পৃথক সাত মামলা

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ১০:৩২ এএম, ০৪ আগস্ট ২০২৪
হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন। ছবি: সংগৃহীত

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে গত ১৮ ও ১৯ জুলাই মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলা চালানো হয়। সেখানকার নিরাপত্তাকর্মীদের মারধরসহ ভাঙচুর করা হয় স্টেশনের সিসি ক্যামেরা, এলইডি মনিটর, টিকিট সংগ্রহের মেশিনসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম। লুট করা হয় মূল্যবান অনেক জিনিসপত্র। এসব ঘটনায় সাতটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটি মামলা করেছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) কর্তৃপক্ষ, দুটি ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) পুলিশ ও দুটি মামলা করেছে থানা পুলিশ।

থানা পুলিশের মামলায় আসামি করা হয়েছে ১০ হাজার ব্যক্তিকে আর ক্ষতির পরিমাণ ৩৫০ কোটি টাকা। মেট্রোরেল প্রশাসনের মামলায় আসামি করা হয়েছে ২১ হাজার ব্যক্তিকে, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ৩৫০ কোটি টাকা। আর এমআরটি পুলিশের মামলায় আসামি তিন হাজার, ক্ষতির পরিমাণ ১৫ লাখ টাকা বলে এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে। পৃথক দুই ঘটনায় সাত মামলায় আসামি ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই ঘটনায় পৃথক মামলা চলতে পারে না। এক ঘটনায় বিচার একবার হবে। আদালত চাইলে সব মামলার তদন্ত একসঙ্গে করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে দুই ঘটনায় দুটি অভিযোগপত্র দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

এ বিষয়ে ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘একটি ফৌজদারি অপরাধের জন্য একবার বিচার হয়। একই অপরাধের জন্য দুবার বিচার হওয়ার সুযোগ আইনে নেই। আদালত চাইলে সব মামলার তদন্ত একসঙ্গে করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে দুই ঘটনায় দুটি অভিযোগপত্র দিতে পারেন।’

‘একটি ফৌজদারি অপরাধের জন্য একবার বিচার হয়। একই অপরাধের জন্য দুবার বিচার হওয়ার সুযোগ আইনে নেই। আদালত চাইলে সব মামলার তদন্ত একসঙ্গে করার নির্দেশ দিতে পারেন। অথবা মামলাগুলোর তদন্ত শেষে দুই ঘটনায় দুটি অভিযোগপত্র দিতে পারেন।’-অ্যাডভোকেট ফারুক আহম্মেদ, ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল জাগো নিউজকে বলেন, ‘মেট্রোরেল মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলার পৃথক সাত মামলার তদন্ত শেষে বোঝা যাবে কোন মামলা থাকবে আর কোন মামলা থাকবে না। মামলাগুলোর ধারা ভিন্ন হলে অভিযোগপত্র ভিন্ন ভিন্ন হবে। এসব ঘটনায় মামলায় আসামি ও ধারা একই হলে একটি অভিযোগপত্র দেবেন তদন্ত কর্মকর্তা।’

আসামি ২১ হাজার, ক্ষয়ক্ষতি ৩৫০ কোটি

রাজধানীর মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ তিনটি মামলা করেছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে ২১ হাজার অজ্ঞাতনামাকে। হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের কারণে মেট্রোরেলের ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে।

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

কাজীপাড়া স্টেশনে ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা

কাজীপাড়া স্টেশন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ২২ জুলাই ডিএমটিসিএলের এমআরটি লাইন-৬ এর উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) ইমান উদ্দীন কবীর বাদী হয়ে কাফরুল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা পাঁচ-ছয় হাজার জনকে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় মেট্রোরেলের ৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন।

মিরপুর-১০ স্টেশনে ভাঙচুর-লুটপাটে ক্ষতি ২৫০ কোটি টাকা
মিরপুর-১০ স্টেশন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় গত ২৩ জুলাই ডিএমটিসিএলের এমআরটি লাইন-৬ এর উপ-প্রকল্প পরিচালক (প্রশাসন) ইমান উদ্দীন কবীর বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় আট থেকে নয় হাজার জনকে আসামি করা হয়। ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগে মিরপুর-১০ স্টেশনে ২৫০ কোটি টাকার ক্ষতি সাধন হয়েছে বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন।

নিরাপত্তা ব্যবস্থাপকের মামলা
গত ২৩ জুলাই ডিএমটিসিএলের এমআরটি লাইন-৬-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থাপক গোলাম রসূল আজাদ (৫৫) মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতপরিচয় সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার জনকে। এতে কাজীপাড়া স্টেশনের ক্ষতি ৫০ কোটি টাকা হয়েছে বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন।

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

কিশোরের মৃত্যুতে মামলা, মেট্রোরেল ও ডিএনসিসির ক্ষতি ৩৫০ কোটি টাকা
কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি চলাকালে গত ১৯ জুলাই মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে ভাঙচুর এবং পাশে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) অঞ্চল-৪-এর অফিস ভবন ও ময়লা-আবর্জনা পরিবহনের কাজে ব্যবহৃত ট্রাকে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সেখানে তাণ্ডব চলাকালে কামরুল ইসলাম (১৭) নামের এক কিশোর নিহত হয়। ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মেট্রোরেল ও সিটি করপোরেশনের ৩৫০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এই তথ্য উল্লেখ করে গত ২৯ জুলাই মিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হোসেন মোবারক। মামলার এজাহারে অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় ছয় থেকে সাত হাজার জনকে আসামি করা হয়েছে। একই সঙ্গে এজাহারে বলা হয়েছে, কোটা আন্দোলনের আড়ালে বিএনপি, জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীরা এ তাণ্ডব চালিয়েছেন।

‘মেট্রোরেল মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে হামলার পৃথক সাত মামলার তদন্ত শেষে বোঝা যাবে কোন মামলা থাকবে আর কোন মামলা থাকবে না। মামলাগুলোর ধারা ভিন্ন হলে অভিযোগপত্র ভিন্ন ভিন্ন হবে। এসব ঘটনায় মামলায় আসামি ও ধারা একই হলে একটি অভিযোগপত্র দেবেন তদন্ত কর্মকর্তা।’- তাপস কুমার পাল, অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর, ঢাকা মহানগর আদালত

অজ্ঞাতনামা আসামি করে পুলিশের মামলা
মেট্রোরেলে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় গত ২০ জুলাই মিরপুর মডেল থানার এসআই হোসেন মোবারক বাদী হয়ে একটি মামলা করেন। মামলায় দণ্ডবিধির ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৮৬/৩৫৩/৩৩২/৪২৭/৪৩৫/৪৩৬ ধারাসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫ (৩) ধারায় অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে বাদী এজহারে উল্লেখ করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই থেকে তিন হাজার জনকে আসামি করা হয়। মামলায় ক্ষয়ক্ষতির কথা উল্লেখ করা হয়নি।

এমআরটি পুলিশের মামলায় আসামি তিন হাজার, ক্ষতি ১৫ লাখ টাকা

রাজধানীর মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে হামলা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় এমআরটি পুলিশ বাদী হয়ে পৃথক দুটি মামলা করে। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা তিন হাজার ব্যক্তিকে। দুই মামলায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করা হয়েছে ১৫ লাখ টাকা।

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

কাজীপাড়া স্টেশনে ঢুকে নিরাপত্তাকর্মীদের মারধর
গত ২৪ জুলাই এমআরটি পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সামসুল আলম বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। এ মামলায় আসামি করা হয় এক থেকে দেড় হাজার জনকে। আসামিরা দণ্ডবিধির ১৪৩/১৪৭/১৪৮/১৮৬/৩৫৩/৩৩২/৪২৭/৪৪৮/৩৮০/১০৯ ধারাসহ ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ১৫(৩)/২৫(ঘ) ধারায় অপরাধ সংঘটিত করেছেন বলে বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন।

অবৈধভাবে স্টেশনে প্রবেশকারী অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং কাজীপাড়া স্টেশনের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এমআরটির বিভিন্ন স্থাপনা ভাঙচুর করে এবং সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে যায়। যার বর্তমান মূল্য আনুমানিক পাঁচ লাখ ৪০ হাজার টাকা।

একেক মামলায় মেট্রোরেলে একেক রকম ক্ষতি, আসামির সংখ্যাও ভিন্ন

মেট্রো-১০ স্টেশনে ঢুকে ভাঙচুর ও মালামাল চুরি
গত ২৪ জুলাই এমআরটি পুলিশের এএসআই মো. আমিনুল ইসলাম বাদী হয়ে মিরপুর মডেল থানায় একটি মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় অজ্ঞাতনামা এক থেকে দেড় হাজার জনকে।
বাদী এজাহারে উল্লেখ করেন, অবৈধভাবে স্টেশনে প্রবেশকারী অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতকারীরা আমাদের এলোপাতাড়ি মারপিট ও শরীরের বিভিন্ন অংশে সাধারণ জখম করে। তারা অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে ব্যাপক ভাঙচুর ও স্টেশনের মালামাল চুরি করে নাশকতামূলক ক্ষতিকর কার্যকলাপ সংঘটিত করে। এতে আনুমানিক ৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়।

পৃথক মামলার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আল মামুন রাসেল জাগো নিউজকে বলেন, ‘একই বিষয় নিয়ে পৃথক মামলা হলে সিআরপিসির ৪০৩ ধারায় ডাবল জিওপার্ডির আলোকে প্রথম মামলা চলবে। আইনে বাকি মামলাগুলো চলার সুযোগ নেই। যদি এমন হয় যে বিস্ফোরক মামলা, পেনাল কোডের মামলা আলাদা আলাদা হয়েছে। তাহলে দুটা পৃথকভাবে চলবে। কিন্তু প্রত্যেক মামলার মধ্যে বিস্ফোরক ও পেনাল কোডের ধারা নিয়ে আসে তাহলে প্রথমটা ছাড়া বাকি যতগুলো মামলা আছে সেগুলো ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০৩ ধারার আলোকে চলার কোনো সুযোগ নেই। এটা আমাদের আইনে বলা আছে।’

জেএ/এমএমএআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।