ঘটনা বিদেশে তদন্ত হয় দেশে
প্রেমের সম্পর্ক থেকে কুষ্টিয়ার বৃষ্টি আক্তার (২০) মিরপুরের জাহিদুল ইসলাম রনিকে (২৭) বিয়ে করেন। বিয়ের পর তারা রাজধানীর ডেমরায় একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতেন। বৃষ্টি গার্মেন্টে চাকরি করতেন আর রনি বাসের হেলপারি করতেন। তাদের অল্প আয়ের সংসারে অভাব-অনটন লেগেই ছিল। বিয়ের দুই বছর পর রনি একদিন বৃষ্টিকে জানায় ভারতে তার জন্য তিনি একটি ভালো কাজের ব্যবস্থা করেছেন। সেখানে একটি বৃদ্ধাশ্রমে দৈনিক আট ঘণ্টা ডিউটি করলে মাসে ৩০ হাজার টাকা বেতন দেবে। এ চাকরি হলে সংসারে আর কোনো অভাব থাকবে না বলেও জানান তিনি। সংসারের উন্নতি ও সুন্দর ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে ভারতে যেতে রাজি হয় বৃষ্টি।
এরপর বৃষ্টিকে ভারতে পাঠানোর জন্য রাজধানীর হাতিরঝিলের মধুবাগ ব্রিজে যায় রনি। ব্রিজের কাছে গিয়ে বৃষ্টি দেখতে পায় নদী নামের এক নারী (যাকে রনি নদী ম্যাডাম বলতেন) সোনিয়া নামে আরেক মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সোনিয়াকেও বৃষ্টির সঙ্গে ভারতের একই বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানো হবে বলে জানান নদী। সেখান থেকে বৃষ্টি ও সোনিয়াকে নিয়ে যাওয়া হয় সাতক্ষীরায়। এরপর ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি বৃষ্টিকে সাতক্ষীরা থেকে ভারতের চেন্নাইয়ে পাচার করা হয়। চেন্নাইয়ের একটি বাসায় রাখা হয় তাকে। সেখানে আগে থেকেই বেশ কয়েকজন মেয়েকে রাখা হয়েছিল। সেই বাসায় বিভিন্ন বয়সের লোকজন আসা-যাওয়া করতো।
আরও পড়ুন: ঢাকায় মানব পাচারকারী চক্রের ৪ সদস্য গ্রেফতার, উদ্ধার ২ নারী
পরদিন বৃষ্টিকে বলা হয় তার রুমে `গেস্ট’ আসবে। সে যেন রেডি থাকে। বৃষ্টি মোবাইল ফোনে তার পরিবারের লোককে জানানোর চেষ্টা করলে তার কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। জোরপূর্বক তাকে নগ্ন করে ছবি তুলে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকিসহ অবৈধ পথে ভারত আসার জন্য পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয়ভীতিও দেখানো হয়। একপর্যায়ে অনৈতিক কাজ করতে তাকে বাধ্য হতে হয়।
আইনে বিদেশে গিয়ে তদন্ত করার বিষয়টি রয়েছে। তদন্ত সংস্থা কেন আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলাগুলো বিদেশে তদন্ত করতে যায় না তা আমার বোধগম্য নয়। আমার জানা মতে, আজ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল থেকে অনুমতি নিয়ে কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলা তদন্ত করতে বিদেশে যায়নি।—সাজ্জাদুল হক শিহাব, ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর
পরে বৃষ্টি জানতে পারেন তাকে দুই দফায় বিক্রি করা হয়েছে। প্রথমে তার স্বামী রনি তাকে ৪০ হাজার টাকায় নদীর কাছে বিক্রি করে এরপর নদী ৭০ হাজার টাকায় তাকে আবার বিক্রি করে। সেখানে কিছুদিন থাকার পর একজন বৃদ্ধ লোকের সহায়তায় ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসেন বৃষ্টি। ওই ব্যক্তির কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিয়ে ২০২১ সালের মে মাসে পালিয়ে দেশে চলে আসেন তিনি।
আরও পড়ুন: ভারত-মালয়েশিয়া-দুবাইয়ে নারীপাচার চক্রের সমন্বয়ক নদী
এ ঘটনায় বৃষ্টি নিজে বাদী হয়ে স্বামী জাহিদুল ইসলাম রনি, নদী আক্তার ইতিসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে ২০২১ সালের ১০ জুন হাতিরঝিল থানায় মানবপাচার আইনে একটি মামলা করেন। বর্তমানে মামলাটি তদন্ত করছে সিআইডি পুলিশ। মামলার নথি দেখে জানা যায়, মামলা তদন্ত করতে এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়ার কোনো আবেদন করা হয়নি।
ঘটনা-২
আলামিন হোসেন একজন নৃত্য প্রশিক্ষক। ভিকটিম ময়নাকে আসামি ডায়মন্ডের কাছে নিয়ে আসেন তার পরিচিত মিরপুরের ভুক্তভোগী ফাতেমা। ময়নাকে ডায়মন্ড আশ্বস্ত করেন যে, ভালো বেতনে তাকে বিদেশে নাচের ব্যবস্থা করে দেবেন। ডায়মন্ডের কথায় ময়না আশ্বস্ত হলে ২০১৯ সালের ২ মে তাকে আরেক আসামি স্বপন হোসেনের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়।
প্রতিনিয়ত মানবপাচারের শিকার হচ্ছেন অনেকে-প্রতীকী ছবি
আরও পড়ুন: ইউরোপ পাঠানোর কথা বলে ভারতে পাচার
স্বপন দুবাইয়ের ড্যান্স ক্লাব ফরচুন পার্ল হোটেল, ফরচুন গ্রান্ড সিটি টাওয়ারের মালিক আসামি আজমের কাছে নিয়ে যান ময়নাকে। থাকা-খাওয়াসহ ক্লাবে নাচ-গান করার বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন দেওয়া হবে বলে তার সঙ্গে মৌখিক চুক্তি করেন আজম। ময়না সরল বিশ্বাসে তার ওপর ভরসা করে দুবাই যেতে রাজি হন। আজমের ভাই আসামি নাজিম ও এরশাদের সহায়তায় ময়নার পাসপোর্ট ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র প্রস্তুত করা হয়। তারপর মে মাসে ময়নাকে শারজাহ নিয়ে যান তারা। পরে আজম সেখানে নিয়ে ময়নাকে নিজেসহ বিভিন্ন লোক দিয়ে যৌন শোষণ ও নিপীড়ন করেন। কিন্তু দুবাই গমনের পর তারা ময়নাকে কোনো টাকা-পয়সা দেননি।
আরও পড়ুন: ৪ বছর পর দেশে ফিরেছে ভারতে পাচার হওয়া নারী-শিশু
এ ঘটনায় ২০২১ সালের ২ জুলাই মূলহোতা আজম খানসহ নয়জনের বিরুদ্ধে মানবপাচার আইনে লালবাগ থানায় একটি মামলা করেন সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মৃণাল কান্তি শাহ। বর্তমানে ওই মামলা তদন্ত করছে সিআইডি। মামলার নথি থেকে জানা যায়, মামলা তদন্ত করতে এখন পর্যন্ত বিদেশে যাওয়ার কোনো আবেদন করা হয়নি। মামলার পর ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়।
মানবপাচার মামলার অপরাধ দুই দেশে সংঘটিত হয়। তাই এ মামলাগুলো তদন্ত অসম্পন্ন থেকে যায়। মামলাগুলোর তদন্ত সম্পন্ন করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে হয়। যাওয়ার ক্ষেত্রে পারমিশন ও আর্থিক সংস্থান থাকে না। ফলে এসব মামলা পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত হয় না। আইনে তদন্ত করতে বিদেশে যেতে বাধা নেই। তবে বিদেশ যাওয়া, থাকা, বিদেশে তথ্য কালেকশন করা এসবের তো একটা খরচ আছে। খরচ কে বহন করবে? এ খরচ পাওয়া যায় না।—মো. ফারুক হোসেন, উপ-পুলিশ কমিশনার
গ্রেফতারদের মধ্যে রয়েছেন জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত নৃত্যশিল্পী ও কোরিওগ্রাফার ইভান শাহরিয়ার সোহাগ। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইভান শাহরিয়ার সোহাগ আন্তর্জাতিক মানবপাচার চক্রের সক্রিয় সদস্য। নাচের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের কথা বলে তরুণীদের আর্টিস্ট হিসেবে দেখিয়ে বিদেশে পাচার করতেন তিনি। মামলার এজাহারে বর্ণিত আসামিরাও তার সঙ্গে জড়িত।
ইভানদের মানবপাচারের জাল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত। তিনি ও তার চক্রের লোকেরা ভুক্তভোগীদের নাচ শিখিয়ে ভালো বেতনে বিদেশে পাঠানোর প্রস্তাব দেন। রাজি হলে তাদের থাকা-খাওয়া নিশ্চিত করাসহ ক্লাবে নাচ-গানের বিনিময়ে প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতন দেবেন বলে মৌখিক চুক্তি করেন।
আরও পড়ুন: নৃত্যশিল্পী ইভানের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন ১১ সেপ্টেম্বর
শুধু বৃষ্টি আক্তার বা ময়না নন, এভাবে বিভিন্ন দেশে পাচার হচ্ছেন অনেকে। দেশে এসে নিচ্ছন আইনের আশ্রয়। জড়িতদের বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে মানবপাচার আইনে মামলা। এ ধরনের আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ঘটলেও তদন্ত হচ্ছে কেবল বাংলাদেশের অংশটির। আইনে সুযোগ থাকা সত্ত্বেও তদন্ত সংস্থা বিদেশে গিয়ে এসব মামলার তদন্ত করে না। এতে অন্য রাষ্ট্রে কারা জড়িত তা বাংলাদেশের তদন্তে উঠে আসছে না। বিদেশে মানবপাচারের মূল সিন্ডিকেটের সদস্য ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সুযোগ পেয়ে তারা বারবার অপরাধের জড়িয়ে পড়ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে অপরাধ দেশের বাইরে সংঘটিত হয় সে অপরাধের তদন্ত সে দেশে গিয়ে করতে না পারলে মামলার মেরিটের ওপর একটা প্রভাব পড়ে।
২০১২ সালে আমাদের দেশে মানবপাচার আইন করা হয়েছে। আমরা ইউএন প্রোটকলে অনুস্বাক্ষরকারী। ইউএন প্রোটকলে অনুস্বাক্ষরকারী হলে মামলার তদন্ত করতে অন্য দেশে যাওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। স্পেসিফিক দেখা যাচ্ছে টিকটক হৃদয়ের বিরুদ্ধে ভারতে মামলা হয়েছে। সেদেশে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের হাতিরঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হাতিরঝিল থানা বলছে তারা ফিরে এলে মামলাটি চালু হবে। এটা কত হাস্যকর।—অ্যাডভোকেট সালমা আলী
আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলার তদন্তের বিষয়ে ২০১২ সালের মানবপাচার আইনের ১৯ এর ৫ ধারায় বলা হয়েছে, ‘আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ তদন্তের ক্ষেত্রে বিদেশি সাক্ষ্য-প্রমাণ নিরীক্ষণ করার জন্য বিদেশ গমনের আবশ্যকতা দেখা দিলে, ট্রাইব্যুনালের অনুমতিক্রমে, তদকর্তৃক নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে তদন্তকার্য সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে পুলিশ কর্তৃপক্ষ একটি বিশেষ তদন্ত দল গঠন করবে এবং তদন্ত দলকে যথাসম্ভব প্রশাসনিক এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান করিবে।’
মানবপাচার সিন্ডিকেটের হোতা নদী-ফাইল ছবি
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের তথ্য অনুসারে সারাদেশে ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরে মামলা হয়েছে ৬৮৩টি। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট মামলা দাঁড়ায় ৭১৬টি। এসব মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ২৪৬টিতে, আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ১২৯টি মামলায়। আসামি করা হয়েছে ৩৩ হাজার ৫০৯ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ মোট ১৫ হাজার ১২৬ জনকে। খালাস দেওয়া হয় ১ হাজার ২৭৯ জন আসামিকে। সাজা দেওয়া হয় চার মামলার আসামিকে। বর্তমানে ৭৪৫টি মামলা তদন্তধীন। এদের মধ্যে রাজধানী ঢাকায় ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১২৫টি নতুন মামলা করা হয়। যেগুলোর ৫২টিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। বাকি ৭৩টি মামলার তদন্ত চলছে।
আরও পড়ুন: মানবপাচার মামলায় জমির-তাসলিমা দম্পতি গ্রেফতার
২০২২ সালে মামলা হয়েছে ৫৩টি। ২০২১ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৪৮টি। অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৬৯টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৬টি মামলায়। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ৩০ হাজার ৭৭৮ জনকে। পূর্ববর্তী মামলাসহ এদের মধ্যে আরও ১৪ হাজার ২৯২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে ১২১টি মামলার আসামিকে আর সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলায়। তদন্তধীন ছিল ৮২৬টি মামলা। বিচারাধীন ছিল ৫ হাজার ২৯৫টি মামলা।
সিআর পিসির ১৮৮ নম্বর ধারা অনুয়ায়ী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে যদি বাংলাদেশি নাগরিক দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তাহলে যে বাংলাদেশে থাকাকালে যেভাবে আইনের আওতায় আসবে ঠিক সেভাবে সে আইনের আওতায় আসবে। যে অপরাধ দেশের বাইরে সংঘটিত হয় সে অপরাধের তদন্ত সে দেশে গিয়ে না করতে পারলে মামলার ম্যারিটের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। মানবপাচার একটি চলমান অপরাধ। মানবপাচারের অপরাধ বিদেশে সংঘটিত হলে সেক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়া আরও সহজ করা প্রয়োজন।—এহসানুল হক সমাজী
২০২১ সালে মামলা হয়েছে ৫৫৪টি। ২০২০ সালের মামলাসহ মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ৬ হাজার ৫০১টি। এদের মধ্যে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে ৩৬৬টি মামলায় আর চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে ৪০টি মামলায়। পূর্ববর্তী মামলাসহ এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে দুই লাখ ৬১ হাজার ২৪ জনকে। এদের মধ্যে এক লাখ ১৬ হাজার ৩৬০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। খালাস দেওয়া হয়েছে পাঁচ মামলার আসামিকে। সাজা দেওয়া হয়নি কোনো মামলার আসামিকে। তদন্তাধীন ছিল ৬ হাজার ৯৫টি মামলা। বিচারাধীন ছিল ৪৫ হাজার ৭০৪টি মামলা।
ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে, ২০২২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে মানবপাচারের ৭ হাজার ২৩৩টি মামলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ৩৬৮টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন ৫ হাজার ৯৭০টি (তদন্তাধীন মামলাসহ)। পুলিশি তদন্ত শেষে বিচারের জন্য বিভিন্ন আদালতে ঝুলছে ৫ হাজার ৭৭টি মামলা। এখন পর্যন্ত এ-সংক্রান্ত মামলায় ১১ জনের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে ৩০৬ জনের। বিভিন্ন মেয়াদে ৮৬ জনের সাজা হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের ১৮টি রুট দিয়ে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার নারী, শিশু ও কিশোরী ভারতে পাচার হচ্ছে।
মানবপাচারে গ্রেফতার স্বামী-স্ত্রী-ফাইল ছবি
যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির তথ্য মতে, ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশে ৫৮০টি যৌন পাচারের এবং ৬ হাজার ৩৭৮টি শ্রম পাচারের ঘটনা ঘটেছে। পাচারের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে নারী, পুরুষ, এমনকি শিশুরা পর্যন্ত রয়েছে।
আমি মনে করি যে এ মামলাগুলো খুব ক্লোজলি মনিটরিং করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পুলিশের তদন্ত টিমের সেল রাখা যে এই মামলায় কী হচ্ছে কোন কারণে আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আগের মামলায় পার পেয়ে পরের মামলায় সেই কাজগুলো করা। এখানে আরেকটা জিনিস সেটা হচ্ছে অর্থের লেনদেন।—শরিফুল হাসান
জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মানবপাচারের অধিকাংশ মামলা আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলা, যা বাংলাদেশ ও অন্য রাষ্ট্রে অপরাধ সংঘটিত হয়। পাচারকারী চক্র ভালো বেতনের আশ্বাসে অধিকাংশ ভিকটিমকে পাচার করা হয় ভারত, লিবিয়া, ইতালি, সৌদি আরব, দুবাই, জর্ডান, কানাডার মতো দেশে। দুই দেশের মধ্যে অপরাধ সংঘটিত হলেও মামলার তদন্ত শুধু বাংলাদেশের অংশটি করা হচ্ছে। বিদেশে ভিকটিমের সঙ্গে কী ঘটছে তা তদন্তে উঠে আসে না। এতে একদিকে মামলার তদন্তে সঠিক চিত্র উঠছে না অন্যদিকে পার পেয়ে যাচ্ছেন মানবপাচারের মূলহোতারা।
আন্তঃরাষ্ট্রীয় মানবপাচারের অধিকাংশ মামলাই তদন্ত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এ বিষয়ে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচারের অধিকাংশ ঘটনার সূত্রপাত বাংলাদেশ থেকে। মানবপাচারের কিছু কুশীলব থাকে যারা বাইরের দেশে ভিকটিমদের নির্যাতন করে। তবে বিদেশে যাওয়ার টাকার লেনদেন হয় বাংলাদেশ থেকে। যেসব আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয় তারা দেশে এলে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করি। এক্ষেত্রে আমরা তথ্য যেভাবে পাই সেভাবে তদন্ত করি। তবে প্রয়োজন মনে করলে আমাদের টিম আদালতের অনুমতি নিয়ে দেশের বাইরে গিয়ে তদন্ত করে।
নৃত্যশিল্পী ইভান-ফাইল ছবি
এ বিষয়ে ঢাকার মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব জাগো নিউজকে বলেন, অধিকাংশ মানবপাচারের মামলা আন্তঃরাষ্ট্রীয় ঘটনা, যা বাংলাদেশ ও অন্য রাষ্ট্রের মধ্যে ঘটে। এসব মামলা বিদেশে গিয়ে তদন্ত করলে ভালো তদন্ত হয়। এ মামলাগুলোর অধিকাংশ তদন্ত বিদেশে গিয়ে হয় না। তবে আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলা বিদেশে গিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত। বিদেশে তদন্ত হলে ঘটনার আসল রহস্য বের হয়ে আসবে। রাষ্ট্রপক্ষ থেকে আদালতে মামলা প্রমাণ করতে সহজ হয়। সঠিক ঘটনা বিদেশে তদন্ত না হলে সাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে আসামিরা পার পেয়ে যায়। আইনে বিদেশে গিয়ে তদন্ত করার বিষয়টি রয়েছে। তদন্ত সংস্থা কেন আন্তঃরাষ্ট্রীয় মামলাগুলো বিদেশে তদন্ত করতে যায় না তা আমার বোধগম্য নয়। আমার জানা মতে, আজ পর্যন্ত ট্রাইব্যুনাল থেকে অনুমতি নিয়ে কোনো তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলা তদন্ত করতে বিদেশে যায়নি।
সিআইডির পাশাপাশি মানবপাচারের কিছু মামলা তদন্ত করে পুলিশ। এ বিষয়ে ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ফারুক হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, মানবপাচার মামলার অপরাধ দুই দেশে সংঘটিত হয়। তাই এ মামলাগুলো তদন্ত অসম্পন্ন থেকে যায়। এ মামলাগুলো তদন্ত সম্পন্ন করতে হলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেতে হয়। যাওয়ার ক্ষেত্রে পারমিশন ও আর্থিক সংস্থান থাকে না। ফলে এসব মামলা পূর্ণাঙ্গভাবে তদন্ত হয় না।
মানবপাচার আইনে বিদেশে গিয়ে তদন্ত করার নিয়ম রয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে ফারুক হোসেন বলেন, আইনে তদন্ত করতে বিদেশে যেতে বাধা নেই। তবে বিদেশ যাওয়া, থাকা, বিদেশে তথ্য কালেকশন করা এসবের তো একটা খরচ আছে। এ খরচ কে বহন করবে। এ খরচ পাওয়া যায় না।
যা বলছেন বিশেজ্ঞরা
বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট সালমা আলী জাগো নিউজকে বলেন, ২০১২ সালে আমাদের দেশে মানবপাচার আইন করা হয়েছে। আমরা ইউএন প্রোটকলে অনুস্বাক্ষরকারী। ইউএন প্রোটকলে অনুস্বাক্ষরকারী হলে মামলার তদন্ত করতে অন্য দেশে যাওয়াতে কোনো অসুবিধা নেই। স্পেসিফিক দেখা যাচ্ছে, টিকটক হৃদয়ের বিরুদ্ধে ভারতে মামলা হয়েছে। সে দেশে তাকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশের হাতিরঝিল থানায় তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। হাতিরঝিল থানা বলছে, তারা ফিরে এলে মামলাটি চালু হবে। এটা কত হাস্যকর। এসব বিষয় নিয়ে দ্বিপাক্ষিক আলোচনা করা উচিত। আসামি ভারতে আছে বাংলাদেশে সাক্ষী নিয়ে মামলা শেষ করবে এটা নিয়ে জটিলতা রয়েছে। মালয়েশিয়া থেকে শুরু করে অন্যান্য দেশে আসল অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে। দেশে শুধু ধরা পড়ছে মিডলম্যানরা। তারা তো কিছুই জানে না। তারা শুধু ভিকটিমকে পার করে দিচ্ছে। বেশিরভাগ ভিকটিম মূল অপরাধীদের নাম-ঠিকানা বলতে পারে না। মানবপাচার আইনের মামলায় ৩ শতাংশ রায় রয়েছে। এটা নিয়ে দ্বিপাক্ষিক কাজ করা উচিত।
আরও পড়ুন: রিফাত হত্যা, টিকটক হৃদয় ও রাতুলের স্বীকারোক্তি
তিনি আরও বলেন, যে দেশে আমাদের ভিকটিমরা যাচ্ছেন তাদের সঙ্গে বসা উচিত। সে দেশের পুলিশ বা ইন্টারপোলকে কাজে লাগানো যেতে পারে। আগে ইন্টারপোলের মিটিং হতো। আমি সেখানে যেতাম। এখন আর ইন্টারপোলের মিটিং হয় না। কোনো কিছুই নেই এখন। সবমিলে হচ্ছে-যাচ্ছে-করছে এভাবে চলছে। আইন থেকে শুরু করে সবই আছে কিন্তু বাস্তবে কিছুই নেই। যে ভিকটিম সে ভিকটিমাইজই হচ্ছে। যারা অপরাধী তারা অপরাধ করেই যাচ্ছে। জবাবদিহিতা না থাকায় এমন হচ্ছে। জবাবদিহি না থাকলে এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
টিকটক হৃদয়-ফাইল ছবি
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের সাবেক পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) এহসানুল হক সমাজী জাগো নিউজকে বলেন, সিআর পিসির ১৮৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশের ভূখণ্ডের বাইরে যদি বাংলাদেশি নাগরিক দ্বারা কোনো অপরাধ সংঘটিত হয় তাহলে যে বাংলাদেশে থাকাকালে যেভাবে আইনের আওতায় আসবে ঠিক সেভাবে সে আইনের আওতায় আসবে। যে অপরাধ দেশের বাইরে সংঘটিত হয় সে অপরাধের তদন্ত সে দেশে গিয়ে না করতে পারলে মামলার ম্যারিটের ওপর একটা প্রভাব পড়ে। মানবপাচার একটি চলমান অপরাধ। মানবপাচারের অপরাধ বিদেশে সংঘটিত হলে সেক্ষেত্রে তদন্ত প্রক্রিয়াকে আরও সহজ করা প্রয়োজন।
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান শরিফুল হাসান জাগো নিউজকে বলেন, আমি মনে করি এই মামলাগুলো খুব ক্লোজলি মনিটরিং করা প্রয়োজন। পাশাপাশি পুলিশের তদন্ত টিমের সেল রাখা যে এ মামলায় কী হচ্ছে কোন কারণে আসামিরা পার পেয়ে যাচ্ছে। আগের মামলায় পার পেয়ে পরের মামলায় সেই কাজগুলো করা। এখানে আরেকটা জিনিস সেটা হচ্ছে অর্থের লেনদেন। কারণ মানবপাচার কিন্তু একটা সংঘবদ্ধ অপরাধ। এখানে কারা জড়িত নেটওয়ার্কিং কারা করছে কোথায় অর্থ যাচ্ছে এই টোটাল অর্থ যদি জব্দ করা যায়। তাহলে পাচারকারীরা পার পাবে না। এ ধরনের ঘটনা কিন্তু আমরা খুবই কম পাই, এক কথায় পাই না বললেই চলে। মানবপাচারকারী চক্রের অর্থ যেহেতু জব্দ করা যায় না, আসামিরা পার পেয়ে যায়। তারা আপস-মীমাংসা করে। অনেকেই তাদের প্রভাবের কাছে টিকতে না পেরে অর্থের কারণে কিংবা ভয়ের কারণে সাক্ষী দিতে যায় না। এখানে সাক্ষী সুরক্ষার কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। বিচার ব্যবস্থার যে সংকট রয়েছে মাবনপাচার ট্রাইব্যুনাল কিন্তু তার বাইরে নয়। বিচার বিভাগ, পুলিশ সবার সমস্যা চিহ্নিত করে সংকট নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
জেএ/এসএইচএস/এএসএম