পিবিআইয়ের প্রতিবেদন
মুশতাকের সঙ্গে সংসার মেনে নিতে পারেননি তিশার বাবা
রাজধানীর মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের গভর্নিং বডির সদস্য খন্দকার মুশতাক আহমেদ একই কলেজের শিক্ষার্থী সিনথিয়া ইসলাম তিশাকে বিয়ে করেন। তাদের এই অসম বিয়ে নিয়ে ব্যাপক আলোচনা তৈরি হয়। যদিও শুরু থেকে এ দম্পতি জানান, তারা পরস্পরকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তবে বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠে।
এ বিয়ে মেনে নিতে পারেননি তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম। তিনি বাদী হয়ে মুশতাকের বিরুদ্ধে প্রলোভন ও ধর্ষণের অভিযোগ এনে মামলা করেন। মামলায় কলেজটির অধ্যক্ষ ফাওজিয়া রাশেদীকেও আসামি করা হয়। তদন্তে থানা পুলিশ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
পরে ওই প্রতিবেদনের ওপর মামলার বাদী নারাজি দিলে আদালত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব দেন। পিবিআইও অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেন। প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ভিকটিম (সিনথিয়া ইসলাম তিশা) আইন অনুযায়ী সাবালিকা, তিনি নিজ ইচ্ছায় আসামি মুশতাককে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করছেন। এ বিষয়টি বাদী কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে মামলা দায়ের করেন।
আমার মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। মামলার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা প্রভাবিত হয়ে বাদীপক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ কারণে আমি আবারও নারাজি দিয়েছি। তিশার বাবা সাইফুল ইসলাম
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক শাহীন মিয়া গত ২৫ মে আদালতে এ প্রতিবেদন দাখিল করেন। রোববার (২ জুন) ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে মামলা শুনানির জন্য দিন ধার্য ছিল। এদিন পিবিআইয়ের প্রতিবেদনের ওপরও নারাজি দাখিল করেন মামলার বাদী সাইফুল ইসলাম। আদালত এ বিষয়টির ওপর শুনানির জন্য আগামী ১৩ জুন দিন ধার্য করেছেন।
আরও পড়ুন
প্রতিবেদনে পিবিআইয়ের উপ-পরিদর্শক শাহীন মিয়া উল্লেখ করেন, মামলার বাদীর মেয়েকে (তিশা) আসামি মুশতাক তার গুলশানের বাসায় আটক রেখে জোরপূর্বক ধর্ষণ এবং এ কাজে অধ্যক্ষ ফাওজিয়ার সহায়তা করার অভিযোগে মামলা করা হলেও তদন্তে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণিত হয়নি। বরং ভিকটিম আইনমতে সাবালিকা, তিনি তার নিজ ইচ্ছায় মুশতাককে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করছেন। এ বিষয়টি বাদী কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেছে এবং মেয়ের আইনগত বিয়ের বিষয়টিকে ভুল মনে করে মামলা দায়ের করেন মর্মে তদন্তে প্রতীয়মান হয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা আরও উল্লেখ করেন, বাদীর অভিযোগ পর্যালোচনা করা হয়েছে। সাক্ষীদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ভিকটিমের মেডিকেল পরীক্ষার মতামত, নারী ও শিশু নির্ঘাতন দমন আইন-২০০০ (সংশোধিত/২০০৩) এর ২২ ধারা মোতাবেক বিজ্ঞ আদালতে ভিকটিমের দেওয়া জবানবন্দি পর্যালোচনা করা হয়েছে।
জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, আসামি মুশতাক ও ফাওজিয়া বাদীর মেয়েকে গুলশানের বাসায় আটক রেখে জোরপূর্বক ধর্ষণ এবং সহায়তার অভিযোগে করা মামলায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধনী ২০০৩) এর ৯/১) ৩০ ধারার অপরাধ তদন্তে প্রমাণিত হয়নি। বরং ভিকটিম আইনমতে সাবালিকা, তিনি নিজ ইচ্ছায় মুশতাককে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করছিল। বিষয়টি বাদী কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে, মেয়ের ভবিষ্যৎ নষ্ট হয়ে গেছে এবং মেয়ের আইনগত বিয়ের বিষয়টি ভুল মনে করে মামলা দায়ের করেন মর্মে তদন্তে প্রতীয়মান হওয়ায় মামলার দায় থেকে আসামিদের অব্যাহতি দেওয়ার আবেদন করা হলো।
ভিকটিম (সিনথিয়া ইসলাম তিশা) আইন অনুযায়ী সাবালিকা, তিনি নিজ ইচ্ছায় আসামি মুশতাককে বিয়ে করে তার সঙ্গে সংসার করছেন। এ বিষয়টি বাদী কোনোভাবেই মেনে নিতে না পেরে মামলা দায়ের করেন।- পিবিআই
ওই শিক্ষার্থীর বাবা সাইফুল ইসলাম ২০২৩ সালের ১ আগস্ট আদালতে মামলাটি করেন। বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে গুলশান থানার ওসিকে অভিযোগ এজাহার হিসেবে গণ্য করে নিয়মিত মামলা হিসেবে গ্রহণের আদেশ দেন আদালত।
ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলা থেকে মুশতাকে অব্যাহতির সুপারিশ করে ২০২৩ সালের ৩০ অক্টোবর আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) সোহেল রানা। প্রতিবেদনে মামলা দায়েরে ‘তথ্যগত ভুল হয়েছে’ বলে উল্লেখ করা হয়। একই সঙ্গে প্রতিবেদনে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়।
চলতি বছরের ৩ মার্চ ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শওকত আলীর আদালতে এ নারাজি দাখিল করেন মামলার বাদী। আদালত বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে এ বিষয়ে আদেশের জন্য ১৪ মার্চ দিন ধার্য করেন।
নির্ধারিত দিনে গত ১৪ মার্চ মুশতাক ও ফাওজিয়ার অব্যাহতির সুপারিশ করে পুলিশের দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে বাদীর নারাজি গ্রহণ করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআই) অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এর বিচারক শওকত আলীর আদালত।
পুলিশের প্রতিবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, ভিকটিম আদালতে হাজির হয়ে স্বেচ্ছায় জবানবন্দি দেন। তাতে তিনি জানান ২০২৩ সালের ২৫ মার্চ তিনি স্বেচ্ছায় ১০ লাখ টাকা দেনমোহরে খন্দকার মুশতাক আহমেদকে বিয়ে করেন। বিজয়নগর কাজী অফিসে ইসলামি শরিয়াহ অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয়। ভুক্তভোগী কলেজছাত্রীর বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হলে আসামি মুশতাক তাকে বিয়ে করেন। এক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে কেউ কোনো ধরনের প্ররোচনা দেননি।
আরও পড়ুন
মামলার এজাহারে বাদী সাইফুল ইসলাম উল্লেখ করেন, তার মেয়ে (তিশা) মতিঝিল আইডিয়ালের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী। আসামি মুশতাক বিভিন্ন অজুহাতে কলেজে আসতেন এবং ভুক্তভোগীকে ক্লাস থেকে অধ্যক্ষের কক্ষে ডেকে নিতেন। খোঁজখবর নেওয়ার নামে আসামি ভুক্তভোগীকে বিভিন্নভাবে প্রলোভন দেখিয়ে প্রলুব্ধ করতেন।
‘কিছুদিন পর আসামি মুশতাক ভুক্তভোগীকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কুপ্রস্তাব দেন। এতে রাজি না হওয়ায় তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করেন। পাশাপাশি ভুক্তভোগী ও তার পরিবারকে ঢাকা ছাড়া করবেন বলেও হুমকি দেন মুশতাক।’
এজাহারে আরও বলা হয়, এ ধরনের আচরণের বিষয়ে কলেজের অধ্যক্ষকে (২ নম্বর আসামি) ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন ভুক্তভোগীর বাবা। তিনি (অধ্যক্ষ) ‘ব্যবস্থা নিচ্ছি’ বলে আসামি মুশতাককে তার কক্ষে ডাকেন। পরে ভুক্তভোগীকেও ক্লাস থেকে ডেকে এনে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দিয়ে মুশতাককে সময় ও সঙ্গ দিতেন।
এ বিষয়ে বাদী ২ নম্বর আসামির (অধ্যক্ষ) কাছে প্রতিকার চাইতে গেলেও তিনি কোনো সহযোগিতা করেননি। বরং আসামি মুশতাককে অনৈতিক সাহায্য করতে থাকেন। উপায় না পেয়ে বাদী গত বছরের ১২ জুন তিশাকে ঠাকুরগাঁওয়ের বাড়িতে নিয়ে গেলে আসামি মুশতাক তার লোকজন দিয়ে তাকে অপহরণ করেন। এরপর বাদী জানতে পারেন মুশতাক একেক দিন একেক স্থানে রেখে তিশাকে অনৈতিক কাজে বাধ্য এবং যৌন নিপীড়ন করছেন।
আসামিপক্ষের আইনজীবী জাগো নিউজকে জানিয়েছেন, এ মামলায় মুশতাক ও ফাওজিয়া জামিনে রয়েছেন। আগামী ১৩ জুন বাদীর নারাজির ওপর শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। আশা করি আমরা (আসামিরা) অব্যাহতি পাবো।
এদিকে, বাদী সাইফুল ইসলাম বলেছেন, মুশতাক আমার মেয়েকে প্রলোভন দেখিয়ে ধর্ষণ করেছে। আমি এ ঘটনায় মামলা করি। মামলার পর থানা পুলিশ ঘটনার সত্যতা না পেয়ে আসামিদের অব্যাহতি চেয়ে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। তাতে নারাজি দিলে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। পিবিআইও আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। আমি এর ওপরও নারাজি দিয়েছি। এ বিষয়ে শুনানির জন্য ১৩ জুন দিন ধার্য করেছেন আদালত। আশা করি ন্যায়বিচার পাবো।
‘আমার মেয়ে অপ্রাপ্তবয়স্ক। মামলার অভিযোগের বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তারা প্রভাবিত হয়ে বাদীপক্ষের কারও সঙ্গে যোগাযোগ না করে মনগড়া প্রতিবেদন দাখিল করেন। এ কারণে আমি আবারও নারাজি দিয়েছি’- বলেন বাদী সাইফুল ইসলাম।
জেএ/এমকেআর/জিকেএস