যৌন নিপীড়ন বাড়ছে শিক্ষাঙ্গনে, কর্মস্থলে কেমন আছে নারী?
নারীর প্রতি যৌন নিপীড়ন বা সহিংসতা বেড়েই চলছে। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী। অনেক ক্ষেত্রে নীরব থাকছেন, কখনোবা প্রতিবাদে ফুঁসেও উঠছেন। তবে এসব ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শাস্তিমূলক ব্যবস্থায় দৃষ্টান্ত স্থাপন করা যাচ্ছে না। এতে নারীর ভীতি যেমন বাড়ছে, বিপরীতে নিপীড়করা ভেতরে ভেতরে আরও উৎসাহিত হচ্ছেন। শিগগির যৌন নিপীড়নবিরোধী শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে না পারলে এটি সামাজিক ব্যাধিতে রূপ নিতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, সারাদেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যৌন হয়রানির ঘটনা বেড়েছে। প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত- কোথাও থেমে নেই হয়রানি। দেড় দশক আগে উচ্চ আদালতের এক রায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিছু ক্ষেত্রে কমিটি গঠন হয়েছে। তবে দীর্ঘদিনেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার কার্যকারিতা রয়ে গেছে শুধু কাগজে কলমেই। নারীর প্রতি যৌন নির্যাতন ও হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের এ সংক্রান্ত নির্দেশনা কমিটিগুলোকে কার্যকর করে তোলা জরুরি বলে মনে করা হচ্ছে।
২০০৮ সালের ৭ আগস্ট বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী কর্মস্থল এবং শিক্ষাঙ্গনে নারী ও শিশুদের যৌন হয়রানি প্রতিরোধের জন্য দিকনির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে জনস্বার্থে একটি রিট করেন। শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ১৪ মে রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সব প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে অভিযোগ গ্রহণের জন্য ‘যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি’ গঠনসহ বিভিন্ন নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষিকা নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারের বিরুদ্ধে রায় চতুর্থ দফায় পিছিয়েছে। আগামী ৩ জুন রায়ের নতুন তারিখ ধার্য রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু অরিত্রী নয়- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাপড়ুয়া এমন বহু শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা হয়রানির শিকার। যাদের অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাদের বিষয়ে দ্রুত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার
এরপর দীর্ঘ সময়েও হাইকোর্টের নির্দেশনা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা হয়নি। অভিযোগ আছে, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হচ্ছে না। আবার কোথাও কোথাও নির্দেশনা অনুযায়ী কমিটি হলেও সেটি হয় একেবারেই দায়সারাভাবে, যা কার্যত অকার্যকরই থেকে যায়।
আরও পড়ুন
২০০৮ সালের ওই রায়ের পরপরই বহু পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। তবে এসময়ের মধ্যে দেশের সব সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখনো যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে কি না, তার তথ্য সুনির্দিষ্ট করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ। আবার কমিটি গঠন করা হলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থী- শিক্ষক এবং সংশ্লিষ্টরা এ প্রতিরোধ কমিটি সম্পর্কে জানেন না। শিক্ষাঙ্গনে যৌন হয়রানির ঘটনা পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ছেলে শিক্ষার্থী ছাড়াও শিক্ষকরা এখন এসব ঘটনায় অভিযুক্ত হচ্ছেন।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠেছে
আবার ঘটনার পরপরই স্থানীয়ভাবে যৌন হয়রানির মতো ঘটনার মীমাংসা করা হচ্ছে। কখনো কখনো দু-একটি অভিযোগ জমা পড়লেও শিক্ষা কর্মকর্তারা তদন্ত করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে কমিটি থাকার কথা থাকলেও সেটি এখনো হয়নি।
হাইকোর্টের রায়ের ১৩ বছর পর ২০২১ সালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। পরের বছর ২০২২ সালে সব বিচারিক আদালতে এ কমিটি করতে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে চিঠি পাঠানো হয়। তবে, সব আদালতে কমিটি গঠন হয়েছে কি না, তার কোনো সঠিক তথ্য নেই কারও কাছে। অন্যদিকে, সরকারি-বেসরকারি অন্য সব কর্মক্ষেত্রেও যৌন হয়রানি রোধে কমিটি গঠনের তথ্যও অজানা। সবশেষ গত ৩১ মার্চ সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতিতে (বার অ্যাসোসিয়েশনে) যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে। হাইকোর্টের নির্দেশনায় পাঁচ সদস্যের কমিটির কথা বলা হলেও বারের কমিটিতে তিনজন পুরুষ ও ছয়জন নারী নিয়ে নয়জন সদস্য রাখা হয়েছে।
২০১৮ সালের ডিসেম্বরে রাজধানীর স্বনামধন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী অরিত্রী অধিকারী আত্মহত্যা করে। এ ঘটনায় করা মামলায় প্রতিষ্ঠানটির দুই শিক্ষিকা নাজনীন ফেরদৌস ও জিনাত আক্তারের বিরুদ্ধে রায় চতুর্থ দফায় পিছিয়েছে। আগামী ৩ জুন রায়ের নতুন তারিখ ধার্য রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শুধু অরিত্রী নয়- স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদরাসাপড়ুয়া এমন বহু শিক্ষার্থী রয়েছেন যারা হয়রানির শিকার। যাদের অনেকে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে একপর্যায়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তাদের বিষয়ে দ্রুত ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
জানা গেছে, ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ নিয়ে গত ৪ মার্চ বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। পরে এক শিক্ষককে বরখাস্ত ও একজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। একজন ছাত্রীর করা অভিযোগের পর শিক্ষার্থীরা অভিযুক্ত শিক্ষকদের চাকরিচ্যুতির দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করতে শুরু করেন। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কার্যালয়, বিভিন্ন অনুষদ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকে তালা দেন, পরিবহন বন্ধ করে দেন। পরে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কও অবরোধ করেন।
কাজী ফারজানা মিম সম্প্রতি অভিযোগ করেন, তার কোর্স শিক্ষক প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে একাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডেকে ‘যৌন হয়রানি’ করেন। অভিযোগ আনার আড়াই বছর পর গত ২১ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এসব ঘটনায় যৌন হয়রানি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে সেটা কার্যকর কি না- তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন
পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির অভিযোগে মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে গত ১৪ মার্চ চাকরিচ্যুত করা হয়। সেই শিক্ষককে রক্ষার অভিযোগ ওঠা বিভাগীয় চেয়ারম্যান রেজুয়ান আহমেদকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
২০২১ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. সানওয়ার সিরাজকে বরখাস্ত করা হয়। ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ এনেছিলেন এক ছাত্রী। সেই ছাত্রীর অভিযোগ নিয়েও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।
আরও পড়ুন
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ছাত্রী কাজী ফারজানা মিম সম্প্রতি অভিযোগ করেন, তার কোর্স শিক্ষক প্রভাষক আবু শাহেদ ইমন ২০২১ সালে একাডেমিক কাজে তাকে নিজের কক্ষে ডেকে ‘যৌন হয়রানি’ করেন। যৌন হয়রানির অভিযোগ আনার আড়াই বছর পর গত ২১ মার্চ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষক আবু শাহেদ ইমনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। একের পর এক ঘটনায় যৌন হয়রানি বন্ধে বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রতিরোধ কমিটি করা হয়েছে সেটা কার্যকর কি না- তা নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন।
বার অ্যাসোসিয়েশনে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়েছে
জানা গেছে, দেশের পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছরে যৌন হয়রানির যত অভিযোগ জমা পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে কিছু যে নিষ্পত্তি হয়নি তা-ও নয়। তবে সিদ্ধান্ত আসে অনেক দেরিতে, সাজা পর্যাপ্ত কি না তা নিয়েও থাকে প্রশ্ন। কিছু ঘটনা পড়ে থাকে দীর্ঘসূত্রতায়।
এছাড়া যৌন নিপীড়ন নিয়ে দেশে আলাদা কোনো আইন নেই। ২০০৮ সালে এক রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্টের একটি নীতিমালাই এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। সে নীতিমালায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারীকে প্রধান করে যৌন নিপীড়নবিরোধী পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। দেড় দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল’ থাকলেও উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। হাইকোর্ট আলাদা আইন করার কথাও বলেছে। সেই আইন হয়নি ১৫ বছরেও।
নীতিমালা অনুযায়ী সর্বোচ্চ ১২০ কার্যদিবসের মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা থাকলেও শিক্ষক ইমনের বিরুদ্ধে আড়াই বছরেও ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। তাও সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তার প্রসঙ্গটি সামনে আসায় এবার তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
দুই বছর আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ২০০ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখেছেন, নিপীড়নের প্রতি ১০টি ঘটনার মধ্যে ৯টিই চাপা পড়ে যায়। কারণ, অভিযোগ দিলে কাজ হবে, আস্থার এমন পরিবেশ তৈরি হয়নি। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার জরিপেও একই ধরনের চিত্র ফুটে উঠেছে। একাধিক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, অভিযোগকারীর গোপনীয়তা লঙ্ঘন হয়েছে, অভিযোগ করে উল্টো হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।
এ অবস্থায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে উপাচার্যের সরাসরি তত্ত্বাবধানে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটি গঠনের দাবি তোলা হয়েছে। তারা বলছেন, এখন যে সেল আছে তাতে সিন্ডিকেট এবং প্রক্টরিয়াল বডির প্রভাব থাকে, তাই সেখানে অভিযোগ করাও ঝুঁকিপূর্ণ।
শিক্ষকদের বিরুদ্ধে সাজার যে সিদ্ধান্ত আসে, সেগুলো পর্যাপ্ত কি না তা নিয়েও আছে প্রশ্ন। মাঝেমধ্যে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পদোন্নতি আটকে দেওয়া, কোনো কোর্স থেকে দূরে রাখা, বাধ্যতামূলক ছুটি বা এ ধরনের আদেশ আসে। আবার যাদের চাকরিচ্যুত করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে। নীতিমালায় বলা থাকলেও সেগুলো আদালতে পাঠানো হয় না।
যৌন নিপীড়ন নিয়ে দেশে আলাদা কোনো আইন নেই। ২০০৯ সালের ১৪ মে হাইকোর্টের একটি নীতিমালাই এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে প্রতিকার পাওয়ার একমাত্র অবলম্বন। সে নীতিমালায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে নারীকে প্রধান করে যৌন নিপীড়নবিরোধী পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা বলা আছে। দেড় দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, বেশিরভাগ উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেল’ থাকলেও উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। হাইকোর্ট আলাদা আইন করার কথাও বলেছেন। সেই আইন হয়নি ১৫ বছরেও
যৌন হয়রানির এসব ঘটনায় প্রচলিত আইনে বিচার ও শাস্তির মুখোমুখি করার দাবি জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা। তিনি জাগো নিউজকে জানান, এসব যৌন হয়রানির মতো ন্যক্কারজনক ঘটনায় শুধু শিক্ষককে বা দোষীকে সাময়িক ছুটি, চাকরি থেকে বহিষ্কার করা উপযুক্ত কোনো শাস্তি হতে পারে না।
আরও পড়ুন
- ধর্ষণের বিচার না হওয়ার জন্য দায়ী ধর্ষকের রাজনৈতিক পরিচয়
- সর্বোচ্চ বিচারালয়ে আলো ছড়ানো ১০ নারী বিচারপতি
তিনি বলেন, আমার মনে হয় প্রচলিত আইনের (নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন) একটি ধারায় যৌন নিপীড়নের শাস্তির পরিমাণ খুবই নগণ্য। এটা সংশোধন হওয়া দরকার। অন্যের কারণে একজন নারী নির্যাতনের শিকার হবেন। সেটার জন্য আইন হওয়া উচিত, আর আইন না হওয়া পর্যন্ত প্রচলিত আইনে বিচার হওয়া দরকার। অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত কোনো শাস্তি হতে পারে না।
ধর্ষণ-নির্যাতনকে একসঙ্গে ‘না’ বলতে হবে
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্য প্রফেসর ড. বিশ্বজিৎ চন্দ জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও নির্দেশনা বিষয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি ও মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে। অভিযোগ দায়েরের ক্ষেত্রে অভিযোগ বক্সের পাশাপাশি অনলাইনে অভিযোগের ব্যবস্থা এবং ভুক্তভোগী ও অভিযুক্ত উভয়েরই পরিচয় প্রকাশে গোপনীয়তা অবলম্বন করতে হবে। মিথ্যা অভিযোগের প্রমাণ পাওয়া গেলে দায়ী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থার বিধান থাকতে হবে।
সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড লিগ্যাল স্টাডিজ পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুদা জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের ১১ দফা সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও দেশে বিদ্যমান পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীর সম্মানহানির ভয়, যৌন সহিংসতায় ভুক্তভোগী নারীকে সমাজে গ্রহণের মানসিকতা তৈরি না হওয়া এবং বিচারহীনতার কারণে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।
ড. শাহনাজ মনে করেন, সম্পূর্ণ নতুন আইন প্রণয়ন না করে, সংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনসমূহে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করা সম্ভব। যৌন সহিংসতাবিষয়ক অভিযোগের তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত অনুমোদনের সময় সিন্ডিকেট সভায় ক্ষমতাশালী ও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপ বন্ধে নির্বাচনকালীন প্রতিটি রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারনামায় যৌন হয়রানি নিরসনের বিষয়টি বাধ্যতামূলকভাবে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
তদন্ত কীভাবে, শাস্তি কী?
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যৌন নিপীড়নের শাস্তির বিষয়ে কোনো লিখিত বিধান নেই। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেট এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। বিভিন্ন যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলের প্রধানদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিক্ষার্থীরা বিভাগের চেয়ারম্যান, অনুষদের ডিন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও উপাচার্য বরাবর লিখিত অভিযোগ জমা দিতে পারেন। অভিযোগটি উপাচার্য সিন্ডিকেটের সভায় উপস্থাপন করলে একটি ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং’ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখে অভিযোগের সত্যতা পেলে সেটা যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধ সেলে যায়।
এরপর যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল সেটা অধিকতর তদন্ত করে উপাচার্যের কাছে প্রতিবেদন আকারে জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির সুপারিশের জন্য সিন্ডিকেট বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের সুপারিশের ভিত্তিতে সিন্ডিকেট চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি যৌন নিপীড়নবিরোধী সেলে অভিযোগ জমা দেওয়া যায়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পরিস্থিতি যখন নাজুক হয়ে যায়, স্থায়ী বহিষ্কারের সিদ্ধান্তগুলো আসে সাধারণত সে সময়ে।
ব্যবস্থা গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা
হাইকোর্টের নীতিমালায় বলা হয়েছে, ঘটনা ঘটার পর সাধারণভাবে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে অভিযোগ করতে হবে। এরপর অভিযোগ কমিটি আরও ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সুপারিশসহ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবে। প্রয়োজনে আরও ৩০ কার্যদিবস বাড়ানো যাবে।
অভিযুক্তের বিরুদ্ধে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করবে এবং সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কর্মক্ষেত্রের শৃঙ্খলাবিধি অনুসারে ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
অভিযোগটি কোনো দণ্ডযোগ্য অপরাধ হলে সেটি আদালতে পাঠাতে হবে। এ হিসাবে সব অভিযোগ ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। কিন্তু বহু অভিযোগ দিনের পর দিন পড়ে থাকে, প্রতিকার বা এর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় না।
রায়ের ১৩ বছর পর সুপ্রিম কোর্টে কমিটি
রায়ের ১৩ বছর পর ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্টে যৌন নিপীড়ন রোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে যৌন হয়রানির অভিযোগ গ্রহণ, তদন্ত পরিচালনা এবং এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় সুপারিশ করতে ২০২১ সালের নভেম্বরে ৫ সদস্যের সুপ্রিম কোর্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির চেয়ারপারসন করা হয়েছিল আপিল বিভাগের বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথকে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাইকোর্টের বিচারপতি কাজী জিনাত হক, আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল আলম ভূঁইয়া, অ্যাডভোকেট ফওজিয়া করিম ফিরোজ ও অ্যাডভোকেট তামান্না ফেরদৌস। ১৩ বছর আগে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে এ কমিটি গঠন করা হয়।
বিচারিক আদালতে কমিটি গঠনে চিঠি
২০২২ সালের ২৩ মার্চ দেশের সব জেলা জজ আদালত, মহানগর দায়রা জজ আদালত, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে (নিজ প্রতিষ্ঠানে) যৌন হয়রানি রোধে কমিটি গঠনের নির্দেশনা দেয় সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। সুপ্রিম কোর্টের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটির সদস্য ও আপিল বিভাগের রেজিস্ট্রার মো. বদরুল আলম ভূঞার সই করা চিঠিতে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়। নির্দেশনায় ১৫ কার্যদিবসের মধ্যে সব জেলা ও দায়রা জজ, মেট্রোপলিটন দায়রা জজ, চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ও চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেটকে কমিটি গঠন করে সুপ্রিম কোর্টে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়।
২০০৯ সালের ১৪ মে যৌন হয়রানির অভিযোগ তদন্তের জন্য প্রতিটি কর্মক্ষেত্র এবং প্রতিষ্ঠানে একজন নারীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেন হাইকোর্ট। রায়ে বলা হয়েছিল, কমিটির অধিকাংশ সদস্যই নারী হতে হবে। এছাড়া দেশের যে কোনো স্থানে নারী, মেয়ে ও শিশুদের যে কোনো ধরনের শারীরিক, মানসিক বা যৌন হয়রানি রোধে সরকারকে নির্দেশিকা অনুযায়ী একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশনাও দিয়েছেন হাইকোর্ট।
আরও পড়ুন
- বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘যৌন হয়রানি ব্যাধি’, বিপন্ন অভিযোগকারীর শিক্ষাজীবন
- বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭৬ শতাংশ ছাত্রীই যৌন হয়রানির শিকার হন
যৌন হয়রানির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির জাগো নিউজকে বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনার সুষ্ঠু বাস্তবায়নে এ বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি, ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালানো, সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে লিঙ্গ বৈষম্য এবং যৌন সহিংসতা বিষয়ে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহি ও মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদারেরও অভিমত ব্যক্ত করেন তিনি।
কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়ত বাড়ছে নারীর অংশগ্রহণ
মোমতাজ উদ্দিন ফকির বলেন, সরকারি ও বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার মাঝে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। হয়রানি নিরসনে সুনির্দিষ্ট একটি আইন এবং ভুক্তভোগী ও সাক্ষী সুরক্ষা আইন দ্রুত প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আমাদের সময়ে সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি গঠন করা হয়েছে। আশা করবো দেশের সব সরকারি-বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে এ সংক্রান্ত কমিটি গঠন করা হবে।
যৌন হয়রানির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদ্য নির্বাচিত সভাপতি ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন জাগো নিউজকে বলেন, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও বেসরকারিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানির ঘটনা বাড়ছে। আমার কাছে মনে হয়, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে এসব ঘটছে। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের আলোকে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি রোধে কমিটি করলেই হবে না। কমিটি করা উচিত রায় অনুযায়ী। তবে আমি মনে করি, সবার আগে নৈতিকতার শিক্ষা প্রয়োজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ালেখার সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি এবং সুষ্ঠু সংস্কৃতির ধারা গড়ে তুলতে হবে। তা না হলে শুধু কমিটি করে রায় দিয়ে কিছু হবে না।
এ আইনজীবী নেতা আরও বলেন, শিক্ষাকে নৈতিক শিক্ষায় রূপান্তরিত করতে হবে।
অনেক নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও তা প্রকাশ করতে চান না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও এটি হয়। সেখানেও ভুক্তভোগীরা অনেক ক্ষেত্রে নীরব থাকেন। এ বিষয়ে কোনো নারী সহজে মুখ খোলেন না। কারণ, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এবং বন্ধু-স্বজনদের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার শঙ্কা থাকে তার। আবার অনেক সময় একতরফাভাবে ভুক্তভোগীর ওপর দোষ চাপানো হয়। পরে দেখা যায় ওই নারী পুরোপুরি পরিস্থিতির শিকার
বিভিন্ন কারণে এসব ঘটনা ঘটতে পারে। বেকারত্বের কারণেও এসব ঘটে। অনেকে ছাত্রজীবন শেষ হলেও চাকরির আশায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছাড়ে না। লেখাপড়া শেষে কাঙ্ক্ষিত চাকরি না পাওয়ার হতাশায়ও এসব ঘটনা ঘটছে। শিক্ষার মানোন্নয়ন ও দারিদ্র্য বিমোচনে শিক্ষাকে কাজে লাগাতে না পারলে, যোগ্য ও মেধাবী এবং সৎ নৈতিকতাসম্পন্ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে না পারলে যৌন হয়রানি বা যৌন নিপীড়নের মতো কলঙ্কজনক পরিস্থিতি দূর করা সম্ভব নয়।
যৌন হয়রানির বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সহ-সভাপতি অ্যাডভোকেট জেসমিন সুলতানা জাগো নিউজকে বলেন, উচ্চ আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী বহু প্রতিষ্ঠানে এখন পর্যন্ত কমিটি করা হয়নি। বার অ্যাসোসিয়েশনেও কোনো কমিটি ছিল না। এখানে কি নারীরা যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন না? এখানেও বিভিন্নভাবে নারীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। এ নিয়ে একসময় এখানেও কোনো উদ্যোগ ছিল না।
তিনি বলেন, অনেক নারী যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েও তা প্রকাশ করতে চান না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলেও এটি হয়। সেখানেও ভুক্তভোগীরা অনেক ক্ষেত্রে নীরব থাকেন। এ বিষয়ে কোনো নারী সহজে মুখ খোলেন না। কারণ, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এবং বন্ধু-স্বজনদের কাছে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার শঙ্কা থাকে তার। আবার অনেক সময় একতরফাভাবে ভুক্তভোগীর ওপর দোষ চাপানো হয়। পরে দেখা যায় ওই নারী পুরোপুরিই পরিস্থিতির শিকার।
এ নারী আইনজীবী আরও বলেন, একজন ছাত্রী তার শিক্ষকের কাছে গেলে অনেক ক্ষেত্রে কুদৃষ্টিতে পড়েন। তাকে বশ করার চেষ্টা করা হয়। তাকে ব্ল্যাকমেইল করা হয়। একপর্যায়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে কুপ্রস্তাব দেওয়া হয়। তখন ওই ছাত্রী কাউকে কিছু বলে না বা বলতে পারে না। হয়তো সে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। এ ধরনের ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষককে শুধু সাময়িক ছুটি বা বহিষ্কার কোনো উপযুক্ত শাস্তি হতে পারে না।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) বোর্ড অব ট্রাস্টি সদস্য এবং জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জহিরুল ইসলাম (জেড আই) খান পান্না জাগো নিউজকে বলেন, দল-মত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে যৌন হয়রানির বিষয়টি মোকাবিলা করতে হবে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিকভাবে প্ররোচিত নিয়োগের দৌরাত্ম্য হ্রাস করতে হবে। একই সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে যদি কোনো সিদ্ধান্ত নেন, তবে তার এবং তার পরিবারের নিরাপত্তা কীভাবে নিশ্চিত করা যেতে পারে তা নিয়ে ভাবার সময় এসেছে।
আরও পড়ুন
কেমন শাস্তি হওয়া উচিত- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০০৯ সালে হাইকোর্ট যৌন নিপীড়নের শাস্তির বিষয়ে যে নির্দেশনা দিয়েছেন সেটা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মানা হচ্ছে না। সেখানে কিন্তু উল্লেখ করা আছে, কোন অপরাধে কী শাস্তি হবে। তারপরও যদি এটা যথার্থ না হয়, তার জন্য আমরা একটা আইন করতে পারি। কতটুকু অপরাধের জন্য কতটুকু শাস্তি হবে, সেটা নিয়ে আইন থাকা দরকার।
নারীর প্রতি নির্যাতন-সহিংসতা রুখে দেওয়ার এখনই সময়
‘আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, কোনো শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার শিক্ষকতায় থাকার কোনো অধিকার নেই, তাকে চাকরিচ্যুত করা উচিত। কোনো শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাকে আজীবন বহিষ্কার করা উচিত’- বলেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের আরেক আইনজীবী আইনুন নাহার সিদ্দিকা মনে করেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি নিরসনে উচ্চ আদালতের ১১ দফা সুস্পষ্ট নির্দেশনা সম্বলিত যুগান্তকারী রায়টি প্রদানের ১৫ বছর অতিক্রান্ত হলেও তার যথাযথ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। এর মূল কারণ নির্দেশনা বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণার অপ্রতুলতা, সংশ্লিষ্ট জবাবদিহি ও মনিটরিংয়ের অভাব। উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট রায় থাকা সত্ত্বেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে বিষয়টি মানার বাধ্যবাধকতা নেই, যা আদালতের রায়ের অবমাননার শামিল।
‘বিচার কার্যক্রমে বিলম্বের কারণ খুঁজতে গেলে সিন্ডিকেট বা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ মূল কারণ হিসেবে সামনে চলে আসে। আইনগত দিক থেকে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কেও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে’- বলেন অ্যাডভোকেট আইনুন নাহার সিদ্দিকা।
এফএইচ/এমকেআর/এসএইচএস/এএসএম