সুপ্রিম কোর্ট

নতুন বছরে শুনানি হতে পারে যেসব মামলার

মুহাম্মদ ফজলুল হক
মুহাম্মদ ফজলুল হক মুহাম্মদ ফজলুল হক , জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৪ পিএম, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৩
ফাইল ছবি

ডিসেম্বর শেষ হতে না হতেই ডঙ্কা বাজছে নতুন বছর স্বাগত জানানোর। বাংলাদেশসহ বিশ্বের দেশে দেশে চলছে ইংরেজি নববর্ষ বরণের জমকালো প্রস্তুতি। ২০২৩ সাল বিদায় জানিয়ে দোরগোড়ায় টোকা দিচ্ছে আরও একটি নতুন বছর, শুরু হচ্ছে ২০২৪ সাল। নতুন বছরটি কেমন কাটবে, নতুন বছরে প্রত্যাশা কী, এসব নিয়েই এখন ভাবনা মানুষের। শঙ্কা ও প্রত্যাশাকে পাশাপাশি রেখেই সবার চোখ এখন আগামীর দিকে। ২০২৪ সালের দিকে।

অন্য সব কর্মস্থলের মতো দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টও বরণ করে নেবে ইংরেজি নববর্ষ। বছরজুড়েই আদালত প্রাঙ্গণ ঘিরে মানুষের বাড়তি নজর থাকে। রায় আসে চাঞ্চল্যকর, বহুল আলোচিত ও ছোট-বড় সব মামলার। আবার বছর শেষেও ঝুলে থাকে অনেক মামলার বিচারকাজ। দেশের বিচারাঙ্গনের জন্য নতুন বছরটি কেমন যাবে, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে কোন মামলাগুলোর বিচার কার্যক্রম দিয়ে বছর শুরু হবে, মানুষের দৃষ্টি রয়েছে সেদিকেও।

আরও পড়ুন: বছরজুড়ে যেমন ছিল সুপ্রিম কোর্ট অঙ্গন

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নতুন বছরের আগমনের অপেক্ষায় দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্ট। গত ১৮ ডিসেম্বর থেকে সাপ্তাহিক, সরকার ঘোষিত ও অবকাশকালীন ছুটি শুরু হয় আপিল বিভাগে। ১ জানুয়ারি সর্বোচ্চ আদালত খোলার প্রথম দিনই এই বিচারাঙ্গন মুখর হবে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের পদচারণায়। নতুন বছরের শুরুতেই বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি এবং আদেশ হওয়ার কথা রয়েছে। এসব মামলা নিয়ে নতুন বছরে সরগরম থাকবে আদালতপাড়া। যার উত্তাপ ছড়াতে পারে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত।

এরমধ্যে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য পদে প্রার্থিতা ফিরে পেতে দায়ের করা আপিল আবেদনগুলো সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির অপেক্ষায়। আপিল বিভাগ খোলার প্রথম দিনই এসব আবেদনের ওপর শুনানি শুরু হতে পারে।

একই সঙ্গে বছরজুড়ে বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত বহুল আলোচিত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী, আদালত অবমাননার অভিযোগে বিএনপির শীর্ষ সাত আইনজীবীর বিরুদ্ধে মামলার শুনানি, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র, বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের সদস্যসচিব ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে আনা আদালত অবমাননার অভিযোগ, জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মসূচি বন্ধ ও দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে আনা আদালত অবমাননার অভিযোগ, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স, ফেনী সোনাগাজীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার ডেথ রেফারেন্স, নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার আসামিদের দায়ের করা আপিল, পিলখানায় সেনা কর্মকর্তাদের নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলা, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামের রিভিউ আবেদন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মামলায় দেখে দেখে আইওর সাক্ষী বাতিলে রিট আবেদন, দুর্নীতি দমন কমিশনের করা অর্থপাচারের বিভিন্ন মামলাসহ আলোচিত নানা ইস্যুতে করা রিট আবেদনের ওপর শুনানি এবছর আদালত অঙ্গনে আলোচনার শীর্ষে থাকবে।

বছরজুড়েই আদালত প্রাঙ্গণ ঘিরে মানুষের বাড়তি নজর থাকে। রায় আসে চাঞ্চল্যকর, বহুল আলোচিত ও ছোট-বড় সব মামলার। আবার বছর শেষেও ঝুলে থাকে অনেক মামলার বিচারকাজ। দেশের আইন অঙ্গনের জন্য নতুন বছরটি কেমন যাবে, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে কোন মামলার বিচার কার্যক্রম দিয়ে বছর শুরু হবে, মানুষের দৃষ্টি রয়েছে সেদিকেও

এছাড়া শ্রম আদালতে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ। পাশাপাশি বিভিন্ন আলোচিত ইস্যুতে রিট মামলাগুলোর শুনানিও রয়েছে উচ্চ আদালতের কার্যতালিকায়।

ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ আবেদনের শুনানি
বহুল আলোচিত বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন বিচারাধীন। বিষয়টি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় অসংখ্য দিন এলেও শেষ পর্যন্ত শুনানি হয়নি। রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে করা আবেদনের শুনানি আগামী ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত মুলতবি করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বেঞ্চ গত ৭ ডিসেম্বর এ আদেশ দেন।

আরও পড়ুন: ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানি ১৮ জানুয়ারি

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। এর বৈধতা নিয়ে করা রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে হাইকোর্টের তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে। একই বছরের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার (এস কে সিনহা) নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতিতে আপিল খারিজ করে রায় দেন।

ওই বছরের ১ আগস্ট আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়। তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা তার লেখা রায়ে গণতন্ত্র, রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, সুশাসন, দুর্নীতি, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ দেন।

এরপর ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন করা হয়।

জামায়াতের কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন
রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধন অবৈধ ঘোষিত বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে করা আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রয়েছে। এ আবেদনের সঙ্গে জামায়াতের আমির, সেক্রেটারি জেনারেলসহ সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদনের শুনানিও হবে বলে জানিয়েছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তানিয়া আমির।

সবশেষ গত ১৯ নভেম্বর রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ।

তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ কয়েকজন (রিটকারী) আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় পৃথক দুটি আবেদন করেন। পরে গত ২৬ জুন আবেদনগুলো আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে উপস্থাপন করা হয়। ওইদিন চেম্বার আদালত আবেদন দুটি আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য পাঠিয়ে দেন। এরমধ্যে ৪২ ব্যক্তি আবেদন দুটিতে পক্ষভুক্ত হতে আবেদন করেন। এই ৪২ ব্যক্তির মধ্যে আছেন- শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য, বীর মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, শিক্ষাবিদ, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, অধিকার কর্মী ও আইনজীবী।

আরও পড়ুন: জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের রায় বহাল

রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০০৯ সালে রিট করেন সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ ব্যক্তি। রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতের নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্টের তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চ। একই সঙ্গে আদালত এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন, যা পরবর্তীসময়ে আপিল হিসেবে রূপান্তরিত হয়। এছাড়া হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে একই বছর দলটির পক্ষ থেকে লিভ টু আপিল করা হয়।

২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

মেয়র তাপসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন আপিল বিভাগে বিচারাধীন। গত ৫ জুন ‘একজন চিফ জাস্টিসকেও নামিয়ে দিয়েছিলাম’- মেয়র তাপসের এ বক্তব্যকে আদালত অবমাননার শামিল উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে এ আবেদন দায়ের করা হয়। আবেদনে আদালত অবমাননামূলক বক্তব্যের কারণে মেয়র তাপসকে আদালতে তলব করার নির্দেশনা চাওয়া হয়।

বিএনপির শীর্ষ ৭ আইনজীবী নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের দুই বিচারপতির পদত্যাগ দাবি করে সংবাদ সম্মেলন ও মিছিল-সমাবেশ করা বিএনপিপন্থি সাত আইনজীবীকে তলব করেন আপিল বিভাগ। আগামী ১৫ জানুয়ারি তাদের আদালতে হাজির হতে বলা হয়েছে। গত ১৫ নভেম্বর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ এ আদেশ দেন।

সাত আইনজীবী হলেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ও বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট ফাহিমা নাসরিন মুন্নি, জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম সুপ্রিম কোর্ট শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট আব্দুল জব্বার ভূঁইয়া, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান খান ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সুপ্রিম কোর্ট শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল।

আরও পড়ুন: বিএনপিপন্থি ৭ আইনজীবীর ব্যাখ্যা তলব, আদেশ ১৫ জানুয়ারি

জাতীয় শোক দিবসের অনুষ্ঠানে ‘আমরা বাংলাদেশের বিচারপতিরা হলাম শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদ’- আপিল বিভাগের এক বিচারপতির এমন বক্তব্যকে কেন্দ্র করে মিছিল-স্লোগান-সভা অব্যাহত রাখায় বিএনপিপন্থি সাত আইনজীবীর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার আবেদন করা হয়। আইনজীবী নাজমুল হুদার পক্ষে অ্যাডভোকেট নাহিদ সুলতানা যুথি এ আবেদন করেন।

একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা
বহুল আলোচিত একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি প্রায় শেষ পর্যায়ে। কিন্তু এখনো পেপারবুক পড়া শেষ হয়নি। অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন জাগো নিউজকে বলেন, এ মামলার পেপারবুক পড়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। দ্রুতই মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষ হয়ে রায়ের জন্য প্রস্তুত হবে। বিচারপতি সহিদুল করিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি চলছে।

আদালত খোলার প্রথম দিনই এই বিচারাঙ্গন মুখর হবে আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থীদের পদচারণায়। নতুন বছরের শুরুতেই বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক ও জনগুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি এবং আদেশ হওয়ার কথা রয়েছে। এসব মামলা নিয়ে নতুন বছরে সরগরম থাকবে আদালতপাড়া। যার উত্তাপ ছড়াতে পারে রাজনৈতিক অঙ্গন পর্যন্ত

গ্রেনেড হামলার ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মতিঝিল থানায় দুটি মামলা করে। একটি হত্যা মামলা, অন্যটি বিস্ফোরক আইনে। ২০০৮ সালের ১১ জুন মামলা দুটির অভিযোগপত্র (চার্জশিট) জমা দেয় পুলিশ। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়া শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে ‘ডাবল’ মৃত্যুদণ্ড দেন ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।

আরও পড়ুন: বিচারকের অসুস্থতায় থমকে আছে মামলার আপিল শুনানি

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। আরও ১১ জনকে কারাদণ্ড দেওয়া হয় বিভিন্ন মেয়াদে। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে লন্ডনে থাকা তারেক রহমানসহ ১৪ জন পলাতক এবং কারাগারে ২৭ জন। আসামিদের মধ্যে জামিনে আছেন ৯ জন।

বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্টে আপিল করেন দণ্ডপ্রাপ্তরা। আপিলের পূর্বপ্রস্তুতির অংশ হিসেবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করা এবং করোনা মহামারিসহ বিভিন্ন কারণে কয়েক বছর মামলাটি উচ্চ আদালতে ছিল শুনানির অপেক্ষায়। ২০২২ সালের ৫ ডিসেম্বর এর অবসান হয়। ওইদিন এ মামলায় আসামিদের করা আপিল আবেদন ও ডেথ রেফারেন্সের ওপর শুনানি শুরু হয়। তবে পরবর্তীসময়ে সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি অসুস্থ থাকায় মামলার কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ হয়ে যায়।

নুসরাত হত্যা: ডেথ রেফারেন্স ও আপিল শুনানি হাইকোর্টে
ফেনীর সোনাগাজীতে নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের করা আপিল এবং জেল আপিল হাইকোর্টের কার্যতালিকায় উঠেছে। শুনানির জন্য হাইকোর্টের বিচারপতি মো. হাবিবুল গণি ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) রাখা হয়।

এ বিষয়ে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার সাবেক অধ্যক্ষ এসএম সিরাজ উদ-দৌলাসহ মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত চার আসামির আইনজীবী জামিউল হক ফয়সল জাগো নিউজকে জানান, মামলাটির শুনানি কার্যতালিকায় রয়েছে। সিরিয়াল অনুসারে শুনানি শুরু হতে পারে। চার আসামির পক্ষে শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।

আরও পড়ুন: নুসরাত হত্যা: ডেথ রেফারেন্স ও আপিল হাইকোর্টের তালিকায়

২০২০ সালে ফেনীর সোনাগাজী সিনিয়র ফাজিল মাদরাসার ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যার ঘটনায় হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিল আবেদন শুনানির জন্য পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) ছাপানোর কাজ শেষ হয়েছে। পেপারবুক প্রস্তুতের পরই তা সরকারি ছাপাখানা বিজি প্রেস থেকে হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির জন্য একটি ডেথ রেফারেন্স বেঞ্চ নির্ধারণ করেন প্রধান বিচারপতি।

মৃত্যুদণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে আজহারুলের রিভিউ
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধকালীন সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামকে মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে আবেদন করা হয়। এতে আজহারুলের দণ্ড থেকে খালাস চাওয়া হয়েছে। নতুন বছরে এ রিভিউ আবেদনের শুনানি হতে পারে।

২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া রায়ে ২, ৩ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। অপহরণ, নির্যাতন, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধ সংক্রান্ত ৫ নম্বর অভিযোগে ২৫ বছর জেল ও ৬ নম্বর অভিযোগে নির্যাতনের দায়ে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এছাড়া ১ নম্বর অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

পরে ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে খালাস চেয়ে ২০১৫ সালের ২৯ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল করেন আজহারুল।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়

ওই আপিলের ওপর ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর রায় ঘোষণা করেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ। আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতিরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে ২, ৩ এবং ৪ নম্বর অভিযোগে আজহারের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রেখে আদেশ দেন। পাশাপাশি ৬ নম্বর অভিযোগের দণ্ডও বহাল রাখেন আপিল বিভাগ। ৫ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেওয়া হয়।

নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন
নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলার রায়ে কাউন্সিলর নুর হোসেন এবং সাবেক র্যাব অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রাখেন হাইকোর্ট। এর আগে এই সাত খুন মামলায় ২৬ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন নারায়ণগঞ্জের একটি আদালত।

দণ্ডপ্রাপ্তদের মধ্যে ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে বাকি ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে তাদের ২০ হাজার টাকা করে জরিমানাও করা হয়। জরিমানার অর্থ অনাদায়ে আরও প্রত্যেককে দুই বছরের সাজার আদেশ দেওয়া হয়। এছাড়া ৯ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে দেওয়া কারাদণ্ডের রায় হাইকোর্টেও বহাল থাকে।

পিলখানা হত্যাকাণ্ড মামলার আপিল শুনানি
দীর্ঘ ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বহুল আলোচিত রাজধানীর পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহে সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের মামলার নিষ্পত্তি এখনো হয়নি। সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের রায় কার্যকর করতে চূড়ান্ত আপিল শুনানির অপেক্ষা করতে হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের খালাস চেয়ে করা আপিল ও মৃত্যুদণ্ড বহাল চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল এখন সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। অন্যদিকে, একই ঘটনায় বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে করা মামলা এখনো নিম্ন আদালতেই বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্ট সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, এ মামলার শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হতে পারে চলতি বছরই।

আরও পড়ুন: ১৫ বছরেও পিলখানা হত্যা মামলার নিষ্পত্তি হয়নি

ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে শ্রম আইন লঙ্ঘনের মামলা
শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলায় রায় ঘোষণার জন্য বছরের প্রথম দিন ১ জানুয়ারি ধার্য রয়েছে। গত ২৪ ডিসেম্বর মামলার যুক্তিতর্ক শুনানি শেষে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা এ দিন ধার্য রাখেন। মামলার অন্য তিন বিবাদী হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও শাহজাহান।

২৪ ডিসেম্বরের যুক্তিতর্ক শুনানিকালে ড. ইউনূসসহ চারজনের সর্বোচ্চ সাজা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান।

ওইদিন শুনানিকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস আদালতে উপস্থিত ছিলেন। তার আইনজীবী আবদুল্লাহ আল মামুন জাগো নিউজকে বলেন, শুনানিতে আমরা ড. ইউনূসসহ চার বিবাদীকে মামলা থেকে খালাস দেওয়ার আর্জি জানিয়েছি। আশা করি, বিবাদীরা ন্যায়বিচার পাবেন।

শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর ড. ইউনূসসহ চারজনের বিরুদ্ধে ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে মামলা করে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর। মামলায় শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে নির্দিষ্ট লভ্যাংশ জমা না দেওয়া, শ্রমিকদের চাকরি স্থায়ী না করা, গণছুটি নগদায়ন না করায় শ্রম আইনের ৪-এর ৭, ৮, ১১৭ ও ২৩৪ ধারায় অভিযোগ আনা হয়।

আরও পড়ুন: শ্রম আইন লঙ্ঘন: ড. ইউনূসের মামলার রায় ১ জানুয়ারি

পরবর্তীকালে ড. ইউনূসসহ বিবাদীরা আদালতের কাছে লিখিত বক্তব্যে দাবি করেন, অসৎ উদ্দেশ্যে এবং মিথ্যা অভিযোগে তাদের বিরুদ্ধে এ মামলা করেছে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর।

এফএইচ/এমকেআর/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।