ইন্সপেক্টর মামুন হত্যার ৬ বছর

দুবাইয়ে দিব্যি আছেন সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খান, ন্যায়বিচার চায় পরিবার

জাহাঙ্গীর আলম
জাহাঙ্গীর আলম জাহাঙ্গীর আলম , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:৫৪ পিএম, ০৮ জুলাই ২০২৪
আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান

ঠিক ছয় বছর আগে ২০১৮ সালের ৮ জুলাই পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান হত্যার শিকার হন। রক্ত বেরোনো বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত ধারালো অস্ত্র দিয়ে পায়ের আঙুল কেটে তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। এরপর মরদেহ গাজীপুরের একটি বাঁশঝাড়ে নিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান আসামিরা। পরবর্তীকালে এ হত্যাকাণ্ড ঘিরে সামনে আসে বর্তমানে দুবাইয়ের আলোচিত সোনা ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানের নাম। অভিযোগ ওঠে, তার পরামর্শেই ইন্সপেক্টর মামুনকে হত্যা করা হয়েছিল।

এ ঘটনায় মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে ঘটনার পর দিন ৯ জুলাই রাজধানীর বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খানসহ আটজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে ডিবি পুলিশ। এ মামলায় চার্জশিটভুক্ত ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। তবে আরাভ খান এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকায় হতাশ ভুক্তভোগী মামুনের পরিবার।

এ মামলায় আরাভ খানকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি কেন করা হচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন মামুনের পরিবারের সদস্যরা। দীর্ঘদিনেও মামলার বিচার কার্যক্রম নিষ্পত্তি হওয়ায় হতাশ পরিবারটি। তবে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, মামলাটির বিচারকাজ দ্রুত শেষ করা হবে। আরাভ খানসহ সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত হয় সেদিকে খেয়াল রাখবে রাষ্ট্রপক্ষ।

আসামিরা মামুনকে বেঁধে ফেলেন। আসামি মিজান মুখ চেপে ধরলে মামুন তার হাতে কামড় দেন। এসময় মিজান ও দিদার পেছন থেকে মামুনকে ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন রহমত উল্লাহকেও হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। পরে হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থায়ই ইন্সপেক্টর মামুন মারা যান

আলোচিত এ হত্যা মামলাটি ঢাকার প্রথম অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ফয়সল আতিক বিন কাদেরের আদালতে বিচারাধীন। গত ২৩ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমানকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। ওইদিন তার জেরা শেষ হওয়ায় আগামী ২১ জুলাই মামলার পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য নতুন দিন ধার্য করেন আদালত।

আরও পড়ুন

২০১৮ সালের ৯ জুলাই গাজীপুরের জঙ্গল থেকে মামুন ইমরান খানের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় মামুনের বড় ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক শেখ মাহবুবুর রহমান ২০১৯ সালের ৮ এপ্রিল আরাভ খানসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আদালতে চার্জশিট দাখিল করেন। ২০২১ সালের ২৫ নভেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জগঠন করেন আদালত।

আরাভ খান ছাড়া মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সুরাইয়া আক্তার কেয়া, রহমত উল্লাহ, স্বপন সরকার, মিজান শেখ, আতিক হাসান, সারোয়ার হাসান ও দিদার পাঠান। তার মধ্যে আরাভ ও সুরাইয়া পলাতক।

দুবাইয়ে দিব্যি আছেন সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খান, ন্যায়বিচার চায় পরিবার   ইন্সপেক্টর মামুন ইমরান খান

এ মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক দুই আসামি মেহেরুন্নেছা স্বর্ণা ওরফে আফরিন ওরফে আন্নাফী ও মোছা. ফারিয়া বিনতে মিম। তাদের বিরুদ্ধে ভিন্ন দোষীপত্র দাখিল করা হয়। তাদের বিচার শিশু আদালতে চলমান।

হাত-মুখ বাঁধা অবস্থায় মারা যান ইন্সপেক্টর মামুন

মামলার চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, টেলিভিশনে ক্রাইম ফিকশন অনুষ্ঠানে আসামি রহমত উল্লাহর সঙ্গে অভিনয়ের সূত্র ধরেই মামুন ইমরান খানের পরিচয় থেকে বন্ধুত্ব। ওই দুজনের সঙ্গে অভিনয় করতো কিশোরী স্বর্ণা। ওই চক্রের প্রধান রবিউলের স্ত্রী কেয়াকে সে জানায়, রহমত উল্লাহর অনেক টাকা আছে। তাকে ফাঁদে ফেলে টাকা আদায় করা সম্ভব। পরে স্বর্ণা পরিকল্পিতভাবে রহমত উল্লাহকে ফাঁদে ফেলতে জন্মদিনের কথা বলে ফোন দিয়ে আসতে বলে। রহমত তখন মামুনকেও ওই অনুষ্ঠানে আসতে আমন্ত্রণ জানান।

পরে তারা ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বনানীর ওই বাসার নিচে গেলে স্বর্ণা দুজন নারীসহ নিচে আসে। সে ওই দুই নারীর একজনকে বোন এবং অন্যজনকে ভাবি পরিচয় দিয়ে রহমত উল্লাহ ও মামুনকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। বাসায় গিয়ে তারা দেখেন, জন্মদিনের কোনো আয়োজন নেই। চক্রের প্রধান রবিউলের স্ত্রী কেয়া তাদের বসিয়ে রেখে অন্যদের খবর দেন।

আমার ভাইকে হত্যার নাটের গুরু আরাভ খান। তিনি সোনার ব্যবসা করছেন। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি কেন করা হচ্ছে না সেটিই প্রশ্ন। সরকার চাইলে তো সবই পারে। আমি আমার ভাইয়ের হত্যার ন্যায়বিচার চাই। আরাভ খানসহ সব আসামির মৃত্যুদণ্ড চাই।- বাদী জাহাঙ্গীর আলম খান

একপর্যায়ে আসামি স্বপন, দিদার, আতিক, মিজান সেখানে গিয়ে মামুন ও রহমতকে বলেন, তারা বাজে উদ্দেশে ওই বাসায় গিয়েছেন। ইন্সপেক্টর মামুন প্রতিবাদ করলে ওই চারজন তাকে মারধর করেন। পরে আসামিরা মামুনকে বেঁধে ফেলেন। আসামি মিজান মুখ চেপে ধরলে মামুন তার হাতে কামড় দেন। এসময় মিজান ও দিদার পেছন থেকে মামুনকে ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। তখন রহমত উল্লাহকেও হাত-পা বেঁধে ফেলে রাখা হয়। পরে হাত ও মুখ বাঁধা অবস্থাতেই ইন্সপেক্টর মামুন মারা যান।

পায়ের আঙুল কেটে নিশ্চিত করা হয় মৃত্যু

মামলার চার্জশিটে আরও বলা হয়, ওইদিন রাত ১২টার দিকে আসামি স্বপন বলেন, মামুনের হাত-পা কেমন শক্ত মনে হচ্ছে। তখন প্রধান আসামি রবিউল ওরফে আরাভ খানের পরামর্শে স্বপন, আতিক ও দিদার ধারালো অস্ত্র দিয়ে মামুনের পায়ের আঙুল কাটেন। রক্ত বের না হওয়ায় তারা নিশ্চিত হন যে মামুন মারা গেছেন। পরে সকালে স্বপন, দিদার ও আতিক ইন্সপেক্টর মামুনের মরদেহ বস্তায় ভরে রহমত উল্লাহর প্রাইভেটকারে তুলে নেন।

বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলাই ছিল আরাভের কাজ

চার্জশিটে তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, মরদেহ নিয়ে রহমত উল্লাহ গাড়ি চালিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। গাড়িতে দিদার, আতিক, স্বপন ও মিজান ছিলেন। রবিউল প্রাইভেটকারের সামনে মোটরসাইকেলে ছিলেন। বনানী থেকে আবদুল্লাহপুর যাওয়ার পথে তারা একটি বাঁশঝাড়ে নিয়ে ইন্সপেক্টর মামুনের মরদেহে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে যান। এরপর রহমত উল্লাহ গাড়ি চালিয়ে আসামিদের ঢাকায় নিয়ে আসেন। বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে অর্থ আদায় করাই ছিল আরাভ খানসহ ওই চক্রটির কাজ।

আরও পড়ুন

মামলার বাদী নিহত মামুনের ভাই জাহাঙ্গীর আলম খান জাগো নিউজকে বলেন, আমার ভাইকে হত্যার নাটের গুরু রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান। আরাভ দুবাইতে সোনার ব্যবসা করছেন। প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাকে দেশে এনে বিচারের মুখোমুখি কেন করা হচ্ছে না সেটিই প্রশ্ন। সরকার চাইলে তো সবই পারে। আমি আমার ভাইয়ের হত্যার ন্যায়বিচার চাই। আরাভ খানসহ সব আসামির মৃত্যুদণ্ড চাই।

দুবাইয়ে দিব্যি আছেন সোনা ব্যবসায়ী আরাভ খান, ন্যায়বিচার চায় পরিবার   আসামি রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান

রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আব্দুস সাত্তার দুলাল জাগো নিউজকে বলেন, পুলিশ পরিদর্শক মামুন হত্যা মামলাটির বিচারকাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। চার্জশিটভুক্ত ৩৮ জন সাক্ষীর মধ্যে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তাসহ ২৪ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। বাকি কয়েকজনের সাক্ষ্য নিয়ে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ করবো। এরপর আত্মপক্ষ সমর্থন ও যুক্তি উপস্থাপন শেষে রায় ঘোষণার জন্য দিন ধার্য করবেন আদালত। আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তি যেন নিশ্চিত হয় আমরা রাষ্ট্রপক্ষ থেকে সে চেষ্টা করবো।

তিনি আরও বলেন, এ মামলায় রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ও সুরাইয়া আক্তার কেয়া শুরু থেকে পলাতক। তাদের বিরুদ্ধে আদালত থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে। তাদের গ্রেফতারের দায়িত্ব পুলিশের।

অন্যদিকে, আসামি রহমত উল্লাহর আইনজীবী বোরহান উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, এ মামলার মূল আসামি আরাভ খান। তিনি বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার পরিকল্পনা ও নির্দেশনায় ইন্সপেক্টর মামুনকে হত্যা করা হয়। আমার মক্কেল (রহমত উল্লাহ) হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তিনি শুধু হত্যাকাণ্ডের পর মরদেহ সরানোর জন্য বলেছেন। তার বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ২০১ ধারায় অভিযোগ আসে।

জেএ/এমকেআর/এএসএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।