চাকরির বয়সসীমা
গায়ে দেড় লিটার কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার হুমকি ৩৫ প্রত্যাশীদের
সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা নিয়ে বিতর্ক চলছেই। চলছে আলোচনা-পর্যালোচনাও। এর পক্ষে-বিপক্ষে মতামত দিচ্ছেন অনেকে। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলনে রয়েছেন এক শ্রেণির চাকরিপ্রত্যাশী। তবে বয়সসীমা বাড়ানোর চিন্তাভাবনা যে আপাতত সরকারের নেই, সম্প্রতি সেটি স্পষ্ট করেছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন। ঠিক তার আগেই বসয়সীমা ৩৫ করার সুপারিশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী।
সরকারি চাকরিতে আবেদনের বসয়সীমা বাড়ানোর দাবি নতুন নয়। গত প্রায় দুই দশক ধরে এ বিষয়টি বারবার ঘুরেফিরে গণমাধ্যমের খবরে এসেছে। আন্দোলনকারীরা বলছেন, বিশ্বের বহু দেশে এ বয়সসীমা ৩৫ বা তারও বেশি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটদের কেন বঞ্চিত করা হবে। তারা মনে করেন- বয়স নয়, চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতাই হওয়া উচিত বিবেচ্য বা মানদণ্ড। বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ার বিষয়টিও বয়সসীমা বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সামনে এনেছেন তারা।
বয়সসীমা বাড়ানোর পক্ষে শনিবার (১১ মে) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সভা-সমাবেশ করেন চাকরিপ্রত্যাশী আন্দোলনকারীরা। এক পর্যায়ে সেখান থেকে একটি মিছিল গণভবন অভিমুখে এগোতে থাকলে শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে পুলিশের বাধার মুখে পড়ে।
আন্দোলনকারীরা বলছেন, বিশ্বের বহু দেশে এ বয়সসীমা ৩৫ বা তারও বেশি। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্র্যাজুয়েটদের কেন বঞ্চিত করা হবে। তারা মনে করেন- বয়স নয়, চাকরির ক্ষেত্রে যোগ্যতাই হওয়া উচিত বিবেচ্য বা মানদণ্ড। বাংলাদেশে গড় আয়ু বাড়ার বিষয়টিও বয়সসীমা বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে সামনে এনেছেন তারা
এসময় পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে বলেও অভিযোগ করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিল থেকে বেশ কয়েকজনকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ। পরে তাদের মধ্যে ১২ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ বলছে, গায়ে দেড় লিটার কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যার হুমকি দিয়েছিল বয়সসীমা ৩৫ প্রত্যাশীরা।
আরও পড়ুন
- চাকরির বয়স ৩৫ করার দাবিতে ঢাবিতে সমাবেশ
- চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫, কোটায় ৩৭ বছর করার সুপারিশ
- চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীর ওপর
এ ঘটনায় ‘চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫-প্রত্যাশী সমন্বয় পরিষদ’ এর যুগ্ম আহ্বায়ক মামুন রশিদ রতনসহ ১৪ জনের নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৪০০/৫০০ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) এসএম এলিস মাহমুদ বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় অবৈধভাবে একত্রিত হয়ে সড়ক অবরোধ, অগ্নিসংযোগ ও সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
১৫০০ মিলিলিটার বা দেড় লিটার কেরোসিন তেল ঘটনাস্থল থেকে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করা হয়। আসামিরা বেআইনিভাবে জনতাবদ্ধে পরস্পর যোগসাজসে পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়। তারা যান চলাচল বন্ধ করে যাত্রীদের অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জীবননাশকারী পদার্থ দাহ্য জ্বালানি দিয়ে আত্মহত্যার হুমকিসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদান করেন।- বলছে পুলিশ
মামলায় নামোল্লেখ করা ১৪ আসামি হলেন- মামুন রশিদ রতন, মো. রাসেল, হুমায়ন কবির, মানিক দাস, আল আমিন, শেখ ফরিদ, আজম মোহাম্মদ, সাদ্দাম হোসেন, আব্দুল হাকিম, রিমা আক্তার, শারমিন আক্তার দৃষ্টি, ফাতেমা আক্তার সানজিদা, শরীফুল হাসান শুভ ও খোকন।
মামলার এজহারে বলা হয়, ১৫০০ মিলিলিটার বা দেড় লিটার কেরোসিন তেল ঘটনাস্থল থেকে বিকেল ৪টা ১০ মিনিটে জব্দ তালিকা মূলে জব্দ করা হয়। আসামিরা বেআইনিভাবে জনতাবদ্ধে পরস্পর যোগসাজসে পূর্বপরিকল্পিতভাবে পুলিশের কর্তব্য কাজে বাধা দেয়। তারা যান চলাচল বন্ধ করে যাত্রীদের অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও জীবননাশকারী পদার্থ দাহ্য জ্বালানি দিয়ে আত্মহত্যার হুমকিসহ বিভিন্ন ভয়ভীতি প্রদান করেন।
আসামিরা পুলিশের অনুরোধ শোনেনি। তারা লোহার ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় উঠে আসে এবং পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে জড়ায়। একপর্যায়ে তারা শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে সড়কের ওপর বসে পড়ে। তারা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রীভোগান্তি তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।- মামলার বাদী এসআই এলিস মাহমুদ
কার কাছে কী পরিমাণ কেরোসিন ছিল
মামলার এজহারে বাদী উল্লেখ করেন, আটক আসামি মামুন রশিদ রতনের ডান হাতে থাকা একটি স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পানির বোতলে নীল রংয়ের জ্বালানি তেল কেরোসিন ছিল, যার ওজন ছিল আনুমানিক ৫০০ মিলিলিটার বা আধা লিটার। আসামি রাসেলের ডান হাতে থাকা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পানির বোতলে আনুমানিক ৫০০ মিলিলিটার কেরোসিন, আসামি শারমিন আক্তার দৃষ্টির ডান হাতে থাকা স্বচ্ছ প্লাস্টিকের পানির বোতলে আনুমানিক ৫০০ মিলিলিটার কেরোসিন ছিল। এই তিনজনের হাত থেকে আনুমানিক ১৫০০ মিলিলিটার বা দেড় লিটার কেরোসিন তেল জব্দ করা হয়। মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ১৪৩/১৪৭/১৪৯/১৫২/৩৪১/৪২৭/৫০৬ ধারার অভিযোগ আনা হয়েছে।
একদিন পরই গ্রেফতার ১২ শিক্ষার্থীর জামিন
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে শনিবার (১১ মে) আন্দোলন করতে গিয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ান শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় গ্রেফতার ১২ শিক্ষার্থীর জামিন আবেদন মঞ্জুর করেছেন আদালত। রোববার (১২ মে) শুনানি শেষে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আহম্মেদের আদালত এ আদেশ দেন।
জামিন পাওয়া শিক্ষার্থীরা হলেন— ‘চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫-প্রত্যাশী সমন্বয় পরিষদ’ এর যুগ্ম আহ্বায়ক মো. মামুন রশিদ রতন, সদস্য সচিব মো. রাসেল, হুমায়ন কবির, মানিক দাস, আল আমিন, শেখ ফরিদ, আজম মোহাম্মদ, মো. সাদ্দাম হোসেন, আব্দুল হাকিম, রিমা আক্তার, শারমিন আক্তার দৃষ্টি ও ফাতেমা আক্তার।
এদিন আসামিদের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকাজ শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাদের কারাগারে আটক রাখার আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী তাদের জামিন চেয়ে আবেদন করেন। উভয়পক্ষের শুনানি শেষে আদালত দুই হাজার টাকা মুচলেকায় আসামিদের জামিন মঞ্জুর করেন।
ব্যারিকেড ভেঙে পুলিশের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বসয়সীমা ৩৫ এর দাবিতে কেন্দ্রীয় কমিটির উদ্যোগে শনিবার (১১ মে) বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মোড়ে রাজু ভাস্কর্যের সামনে ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে সভা করেন আসামিরা। তারা টিএসসি থেকে শাহবাগ মোড় ঘেরাও করার উদ্দেশে বিভিন্ন ব্যানার-ফেস্টুন, জীবননাশকারী দাহ্য পদার্থসহ আত্মহত্যার স্লোগান ও বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখিয়ে মিছিল নিয়ে পাবলিক লাইব্রেরির সামনে পাকা রাস্তার ওপর আসে। পুলিশ তাদের পথরোধ করতে সেখানকার সড়কে লোহার ব্যারিকেড দেয়।
আরও পড়ুন
- শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলেন ৩৫ প্রত্যাশী
- চাকরির বয়সসীমা বাড়ালে শিক্ষিত বেকার ভয়াবহ রকম বাড়বে
- চাকরির বয়স ৩৫ প্রত্যাশীদের পদযাত্রায় পুলিশের বাধা
পুলিশের পক্ষ থেকে এসময় আন্দোলনকারীদের রাস্তা ছেড়ে দিতে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু তারা পুলিশের কথা না শুনে ব্যারিকেড ভেঙে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ধাক্কা দিয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবস্থান নেয় এবং রাস্তার ওপর বসে যান চলাচল বন্ধ করে দেয়। এসময় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় এবং বারডেম হাসপাতালে আসা রোগী ও তাদের স্বজনদের যাতায়াতে বিশেষ বিঘ্ন ঘটে। রোগী নিয়ে তারা রাস্তায় আটকা পড়ে আর্তনাদ করতে থাকেন।
পুলিশের সঙ্গে মারামারিতে জড়ান আন্দোলনকারীরা
মামলার এজাহারে আরও বলা হয়, একপর্যায়ে আন্দোলনকারীরা একটি বাসে ভাঙচুর করে এবং তাদের সঙ্গে থাকা দাহ্য পদার্থ দিয়ে আগুন ধরিয়ে উসকানিমূলক স্লোগান দিতে থাকে। এসময় পুলিশ হ্যান্ড মাইক ও মৌখিকভাবে রাস্তা ছেড়ে দিতে তাদের অনুরোধ করলেও তারা কর্ণপাত করেনি। উল্টো তারা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে মারামারিতে জড়ায়।
এ বিষয় মামলার বাদী শাহবাগ থানার এসআই এলিস মাহমুদ জাগো নিউজকে বলেন, আসামিরা পুলিশের অনুরোধ শোনেনি। তারা লোহার ব্যারিকেড ভেঙে রাস্তায় উঠে আসে এবং পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কিতে জড়ায়। একপর্যায়ে তারা শাহবাগ মোড়ে সড়ক অবরোধ করে সড়কের ওপর বসে পড়ে। তারা গাড়ি ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাত্রীভোগান্তি তৈরি হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ১৪ জনের নামোল্লেখ ও ৪০০/৫০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করে মামলা দায়ের হয়।
শাহবাগ থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন কর্মকর্তা পুলিশের এসআই নিজাম উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স ৩৫ করার দাবিতে আন্দোলন করার সময় গ্রেফতার ১২ জনের জামিন মঞ্জুর করেছেন আদালত। বিচারক মামলার এজহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য ১২ জুন দিন ধার্য করেছেন।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মোস্তাজিরুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, অবৈধভাবে জনতাবদ্ধ হয়ে সড়ক অবরোধ, গাড়ি ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সরকারি কাজে বাধা ও আত্মহত্যার হুমকিসহ ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগে ১৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতনামা ৪০০/৫০০ জনকে আসামি করে মামলা হয়েছে। এসআই এস এম এলিস মাহমুদ বাদী হয়ে ১১ মে মামলার এজাহার দায়ের করেন।
চাকরিপ্রত্যাশী আন্দোলনকারীরা বলছেন, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ২৭ থেকে বাড়িয়ে ৩০ করা হয়েছিল ১৯৯১ সালে। পরে ২০১১ সালে অবসরের বয়স ৫৭ থেকে বাড়িয়ে ৫৯ করা হয়। ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারে চাকরির বয়স বাড়ানো বিষয়টি উল্লেখ থাকলেও পরবর্তী সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া মেলেনি। এ সময়ে আন্দোলনকারীরা আমরণ অনশনের মতো কর্মসূচিও দেন।
জেএ/এমকেআর/জিকেএস