ষোড়শ সংশোধনীর রিভিউ শুনানির জন্য বর্তমান আপিল বিভাগই উপযুক্ত

জেলা প্রতিনিধি
জেলা প্রতিনিধি জেলা প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ০১:৫৮ পিএম, ২৩ নভেম্বর ২০২৩
ফাইল ছবি

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ (পুনর্বিবেচনা) শুনানি করা যাবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের বর্তমান বেঞ্চে।

বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানসহ ছয় সদস্যের বিচারপতির আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ সিদ্ধান্ত দেন। আপিল বিভাগ বলেন, আমরা (ছয় বিচারপতি) এটা শুনানির জন্য (কমপিটেন্ট) উপযুক্ত।

এর আগে আলোচিত এ রিভিউ ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগে শুনানির জন্য এলে রিটকারীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী মনজিল মোরশেদ প্রশ্ন তোলেন। সাতজন বিচারপতির দেওয়া রায় ছয়জন বিচারপতির বেঞ্চ শুনানি করতে পারেন কি না- এই প্রশ্ন উত্থাপন করে ‘ফুল বেঞ্চ’ ও ‘সেইম বেঞ্চ’ আদালতের সামনে আনেন। অন্যদিকে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র কয়েকজন আইনজীবীর অভিমত শোনেন সর্বোচ্চ আদালত।

আইনজীবীর হলেন অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মুহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মমতাজ উদ্দিন ফকির, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কেসি, অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী, অ্যাডভোকেট কামরুল হক সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট মুরাদ রেজা, ব্যারিস্টার তানজীব উল আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট শেখ মোহাম্মদ (এসকে) মোরশেদ। আর রিটকারীর পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ।

আরও পড়ুন: ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিল নিয়ে গণমাধ্যমে কোনো কথা নয়’

প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেছিলেন, বিষয়টি নিয়ে আমাদের সিদ্ধান্ত যাতে ভুল না হয়, তাই আপনাদের অভিমত শুনলাম। আমরা এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবো। তারপর ষোড়শ সংশোধনী রিভিউ শুনানি শুরু হবে।

সে অনুযায়ী আজ প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির আপিল বিভাগ বলেন, আমরা এটা শুনানি করার জন্য উপযুক্ত।

এর আগে ১৬ নভেম্বর এ বিষয়ে সিদ্ধান্তের জন্য আজকের দিন ঠিক করেছিলেন আপিল বিভাগের একই বেঞ্চ। ওইদিন সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, শুনানিতে বলেছি, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছিলেন সাতজন বিচারক। এখন আপিল বিভাগে ছয়জন বিচারক। আমার প্রশ্ন ছিল, সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ শুনানি বর্তমান আপিল বিভাগে হবে কি না। এজন্য সিদ্ধান্ত দিতে ২৩ নভেম্বর ঠিক করেন আদালত। তারই ধারাবাহিকতায় আজ সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেন।

আরও পড়ুন: ‘ষোড়শ সংশোধনী বাতিলে সাংবিধানিক শূন্যতা বিরাজ করছে’

এর আগে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল ঘোষণা করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায় রিভিউয়ের জন্য ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। রায় পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপক্ষের ৯৪টি সুনির্দিষ্ট যুক্তি তুলে ধরে, ৯০৮ পৃষ্ঠার রিভিউ আবেদনে পুরো রায় বাতিল চাওয়া হয়।

বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। একই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর গেজেট হয়। এরপর ওই সংশোধনী চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট করেন। পরে ৯ নভেম্বর হাইকোর্টের বেঞ্চ ওই রিটে রুল জারি করেন।

এরপর ২০১৬ সালের ৫ মে তিন বিচারপতির সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বিশেষ বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থি বলে রায় ঘোষণা করেন। একই বছরের ১১ আগস্ট পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। এরপর হাইকোর্টের দেওয়া এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।

শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিকাস কিউরির (আদালতের বন্ধু) মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর নয়জন অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন। ওই বছরের ২০১৭ সালের ৮ মে শুনানি শুরু হয়ে ১১ দিন শুনানি হয়।

আরও পড়ুন: সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বৈধ : আজমালুল হোসেন কিউসি

রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ। এরপর ওই বছরের ১ আগস্ট ৭৯৯ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। যেখানে মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র, সংসদসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পর্যবেক্ষণ রাখা হয়।

রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘বঙ্গবন্ধুকে খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবিতে সরব হয়ে ওঠেন সরকারি দলীয় আইনজীবীরা। জাতীয় সংসদেও এ রায় ও প্রধান বিচারপতির অনেক সমালোচনা করা হয়। এরপর ওই বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর সংসদে রায় পুনর্বিবেচনার জন্য আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব গৃহীত হয়। তারই প্রেক্ষাপটে রিভিউ করা হয়। আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মূল প্রসঙ্গ ছাড়াও অপ্রাসঙ্গিকভাবে অনেক কিছু টেনে আনার কারণেই সরকার ওই রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর আবেদন দাখিল করে।

এ রায় নিয়ে তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে ২০১৭ সালের ৩ অক্টোবর ছুটিতে যান তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে ১৩ অক্টোবর তিনি বিদেশ চলে যান। ১০ নভেম্বর তিনি সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশ হাইকমিশনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি বরাবর নিজের পদত্যাগপত্র জমা দেন।

যে যুক্তিতে রিভিউ করা হয়, সংবিধানের তফসিলে সন্নিবেশিত ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল প্রণীত ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ উল্লেখ করে রিভিউ আবেদনে বলা হয়েছে, একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই বাংলাদেশের ফাউন্ডিং ফাদার রূপে স্বীকৃত। আপিল বিভাগ ‘ফাউন্ডিং ফাদারস’ বহুবচন শব্দ ব্যবহার করে ভুল করেছেন। তাই এর পুনর্বিবেচনা প্রয়োজন।

রায়ের একটি অংশে পর্যবেক্ষণে ‘আমিত্ব’ ধারণা থেকে মুক্তি পেতে হবে বলে যা উল্লেখ আছে, সে প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষ রিভিউ আবেদনে যুক্তি দেখিয়ে বলছেন, আদালতের এ পর্যবেক্ষণ ভিত্তিহীন ও অপ্রত্যাশিত। যা আমাদের এ মামলার বিবেচ্য বিষয় নয়। এটি সংশোধনযোগ্য।

ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়া ও সংসদ এখনো শিশুসুলভ। এখনো এ দুটি প্রতিষ্ঠান মানুষের আস্থা অর্জন করতে পারেনি।’ এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি হচ্ছে— এ পর্যবেক্ষণ আদালতের বিচার্য বিষয় নয়। বিচারিক শিষ্টাচারের বাইরে গিয়ে এ পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যা সংশোধনযোগ্য।

আরেকটি পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ‘সংসদীয় গণতন্ত্র অপরিপক্ব। যদি সংসদের হাতে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয়, তবে তা হবে আত্মঘাতী।’

এর সুরাহা চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, আদালতের এ পর্যবেক্ষণ শুধু অবমাননাকরই নয় বরং ভিন্ন রাজনৈতিক প্রশ্ন। আদালতের বিচারিক এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে এ মন্তব্য করা হয়েছে। রিভিউয়ে আরও বলা হয়, রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ অন্য একটি অঙ্গের বিরুদ্ধে এরূপ মন্তব্য করতে পারে না। এটা বিচারিক মন্তব্য নয়। এ মন্তব্য করে আদালত ভুল করেছেন, যা সংশোধনযোগ্য ও বাতিলযোগ্য।

এফএইচ/জেডএইচ/জিকেএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।