এমপি আনারকে কলকাতায় রিসিভের দায়িত্বে ছিলেন সিলিস্তি
কলকাতার নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে খুন হয় ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার। রহস্যে ঘেরা এ হত্যার পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য সামনে আসছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দেশে গ্রেফতার তিন আসামির মধ্যে আলোচিত নাম সিলিস্তি রহমান। সিলিস্তি আগে থেকেই নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনসে উপস্থিত ছিলেন। হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে এমপি আনারকে রিসিভের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। মামলার রিমান্ড আবেদনে এমন তথ্যই উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান।
শুক্রবার (৩১ মে) দুপুর আট দিনের রিমান্ড শেষে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমানকে আদালতে হাজির করা হয়। এসময় মামলার সুষ্ঠু-তদন্তের জন্য তাদের ফের আট দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার মাহফুজুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শান্ত ইসলাম মল্লিকের আদালত তাদের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আবেদনে আরও যেসব বিষয় উল্লেখ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা
পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির (এমএল-জনযুদ্ধ) সঙ্গে বিরোধ ছিল এমপি আনারের
জিজ্ঞাসাবাদে এক নম্বর আসামি আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া জানিয়েছে নিষিদ্ধ ঘোষিত পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষস্থানীয় নেতা তিনি। তিনি খুলনা, ঝিনাইদহ, যশোরসহ দেশের দক্ষিণাঞ্চলে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের সঙ্গে তার দীর্ঘদিনের বিরোধ ছিল।
অপরদিকে, ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে ভিকটিমের ব্যবসায়িক বিরোধ ছিল। তাই এক নম্বর আসামি শিমুল ভূঁইয়া ও পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন দীর্ঘদিন ধরে আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে আসছিলেন।
আরও পড়ুন
- এমপি আনোয়ারুলের সঙ্গে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব ছিল শিমুলের
- খুলনার চরমপন্থি নেতা শিমুল যেভাবে হয়ে ওঠেন আমানুল্লাহ
এমপি আনারকে দুই বার হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয় আসামিরা
আবেদন তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিরা গত জানুয়ারি ও মার্চ মাসে দুইবার ভিকটিমকে হত্যার পরিকল্পনা করে ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে আক্তারুজ্জামান শাহীন ভারতের কলকাতার নিউটাউন অভিজাত এলাকায় গত ২৫ এপ্রিল একটি ফ্ল্যাট ভাড়া নেয় এবং পরিকল্পনা মোতাবেক ৩০ এপ্রিল শিমুল ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমান বাংলাদেশ থেকে গিয়ে ওই ফ্ল্যাটে ওঠেন এবং অন্যান্য আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে ভিকটিমকে হত্যার দায়িত্ব দিয়ে ১০ মে বাংলাদেশে চলে আসে। পরে আসামি শিমুল ভূঁইয়া ও শাহীনের পরামর্শ মোতাবেক ভিকটিমকে সুকৌশলে ব্যবসার কথা বলে ওই ফ্ল্যাটে দিয়ে যান।পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী এক নম্বর আসামি অন্যান্য আসামিদের সহায়তায় ভিকটিমকে হত্যা করে। এরপর ভিকটিমের হাড় মাংস আলাদা করে এবং মাংসের ছোট ছোট টুকরো করে ওই ফ্ল্যাটের টয়লেটের কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করে এবং হাড়সহ শরীরে অন্যান্য অংশ ট্রলিব্যাগে করে কলকাতার কৃষ্ণমাটি এলাকার জিরানগাছা বাগজোলা খালে ফেলে দেয় বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানায়।
এক নম্বর আসামি শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্য কলকাতায় অবস্থানরত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধিদলের মাধ্যমে কলকাতার তদন্তকারী সংস্থা সিআইডি পুলিশকে জানানো হয়। পরবর্তীতে ওই ফ্ল্যাটের স্যুয়ারেজ লাইনের মাধ্যমে সেপটিক ট্যাংকে জমা হওয়া থেকে মানুষের মাংস সদৃশ বস্তু ২৯ মে উদ্ধার করে কলকাতার সিআইডি পুলিশ, যা ডিএনএ পরীক্ষার মাধ্যমে ভিকটিমের কি না নিশ্চিত হওয়া যাবে মর্মে কলকাতার সিআইডি পুলিশের মাধ্যমে মৌখিকভাবে জানানো হয়।
আরও পড়ুন
ফরেনসিক পরীক্ষায় এমপি আনারের দেহাংশ
ফরেনসিক পরীক্ষায় এমপি আনারের দেহাংশ। এক নম্বর আসামি শিমুল ভূঁইয়া জানান ভিকটিমকে হত্যা করা ও লাশ থেকে হাড় মাংস আলাদা করার কাজে আসামি ফয়সাল, মোস্তাফিজ ও জিহাদ সরাসরি জড়িত ছিলেন এবং হাড় ও শরীরের অন্যান্য অংশ দূরে ফেলে দেওয়ার কাজে সিয়ামসহ অজ্ঞাতনামা ২/১ জন জড়িত ছিলেন।
এরমধ্যে কসাই জিহাদকে কলকাতা পুলিশ গ্রেফতার করেছে বলে জানা যায়। দুই নম্বর আসামি তানভীর ভূঁইয়া (৩০) ঘটনার সময় এক নম্বর আসামির সঙ্গে কলকাতা ছিলেন এবং আসামিকে সহায়তা করে মর্মে প্রাথমিক তদন্তে জানা যায়।
এছাড়া সিলিস্তি ভিকটিমকে হত্যার সময় কলকাতায় ওই ফ্ল্যাটে ছিলেন। হত্যার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভিকটিমকে রিসিভের দায়িত্বে ছিলেন তিনি।
এমপি আনারের লাশের অনেকাংশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, ভিকটিমের মরদেহের অনেকাংশ এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ঘটনায় জড়িত পলাতক মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান শাহীন, সিয়াম, ফয়সাল ও মোস্তাফিজসহ অজ্ঞাতনামা অন্যান্য আসামিদের শনাক্ত ও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। তাই মামলার মূল রহস্য উদঘাটন ও অন্যান্য আসামিদের তথ্য সংগ্রহের স্বার্থে এ তিন আসামিকে আরও আটদিনের রিমান্ডে নিয়ে নিবিড়ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
এর আগে ২৪ মে দুপুর সোয়া ২টার দিকে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তাদের হাজির করা হয়। এসময় মামলার সুষ্ঠু-তদন্তের জন্য তাদের দশদিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মাহফুজুর। শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট দিলরুবা আফরোজ তিথি আটদিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
আগের দিন ২৩ মে সৈয়দ আমানুল্লাহ আমান ওরফে শিমুল ভূঁইয়া, ফয়সাল আলী সাজী ওরফে তানভীর ভূঁইয়া ও সিলিস্তি রহমানকে এ মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়।
আরও পড়ুন
গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ থেকে চুয়াডাঙ্গার দর্শনার গেদে সীমান্ত দিয়ে ভারতে যান এমপি আনার। ওঠেন পশ্চিমবঙ্গে বরাহনগর থানার মণ্ডলপাড়া লেনে গোপাল বিশ্বাস নামে এক বন্ধুর বাড়িতে। পরদিন চিকিৎসক দেখানোর কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকেই রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ আনোয়ারুল আজীম।
বাড়ি থেকে বেরোনোর পাঁচদিন পর গত ১৮ মে বরাহনগর থানায় আনোয়ারুল আজীম নিখোঁজের বিষয়ে একটি জিডি করেন বন্ধু গোপাল বিশ্বাস। এরপরও খোঁজ মেলেনি তিনবারের এ সংসদ সদস্যের। এরপর ২২ মে হঠাৎ খবর ছড়ায়, কলকাতার পার্শ্ববর্তী নিউটাউন এলাকায় বহুতল সঞ্জীবা গার্ডেনমের একটি আবাসিক ভবনের বিইউ ৫৬ নম্বর রুমে খুন হয়েছেন আনোয়ারুল আজীম। ঘরের ভেতর পাওয়া গেছে রক্তের ছাপ। তবে ঘরে মেলেনি মরদেহ।
এদিনই ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করেন তার মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন।
মামলার এজাহারে এমপির মেয়ে উল্লেখ করেন, ৯ মে রাত ৮টার দিকে আমার বাবা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর সংসদ সদস্য ভবনের বাসা থেকে গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হন। ১১ মে ৪টা ৪৫ মিনিটে বাবার সঙ্গে মোবাইলে ভিডিও কলে কথা বললে বাবার কথাবার্তায় কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। এরপর বাবার মোবাইল ফোনে একাধিকবার ফোন দিলে বন্ধ পাই।
‘১৩ মে আমার বাবার ভারতীয় নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপে একটি মেসেজ আসে। মেসেজে লেখা ছিল- ‘আমি হঠাৎ করে দিল্লি যাচ্ছি, আমার সঙ্গে ভিআইপি আছে। আমি অমিত শাহের কাছে যাচ্ছি। আমাকে ফোন দেওয়ার দরকার নেই। পরে ফোন দেবো।’
আরও পড়ুন
‘এ ছাড়া আরও কয়েকটি মেসেজ আসে। মেসেজগুলো বাবার মোবাইল ফোন ব্যবহার করে অপহরণকারীরা করে থাকতে পারে।’
এজাহারে আরও উল্লেখ করা হয়, আমরা বিভিন্ন জায়গায় বাবার খোঁজখবর করতে থাকি। আমার বাবার কোনো সন্ধান না পেয়ে বাবার বন্ধু গোপাল বিশ্বাস কলকাতার বারানগর পুলিশ স্টেশনে সাধারণ ডায়েরি করেন। বাবাকে খোঁজাখুজি অব্যাহত রাখি। পরবর্তীসময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে বাবাকে অপহরণ করেছে। বাবাকে সম্ভাব্য সব স্থানে খোঁজাখুজি করেও পাইনি।
জেএ/এমএএইচ/এএসএম