধীদের চিহ্নিত ও জড়িতদের শাস্তির ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে আইন করা যেতে পারে। তবে শুধু আইন করলেই হবে না, আইন কার্যকরও করতে হবে। গুমের ঘটনায় শাস্তি নিশ্চিত হওয়া উচিত দায়ীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের মাধ্যমে।’

তিনি বলেন, ‘জোরপূর্বক গুম থেকে সব নাগরিকের সুরক্ষা এবং গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধান, শনাক্ত ও জড়িতদের সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। গুম সংক্রান্ত অভিযোগ দায়েরের জন্য অন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসরণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।’

একই অভিমত অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার অনিক আর হকের। জাগো নিউজকে তিনি বলেন, ‘গুম খুনের চেয়ে মারাত্মক। একজনকে হত্যা করার পর সবাই জানলো যে তিনি মারা গেছেন বা তাকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু একজন মানুষের বছরের পর বছর ধরে কোনো খোঁজ-খবর না পাওয়া, তার পরিবার, আত্মীয়- স্বজনের উৎকণ্ঠা, সব মিলিয়ে খুনের চেয়ে ভয়াবহ অবস্থা।’

আইন তৈরি করতে হলে তো সংসদের প্রয়োজন। যেহেতু এখন সংসদীয় সরকার নেই, পার্লামেন্ট যেহেতু নেই- তাই এখন আইন করা যাবে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। অর্ডিন্যান্স করা হলে সংবিধান অনুযায়ী নতুন পার্লামেন্টের ৩০ দিনের মধ্যে এটি পাস করানো যাবে।

গত ১৫ বছরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজতে গঠন করা তদন্ত কমিশনের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ব্যারিস্টার অনিক আর হক বলেন, ‘আইন তৈরি করতে হলে তো সংসদের প্রয়োজন। যেহেতু এখন সংসদীয় সরকার নেই, পার্লামেন্ট যেহেতু নেই- তাই এখন আইন করা যাবে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে। অর্ডিন্যান্স করা হলে সংবিধান অনুযায়ী নতুন পার্লামেন্টের ৩০ দিনের মধ্যে এটি পাস করানো যাবে।’

গুম হওয়া ব্যক্তিদের খুঁজতে তদন্ত কমিশন গঠন

আওয়ামী লীগের শাসনামলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গুম হওয়া ব্যক্তিদের সন্ধানে পাঁচ সদস্যের একটি কমিশন গঠন করেছে সরকার। গত ২৭ আগস্ট ‘কমিশন অব ইনকয়ারি অ্যাক্ট, ১৯৫৬’ এর ক্ষমতাবলে এই কমিশন গঠন করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। গঠিত কমিশন তদন্তকাজ শেষ করে ৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করবে।

গুম বন্ধের পাশাপাশি প্রয়োজন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা

গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করতে আওয়ামী লীগ সরকারকে কয়েক দফা চিঠি দেয় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। তবে তাতে সাড়া দেয়নি তৎকালীন সরকার। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর গতকাল ২৯ আগস্ট ৭৬তম দেশ হিসেবে ওই সনদে সই করেছে বাংলাদেশ। এদিন রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে সই করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সব নাগরিকের সুরক্ষায় ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদটি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয়। ৩২টি দেশ এটি অনুস্বাক্ষর করার পর ২০১০ সালে এ সনদের বাস্তবায়ন শুরু হয়। এ সনদের লক্ষ্য হলো- গুম বন্ধের পাশাপাশি ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দেওয়া।

এফএইচ/কেএসআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।