ভালো বেতনের আশ্বাসে বিদেশে নিয়ে যৌনকর্মীর ফাঁদ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর থানার ৪নং ওয়োর্ডের বাসিন্দা আসমা বেগম। সৌদি আরবে প্রায় দুই বছর গৃহকর্মীর কাজ করে দেশে ফিরেছেন। কিছুদিন পর আসমা আবারও বিদেশে গিয়ে কাজ করার চিন্তা করেন। সাইফুল ইসলাম টুটুল ও তৈয়ব আলীর সঙ্গে কথা বলেন। জর্ডানে গিয়ে ভালো বেতনে চাকরি পাওয়ার আশায় সাইফুল ও তৈয়বের সঙ্গে রাজধানীর বাড্ডার লিংক রোডে টুটুল ওভারসিজে আসমা তার পাসপোর্ট জমা দেন। টুটুল ও তৈয়বসহ আরও ১০-১১ জন সেই অফিসে ছিলেন এবং তারা আসমাকে বলেন, জাল ভিসার মাধ্যমে কোনোরকম খরচ ছাড়াই জর্ডানে গিয়ে বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে তিনি চাকরি করতে পারবেন। তাদের লোভনীয় প্রস্তাবে আসমা রাজি হন।
২০২১ সালের ৯ জুন টুটুল ও তৈয়ব আসমাকে তুর্কিস এয়ার লাইন্সের একটি বিমানে জর্ডানে পাঠিয়ে দেয়। জর্ডান যাওয়ার ৫-৬ দিন পর আসমা তার চাচা ও মাকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে জানান যে, টুটুল-তৈয়ব ও তার সহযোগীরা মানবপাচারকারী চক্রের সদস্য। তাদের সহযোগীরা আসমাকে আটকিয়ে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন করছে। জর্ডানে আসমাকে ভালো কাজ নয় বরং পতিতাবৃত্তির জন্য পাচার করা হয়েছে। এরপর ৪-৫ মাস কেটে গেলেও বাড়ির লোকের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারেননি তিনি।
আরও পড়ুন: ভারত-মালয়েশিয়া-দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রের সমন্বয়ক নদী
এ ঘটনায় আসমার চাচা আশরাফুল ইসলাম র্যাব-৪, মিরপুর-১, ঢাকার অধিনায়ক বরাবর একটি লিখিত আবেদন করেন। র্যাব প্রাথমিক অনুসন্ধান শেষে ঘটনার সত্যতা পেয়ে আটজনকে গ্রেফতার করে। বর্তমানে মামলাটি সিআইডি তদন্তাধীন রয়েছে।
আদালতে বাড়ছে মানবপাচার মামলা-প্রতীকী ছবি
ঘটনা-২
হোসনে আরা লিজা ও শাহনাজ দুই বোন। বড় বোন ঢাকায় বিভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ২০১৭ সালে বাবা-মা মরা ছোট বোন শাহনাজকে ঢাকায় নিয়ে আসেন। কিছুদিনের মধ্যে পূর্বপরিচিত একই এলাকার বাসিন্দা গোলাপীর সঙ্গে শখ্য গড়ে ওঠে শাহনাজের। ভালো কাজসহ নানা সুযোগ-সুবিধার প্রলোভন দেখিয়ে গোলাপী নামের এ নারী ভারতে পাচার করে দেয় শাহনাজকে। বড় বোন লিজা গোলাপীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি তার বোন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবেন না বলে জানান। অসহায় গরিব বড় বোন ২০১৭ সালে ৯ আগস্ট রাজধানীর দক্ষিণখান থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। বোনকে ফিরে পেতে খোঁজখবর চালাতে থাকেন। একপর্যায়ে ভারতে পাচার হাওয়া আফিয়া নামের এক মেয়ের সন্ধান পান লিজা। যাকে গোলাপীসহ অন্য আসামিরা ভারতে পাচার করেছিল। আফিয়ার সঙ্গে কথা বলে লিজা জানতে পারেন তার ছোট বোনকে গোলাপীরা ভারতে পাচার করেছে। তাকে দিল্লিতে রাখা হয়েছে। পরিকল্পিতভাবে দেহব্যবসা করানোর জন্য গোপন পথে তাকে ভারতে পাচার করা হয়েছে।
বাংলাদেশের কোনো নারীকে যদি ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে ভুক্তভোগী আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা এর ব্যবস্থা নেব। বিদেশে গিয়ে যারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বা বিপদে পড়ছেন তারা যেন অবশ্যই আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। তাহলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। যখন কেউ বিদেশে যাবেন তারা যেন ভিসা যাচাই-বাছাই করে যান। তাহলে অনেকটাই প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পাবেন।—আজাদ রহমান
আরও পড়ুন: ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে ভারতে পাচার
ঘটনা জানার পর ২০১৮ সালে লিজা লিগ্যাল এইড অফিসের মাধ্যমে আদালতে একটি মামলা করেন। ২০১৯ সালের ৩ এপ্রিল পুলিশ গোলাপীকে আটক করতে না পারলেও তার সহযোগী জুলেখা ও দুলালকে আটক করে। মামলা চলমান থাকা অবস্থায় ২০২৩ সালের ৮ নভেম্বর বাংলাদেশে ফেরত আসে। পুলিশের মাধ্যমে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন ভুক্তভোগী শাহনাজ।
জবানবন্দিতে শাহনাজ বলেন, গোলাপী তাকে যশোরে নিয়ে যায় এবং সেলাই মেশিনের ভালো কাজ দেবে বলে অবৈধভাবে ভারতে পাচার করে। ভারতে পাচারের পর শাহনাজকে দিল্লিতে একটি বাসায় নিয়ে রাখা হয়। শাহনাজকে দিল্লির যে বাসায় নিয়ে রাখা হয় সে বাসায় ভারতের পুলিশ অভিযান চালিয়ে তাকে আটক করে এবং সে জানতে পারে ওই বাসায় খারাপ কাজ করানো হয়।
আরও পড়ুন: ৪ বছর পর দেশে ফিরেছে ভারতে পাচার হওয়া নারী-শিশু
ভারতে সাত বছর জেল খাটার পর তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হয়। আদালত ২০২৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শাহনাজের জবানবন্দি গ্রহণ করে তার বোন লিজার জিম্মায় তাকে দিয়ে দেয়। বর্তমানে শাহনাজ তার বোন লিজার কাছে আছে।
শুধু আসমা বেগম ও শাহনাজ নন। এভাবে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার নারী পাচারের শিকার হয়ে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর বিশ্বে প্রায় ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি নারী, পুরুষ ও শিশু পাচারের শিকার হয় যাদের বাণিজ্যিকভাবে যৌনকাজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে, বলপূর্বক শ্রম ও ঋণ-দাসত্ব হিসেবে কেনা-বেচা করা হয়। উন্নত জীবন আর ভালো চাকরির প্রলোভনে নারীদের পাচার করার পর শেষ পর্যন্ত তাদের যৌনকর্মীর কাজে বাধ্য করা হচ্ছে। অর্থলোভী, অসৎ ব্যক্তি এবং দালালদের খপ্পরে পড়ে এভাবে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে অনেক জীবন। এসব মানবপাচারকারী অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিনেমার ‘দাদাভাই’র মতো পর্দার অন্তরালে থেকে যাচ্ছেন। তাদের পর্দার অন্তরাল থেকে বের করে এনে আইনের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করা হলে অনেকটাই কমে আসবে মানবপাচার। বিপদে পড়তে হবে না অসহায় নারীদের।
মানবপাচার মামলায় গ্রেফতার আসামিরা-ফাইল ছবি
আরও পড়ুন: মানবপাচার মামলায় জমির-তাসলিমা দম্পতি গ্রেফতার
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ২০২৩ সালে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে মামলা হয়েছে ৬৮৩টি। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট মামলা দাঁড়ায় ৭১৬টি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ২৪৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১২৯টি মামলায়। আসামি করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০৯ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট ১৫ হাজার ১২৬ জনকে। খালাস দেওয়া হয় ১২৭৯ জন আসামিকে। সাজা দেওয়া হয় চার মামলার আসামিকে। বর্তমানে ৭৪৫টি মামলা তদন্তধীন। এদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি নতুন মামলা করা হয়। এদের মধ্যে ৫২টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ৭৩টি মামলা তদন্তাধীন অবস্থায় রয়েছে।
বিশেষ করে ইয়াং মেয়েরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাদের নিয়ে হোটেলে তোলা হয়। আবার অনেক সময় চাকরির প্রলোভন দেওয়া হয়। তারা আশা করে বিদেশে গিয়ে এরকম বিপদে পড়ছেন। এটা দুঃখজনক। ভারতে বেশকিছু মেয়ে এরকম ছিল আমরা অনেককে উদ্ধার করেছি। বিভিন্ন এনজিও যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েদের দেশে ফেরত এনে তাদের শেলটারহোমে রাখে। মেয়েরা অবৈধ পথে গিয়ে এ ধরনের বিপদে পড়ছেন। বৈধ পথে গেলে এ ধরনের বিপদে পড়তে হতো না।—কামাল উদ্দিন আহমেদ
২০২২ সালে মামলা হয়েছে ৫৩টি। ২০২১ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৮টি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৬৯টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৬টি মামলায়। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭৮ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ এদের মধ্যে আরও ১৪ হাজার ২৯২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে ১২১টি মামলার আসামিকে, আর সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলায়। ৮২৬টি মামলা তদন্তাধীন। বিচারাধীন ছিল ৫ হাজার ২৯৫টি মামলা।
আরও পড়ুন: রিফাত হত্যা, টিকটক হৃদয় ও রাতুলের স্বীকারোক্তি
২০২১ সালে মামলা হয়েছে ৫৫৪টি। ২০২০ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাাজর ৫০১টি। এদের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৩৬৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪০টি মামলায়। পূর্ববর্তী মামলাসহ এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ২৪ জনকে। এদের মধ্যে আরও এক লাখ ১৬ হাজার ৩৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে পাঁচ মামলার আসামিকে। সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলার আসামিকে। তদন্তাধীন ছিল ৬ হাজার ৯৫টি মামলা তদন্তাধীন। বিচারাধীন ছিল ৪৫ হাজার ৭০৪টি মামলা।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মানবপাচারের ৭ হাজার ২৩৩টি মামলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ৩৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন ৫ হাজার ৯৭০টি (তদন্তাধীন মামলাসহ)। পুলিশি তদন্ত শেষে বিচারের জন্য বিভিন্ন আদালতে ঝুলছে ৫ হাজার ৭৭টি মামলা। এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত মামলায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ৩০৬ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৬ জনের সাজা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির তথ্য মতে, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে ৫৮০টি যৌন পাচারের এবং ৬ হাজার ৩৭৮টি শ্রম পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত রয়েছে।
মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ১২৪৪টি মামলা নিষ্পত্তি করেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১০৫৩টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছেন ১৪৭ মামলার আসামি। আর সাজা হয়েছে ৪৩টি মামলার আসামিদের।
সাগরে ভেসে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা রোহিঙ্গাদের-ফাইল ছবি
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৩ সালের নভেম্বর পর্যন্ত ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে ২১৮টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন আদালত। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ১৪১টি মামলার আসামি। অব্যাহতি পেয়েছেন ৬৪ মামলার আসামি। আর সাজা দিয়েছেন ১৩ মামলার আসামিকে। ২০২২ সালের ৫৭৬টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। এর মধ্যে ১৪টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৫১৪ মামলার আসামিরা। ২০২১ সালের মোট ৪১৩টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি মামলায় সাজা হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ৩৬১ মামলার আসামিরা। ২০২০ সালের ১২ মার্চ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদালত ৩৭টি মামলা নিষ্পত্তি করেছেন। নিষ্পত্তি হওয়া কোনো মামলায় সাজা হয়নি। বরং সবাই খালাস পেয়েছেন।
আরও পড়ুন: পাঁচদিন সাগরে ভেসে জীবিত তীরে ফিরলেন মালয়েশিয়াগামী ৭০ রোহিঙ্গা
যেসব দেশে আমাদের ভিকটিমরা যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বসা উচিত। সে দেশের পুলিশ বা ইন্টারপোলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আগে ইন্টারপোলের মিটিং হতো। আমি সেখানে যেতাম। এখন আর ইন্টারপোলের মিটিং হয় না। কোনো কিছুই নেই এখন। সব মিলে হচ্ছে-যাচ্ছে-করছে এভাবে চলছে। আইন থেকে শুরু করে সবই আছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। যে ভিকটিম সে ভিকটিমাইজই হচ্ছে। যারা অপরাধী তারা অপরাধ করেই যাচ্ছে।—অ্যাডভোকেট সালমা আলী
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমানে (২০২৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ) ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে ৯৫১টি মামলা বিচারাধীন অবস্থায় রয়েছে। এর মধ্যে থানার মামলাটি ৮৪১টি ও পিটিশন বা নালিশি মামলা ১০৮টি। ট্রাইব্যুনাল গঠন হওয়ার পর থেকে ৮৪টি মামলার আসামিকে জরিমানা দিয়ে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। মানবপাচার পাঁচ বছরের অধিকসময় ধরে চলছে ২৮৫টি মামলা। পাঁচ বছরের অধিকসময় ধরে চলমান মামলাগুলোতে সাক্ষীদের বিরুদ্ধে জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পরও তারা সাক্ষ্য দিতে আদালতে হাজির হচ্ছে না। তাই রাষ্ট্রপক্ষ মামলাগুলো নিষ্পত্তি করতে পারছেন না। একাধিক মামলার নথি ঘেঁটে ও ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এসব মামলার অধিকাংশ ভিকটিমকে বিদেশে নিয়ে যৌনকর্মে বাধ্য করা হচ্ছেন। নিরীহ ভিকটিমরা যৌনকর্মে রাজি না হলে তাদের চালানো হচ্ছে অমানবিক নির্যাতন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তারা যৌনকর্ম করতে বাধ্য হচ্ছে।
মূলহোতাদের শাস্তির আওতায় আনলে কমে আসবে মানবপাচার
মানবপাচার বিশ্বব্যাপী একটি মানবাধিকার সমস্য। আধুনিক দাসত্বের একটি রূপ মানবপাচার। এ সমস্যা সমাধান করতে প্রয়োজন আইনের কঠোর প্রয়োগ। তাই মানবপাচার প্রতিরোধের জন্য ২০১২ সালে ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়ন করা হয়। এ আইনের ৬ ধারায় মানবপাচার নিষিদ্ধ করে এজন্য অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও কমপক্ষে পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। আইনটির ৭ ধারায় সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দণ্ড মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা কমপক্ষে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং কমপক্ষে পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়। এ আইনের অধীনে কৃত অপরাধগুলো আমলযোগ্য এবং তা আপস ও জামিনের অযোগ্য অপরাধ। এ আইনের সঠিক প্রয়োগ করা হলে দেশ থেকে মানবপাচার অনেকটাই কমে আসবে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বা ব্যক্তির মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে বিপদে পরে তাদের তালিকাভুক্ত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেজ্ঞরা।
মানবপাচার নিষিদ্ধকরণ ও দণ্ড
মানবপাচার আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, মানবপাচার অপরাধ সংঘটনকারী কোনো ব্যক্তি অনধিক যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
সংঘবদ্ধ মানবপাচার অপরাধের দণ্ড
মানবপাচার আইনের ৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো সংঘবদ্ধ গোষ্ঠীর একাধিক সদস্য গোষ্ঠীর সকল সদস্যের সাধারণ অভিপ্রায় সাধনের উদ্দেশ্যে কোনো আর্থিক বা অন্য কোনো বস্তুগত বা অবস্তুগত মুনাফা অর্জনের নিমিত্ত এই আইনের অধীন কোনো অপরাধ সংঘটন করিলে উক্ত গোষ্ঠীর প্রত্যেক সদস্য উক্ত অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত হইবে এবং অপরাধ সংঘটনকারী ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ডে বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে বা অন্যূন ৭ (সাত) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) লক্ষ টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা, ষড়যন্ত্র বা প্রচেষ্টা চালানোর দণ্ড
মানবপাচার আইনের ৮ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি মানবপাচার অপরাধ সংঘটনে প্ররোচনা প্রদান করিয়া, ষড়যন্ত্র করিয়া এবং প্রচেষ্টা চালাইয়া অথবা সজ্ঞানে কোনো মানবপাচার অপরাধ সংঘটন বা সংঘটিত করিবার সুযোগ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তাহার সম্পত্তি ব্যবহার করিবার অনুমতি প্রদান করিয়া অথবা কোনো দলিল-দস্তাবেজ গ্রহণ, বাতিল, গোপন, অপসারণ, ধ্বংস বা তাহার স্বত্ব গ্রহণ করিয়া নিজেকে উক্ত অপরাধের সহিত জড়িত করিলে উক্ত ব্যক্তি অনধিক ৭ (সাত) বৎসর এবং অন্যূন ৩ (তিন) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ২০ (বিশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
জবরদস্তি বা দাসত্বমূলক শ্রম বা সেবা প্রদান করিতে বাধ্য করিবার দণ্ড
মানবপাচার আইনের ৯ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি বেআইনিভাবে অন্য কোনো ব্যক্তিকে তাহার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করাইলে অথবা শ্রম বা সেবা প্রদান করিতে বাধ্য করিলে বা ঋণ-দাস করিয়া রাখিলে বা বলপ্রয়োগ বা যে কোনো প্রকার চাপ প্রয়োগ করিলে অথবা করিবার হুমকি প্রদর্শন করিয়া শ্রম বা সেবা আদায় করিলে তিনি অপরাধ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবেন এবং উক্তরূপ অপরাধের জন্য তিনি অনধিক ১২ (বার) বৎসর এবং অন্যূন ৫ (পাঁচ) বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডে এবং অন্যূন ৫০ (পঞ্চাশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হইবেন।
বিশেজ্ঞরা যা বলছেন
ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব জাগো নিউজকে বলেন, ভিসার মধ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান, কত বেতন বিস্তারিত লেখা থাকে। ভিকটিমদের বক্তব্য হচ্ছে তাদের ভালো বেতনের চাকরি দেওয়ার কথা বলে একটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেয় টাকার বিনিময়ে। ওয়ার্ক পারমিট অনুসারে তারা চাকরি পায় না। যে অনুযায়ী চাকরি না পাওয়ায় অনেকে গৃহকর্মী হচ্ছেন, অনেকে হোটেলে গিয়ে যৌনকর্মীর কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। এটাকে রোধ করতে হলে ওই দেশের যে গ্রুপ আছে সেটাকে আইনের আওতায় আনতে হবে। সে দেশে কী হচ্ছে সেটা যদি বাংলাদেশ সরকার বা তদন্ত সংস্থা বা আদালত পুরো চিত্র তুলে ধরতে পারতো তাহলে যে বিষয়টা নিয়ে কাজ করা যেতো।
আসামির বাড়ি থেকে মানবপাচার মামলার বাদীর স্বামী উদ্ধার-ফাইল ছবি
এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের কোনো নারীকে যদি ভালো বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশে নিয়ে যৌনকর্ম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে ভুক্তভোগীরা আমাদের কাছে অভিযোগ দিলে আমরা এর ব্যবস্থা নেব। বিদেশে গিয়ে যারা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বা বিপদে পড়ছেন তারা যেন অবশ্যই আমাদের কাছে অভিযোগ করেন। তাহলে আমরা অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেব। যখন কেউ বিদেশে যাবেন তারা যেন ভিসা যাচাই-বাছাই করে যান। তাহলে অনেকটাই প্রতারণার হাত হতে রক্ষা পাবেন।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কামাল উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ হলো একটা অরজিন কান্ট্রি। ডেসনিনেশন কান্ট্রিগুলোতে মেয়েদের নিয়ে যাওয়া হয়। বিশেষ করে ইয়াং মেয়েরা বেশি যৌন নির্যাতনের শিকার হন। তাদের নিয়ে হোটেলে তোলা হয়। আবার অনেক সময় চাকরির প্রলোভন দেওয়া হয়। তারা আশা করে বিদেশে গিয়ে এরকম বিপদে পড়ছেন। এটা দুঃখজনক। ভারতে বেশকিছু মেয়ে এরকম ছিল আমরা অনেককে উদ্ধার করেছি। বিভিন্ন এনজিও যৌন নির্যাতনের শিকার মেয়েদের দেশে ফেরত এনে তাদের শেলটারহোমে রাখে। মেয়েরা অবৈধ পথে গিয়ে এ ধরনের বিপদে পড়ছেন। বৈধ পথে গেলে এ ধরনের বিপদে পড়তে হতো না।
আমাদের যে কেউ নারী-পুরুষকে বিদেশে ভালো কাজের কথা বলে। তাদের প্রথমেই খোঁজ নিতে হবে চাকরিটা কোথায়, তাদের প্রতিষ্ঠান আছে কি না। কী চাকরি। এটা যেন গোপন না রাখে। দেখা যায় যারা বিদেশ যেতে চায় তারা বেশিরভাগ মানুষ নারী হোক কিংবা পুরুষ তাদের কাজের কথা গোপন রাখে। রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের বলে তুমি এটা কাউকে বলো না এটা বললে তারাও সুযোগ নিতে চাইবে।— শরিফুল হাসান
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী জাগো নিউজকে বলেন, যেসব দেশে আমাদের ভিকটিমরা যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বসা উচিত। সে দেশের পুলিশ বা ইন্টারপোলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আগে ইন্টারপোলের মিটিং হতো। আমি সেখানে যেতাম। এখন আর ইন্টারপোলের মিটিং হয় না। কোনো কিছুই নেই এখন। সব মিলে হচ্ছে-যাচ্ছে-করছে এভাবে চলছে। আইন থেকে শুরু করে সবই আছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। যে ভিকটিম সে ভিকটিমাইজই হচ্ছে। যারা অপরাধী তারা অপরাধ করেই যাচ্ছে। জবাবদিহিতা না থাকায় এমন হচ্ছে। জবাবদিহিতা না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের যে কেউ নারী-পুরুষকে বিদেশে ভালো কাজের কথা বলে। তাদের প্রথমেই খোঁজ নিতে হবে চাকরিটা কোথায়, তাদের প্রতিষ্ঠান আছে কি না। কী চাকরি। এটা যেন গোপন না রাখে। দেখা যায় যারা বিদেশ যেতে চায় তারা বেশিরভাগ মানুষ নারী হোক কিংবা পুরুষ তাদের কাজের কথা গোপন রাখে। রিক্রুটিং এজেন্সি তাদের বলে তুমি এটা কাউকে বলো না এটা বললে তারাও সুযোগ নিতে চাইবে। এ বিষয়গুলো যদি গোপন না রেখে যত বেশি মানুষের সঙ্গে শেয়ার করবে জানবে বা খোঁজখবর নিতে চেষ্টা করবে তখন কিন্তু এ সংকটগুলো কমে আসবে। পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বা ব্যক্তির মাধ্যমে বিদেশ গিয়ে বিপদে পরে সেগুলো তালিকাভুক্ত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী খালিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধে ২০১২ সালে আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। যারা মানবপাচারের সঙ্গে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রকৃত অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনলে মানবপাচার অনেকটাই কমে আসবে। এছাড়া মানবপাচারের মূল চক্রকে আইনের আওতায় আনতে হবে। তদন্তের দুর্বলতার কারণে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে। তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
জেএ/এসএইচএস/জিকেএস