ফেরিঘাটে স্কুলছাত্রের মৃত্যু নিয়ে হাইকোর্ট
ব্যর্থতায় দায় নিয়ে পদত্যাগের সংস্কৃতি চালু হতে ৫০০ বছর লাগবে
ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে বাংলাদেশে আরও ৫০০ বছর সময় লাগবে বলে মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে যুগ্ম সচিবের অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি দাঁড় করিয়ে রাখায় অ্যাম্বুলেন্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনায় জারি করা রুলের শুনানিতে এমন মন্তব্য করেন আদালত।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি খিজির হায়াতের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই জারি করা রুলের শুনানিতে এ মন্তব্য করেন হাইকোর্ট।
আদালতে এদিন শুনানি করেন রিটকারী আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. জহির উদ্দিন লিমন। তার সঙ্গে ছিলেন অ্যাডভোকেট মো. জসিম উদ্দিন (গাজি জসিম)। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ মোহাম্মদ সাইফুজ্জামান জামান। এ বিষয়ে আরও শুনানির জন্য আগামী ২১ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি করা হয়েছে।
ফেরিঘাটে স্কুলছাত্র তিতাসের মৃত্যুর ঘটনায় রিটের শুনানিতে আদালত বলেন, ভিআইপি পদমর্যাদায় রাষ্ট্রের দুজনের বাইরে আর যদি কাউকে প্রোটোকল দিতে হয় সেটা সরকারই সিদ্ধান্ত নেবে।
আদালত বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর বাইরে আর কাকে কাকে ভিআইপি প্রোটোকল দেওয়া হবে, নাকি হবে না সেটা রাষ্ট্রের ব্যাপার। তবে জরুরি কাজে পুলিশের গাড়ি ও রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স অগ্রাধিকার দিতে হবে।
এ সময় আইনজীবী বলেন, ফেরির সারেং, ম্যানেজার, ব্যবস্থাপক, সহ-ব্যবস্থাপক ও উচ্চমান সহকারী কথা বলেছেন। তদন্ত কমিটি তাদের বক্তব্য শুনেছে।
তিনি বলেন, অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের অবস্থা খারাপ এটি ফেরি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছিল। ফেরি কর্তৃপক্ষকে ফোন করে জানানো হয় ভিআইপি আছেন রাস্তায়। অথচ তখন খুলনা থেকে ভিআইপি রওনা দিয়েছেন। এর পরে তিন ঘণ্টা দেরি করেও ফেরি ছাড়েনি। ততক্ষণে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে তিতাস ঘোষ মারা গেছে।
এ ঘটনায় দায়ী কে?- এমন অভিযোগ এনে শুনানিতে ইউরোপ-আমেরিকার প্রসঙ্গ টেনে অ্যাডভোকেট জহির উদ্দিন লিমন আদালতকে বলেন, ইউরোপের একটি দেশ রোমানানিয়াতে এক ছাত্রীকে অপহরণের ঘটনায় ২০১৯ সালের জুলাই মাসে শিক্ষামন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশ প্রধানকে বরখাস্ত করেছিলেন সেদেশের প্রধানমন্ত্রী। পরে শিক্ষামন্ত্রী নিজে থেকে পদত্যাগ করেছিলেন।
তখন আদালত বলেন, ব্যর্থতার দায় নিয়ে মন্ত্রীদের পদত্যাগ করার প্রবণতা বা সংস্কৃতি বাংলাদেশে গড়ে উঠতে আরও ৫০০ বছর লাগবে। মন্ত্রীদের বহিষ্কার করতে হবে কেন, বিশ্বের কোনো কোনো দেশে দায় নিয়ে মন্ত্রীরা নিজেরাই পদত্যাগ করেন।
এর আগে ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই ফেরিঘাটে অ্যাম্বুলেন্সে অপেক্ষায় থেকে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুর ঘটনা তদন্তের নির্দেশ দিন হাইকোর্ট। অতিরিক্ত সচিবের নিচে নন, এমন পদমর্যাদার কর্মকর্তার নেতৃত্বে এ তদন্ত করতে বলা হয়।
একই সঙ্গে রুল জারি করেন আদালত। রুলে তিতাসের পরিবারকে কেন তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না- তা জানতে চাওয়া হয়। নৌ মন্ত্রণালয়ের সচিব, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান, যুগ্ম-সচিব আবদুস সবুর মণ্ডল, মাদারীপুরের ডিসি, পুলিশ সুপার, কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটের ব্যবস্থাপক সালাম হোসাইন মিয়া ও কাঁঠালবাড়ি থানার ওসিকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।
এ সংক্রান্ত রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৩১ জুলাই হাইকোর্টের (মরহুম) বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ এ আদেশ দেন।
আদালতে ওইদিন রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মো. জহির উদ্দিন। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এ বি এম আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার।
মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ১ নম্বর ফেরিঘাটে যুগ্ম-সচিবের অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি না ছাড়ায় স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যুতে তিন কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে ২০১৯ সালের ৩০ জুলাই রিট করা হয়। লিগ্যাল সাপোর্ট অ্যান্ড পিপলস রাইটসের চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. জহির উদ্দিন লিমন এ রিট করেন।
ওই বছরের (২০১৯ সালের) ২৫ জুলাই রাতে সরকারের এটুআই প্রকল্পের যুগ্ম-সচিব আবদুস সবুর মণ্ডলের গাড়ির অপেক্ষায় প্রায় তিন ঘণ্টা ফেরি বসে থাকায় ঘাটে আটকে পড়া অ্যাম্বুলেন্সে স্কুলছাত্র তিতাস ঘোষের মৃত্যু হয়। এ ঘটনার চারদিন পর বিষয়টি জানাজানি হলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে তিতাসের মৃত্যু নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হয়। এতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা শুরু হয়।
এফএইচ/কেএসআর/এএসএম