ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে রায়
আইনজীবী-মানবাধিকারকর্মীদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া
ঢাকার শ্রম আদালতে ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ছয় মাসের বিনাশ্রমে কারাদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণার পর সোমবার (১ জানুয়ারি) সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সুব্রত চৌধুরী, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
ড. ইউনূসের সাজা দেশের অসম্মান: মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাবেক মহাসচিব ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকারকর্মী আইরিন খান বলেছেন, সাজার রায়ে বিশ্বে নোবেলজয়ী ড. ইউনূসের কোনো অসম্মান হবে না। আন্তর্জাতিকভাবে তার সম্মান অটুট থাকবে। বরং তার বিরুদ্ধে রায়ের ফলে দেশেরই অসম্মান হবে, দেশের বিচার ব্যবস্থার অসম্মান হবে। তিনি বলেন, ড. ইউনূসকে পৃথিবীর সবাই ভালো করে চেনে। তিনি কী কাজ করেন তা ভালো করে জানে। তাই সাজার রায়ে ড. ইউনূসের অসম্মান হবে না। দেশের আইনের অসম্মান হবে, আদালতের অসম্মান হবে।
আইরিন খান বলেন, বছরের প্রথম দিনে আমরা সবাই স্বপ্ন দেখি বছরটা কেমন যাবে। আমি আশা করি সরকার মানুষের মানবাধিকারের বিষয়ে সচেতন হবে এবং মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করবে। মিথ্যা বিচার করে এবং মিথ্যা কেস এনে কারো লাভ হয় না... শুধু আইন ও বিচার ব্যবস্থাকে অসম্মান করা হয়।
তিনি বলেন, বিদেশের কেউ ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে প্রশংসা করছেন না। বরং সবাই নিন্দা করছেন। বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সরকারকে আগে থেকেই অনুরোধ করেছেন যেন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে এই চার্জগুলো না আনা হয়। এটা যোগ্য কেস নয়। সরকার সে অনুরোধ শোনেনি। তিনি আরও বলেন, যখন ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে চার্জ আনা হয়েছিল... তখন থেকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিন্দা করে আসছে। বাংলাদেশে মানবাধিকার কীভাবে লঙ্ঘন হচ্ছে! নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূসের মানবাধিকার যদি এভাবে লঙ্ঘন হতে পারে... তাহলে আমার-আপনার মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না, তার কি নিশ্চয়তায় আছে? এই মানবাধিকারকর্মী বলেন, এক আইনজীবীর কাছে শুনলাম যে, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার বহু পথ আছে। আমরা আশা করবো আপিলে বিচারকরা যেন আইনের শাসনটা সমুন্নত রাখেন।
ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত ড. ইউনূস: অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়ায় ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে মনে করছেন সরকারবিরোধী রাজনৈতিক জোটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ও বিএনপি জামায়াত ও অন্যান্য আইনজীবীদের মোর্চা সংগঠন ল‘ইয়ার ফ্রন্ট্রের কো কনভেনার অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, আমি এ রায়কে নির্দেশিত রায় বলে মনে করি। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়েছেন ড. ইউনূস। গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী আরও বলেন, বিষয়টি হচ্ছে আমাদের দেশের জনগণের সম্পদ লুণ্ঠন করে যারা ব্যবসা-বাণিজ্য করছে, বিদেশ পাচার করছে, যারা শ্রমিকদের প্রতি অন্যায়-অবিচার করছে, শুধু তাই নয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন লঙ্ঘন করেছে তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখি না। কিন্তু একজন ব্যক্তি যখন দেশের সম্মান বৃদ্ধিতে কাজ করছে, তখন আমরা তাকে বিচারের নামে হয়রানি করতে দেখছি।
শ্রম আদালতে ড. ইউনুসের বিচার দ্রুত শেষ করা হয়েছে: আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, এতো তড়িঘড়ি করে রায় ঘোষণা আমি এর আগে শ্রম আদালতে দেখিনি। আমার একটি মামলা আছে যেটা ২৫ বছর ধরে চলছে। এখন সুপ্রিম কোর্টে হয়তো অন্য একজন আইনজীবী ওই মামলাটি করেছেন। কিন্তু ড. ইউনুসের মামলায় রায় দ্রুত সময়ের মধ্যে হয়েছে সেটা হয়তো কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।
হয়রানি করতেই প্রতিহিংসাবশত এ রায়: অ্যাডভোকেট মাসদু হোসেন তালুকদার
হয়রানি করতেই প্রতিহিংসাবশত ড. ইউনূসকে আসামি করা হয়েছে বলে দাবি করেন অ্যাডভোকেট মাসদু হোসেন তালুকদার। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্ববরেণ্য একজন মানুষ। তিনি শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। অথচ বাংলাদেশে তিনি বারবার নির্যাতিত হচ্ছেন। নিম্ন আদালতকে নিয়ন্ত্রণ করে একজন বিশ্ববরেণ্য মানুষকে সাজা দেওয়া অত্যন্ত দুঃখজনক। এই সাজা কোনোভাবেই আইন সম্মত হয়নি।
ন্যায়বিচার কি হয়েছে সন্দেহ আসিফ নজরুলের
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাজা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, আমাদের সন্দেহ আছে, এটা ন্যায়বিচার হয়েছে কি না? আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেন, আমরা এখানে সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে এসেছি স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে। আমরা মনে করি, ড. ইউনূসের বিচার চলাকালে এবং এর আগে ক্ষমতা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে উনার বিরুদ্ধে জঘন্য মিথ্যাচার ও অপপ্রচার করা হয়েছে। তিনি বলেন, যেভাবে শ্রম আদালত বসেছে, অস্বাভাবিক ঘন ঘন শুনানি হয়েছে... অস্বাভাবিক দ্রুততায় রায় হয়েছে। আমাদের সন্দেহ আছে, এটা ন্যায়বিচার হয়েছে কি না। আর স্যারের প্রতি সংহতি জানাতে এবং বাংলাদেশের মানুষের স্যারের প্রতি যে ভালোবাসা আছে সেটার প্রতিনিধিত্ব করার জন্য আমরা এখানে উপস্থিত হয়েছি।
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে হওয়া মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ ৪ জনকে ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেন আদালত। সোমবার (১ জানুয়ারি) ঢাকার শ্রম আদালত-৩ এর বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এ রায় দেন। শ্রম আইনের ৩০৩ (ঙ) ধারায় সর্বোচ্চ ৬ মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং ৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১০ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অপরদিকে ৩০৭ ধারায় ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অনাদায়ে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেন আদালত। এরপর আসামিপক্ষ আপিলের শর্তে জামিন আবেদন করেন। আদালত সেই আবেদন মঞ্জুর করে ৫ হাজার টাকা বন্ডে এক মাসের জন্য জামিন দেন।
এই সময়ের মধ্যে শ্রমিকদের ক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে যেসব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তা বিধি সংশোধন করে সেসব সুবিধা প্রদান করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
ড. ইউনূসের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার আব্দুল্লাহ আল মামুন ও কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের পক্ষে আইনজীবী মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান উপস্থিত ছিলেন। এছাড়াও রায় শুনতে বিশিষ্ট নাগরিক ও মানবাধিকারকর্মীরা আদালতে উপস্থিত হন।
২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদপ্তরের শ্রম পরিদর্শক আরিফুজ্জামান বাদী হয়ে ড. ইউনূসসহ চার জনের বিরুদ্ধে এ মামলা করেন।
মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ শ্রম বিধিমালা ১০৭ বিধি ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।
এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম