খালেদা জিয়ার কোন মামলার কী হাল?
দুর্নীতির দুই মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সরকারের নির্বাহী আদেশে দুই শর্তে অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে রয়েছেন। এরমধ্যে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন নিম্ন আদালত। রায় ঘোষণার পর ওইদিনই তাকে নেওয়া হয় পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। একই বছরের ৩০ অক্টোবর নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলে আরও পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে তাকে ১০ বছরের সাজা দেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদার সাত বছরের সাজা হয়।
বহুল আলোচিত দুর্নীতির এ দুটি মামলা ছাড়াও খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ৩৫টির মতো মামলা রয়েছে। এরমধ্যে গ্যাটকো, নাইকো, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা ও গুলশানে বোমা হামলা মামলায় আইনজীবীর মাধ্যমে আদালতে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন তিনি। নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের ১১ মামলা উচ্চ আদালতে স্থগিত। বাকি মামলাগুলোতে অসুস্থতাজনিত কারণে হাজিরা দিতে না পারায় আইনজীবীর মাধ্যমে সময় আবেদন করছেন।
আরও পড়ুন: রাজনীতিতে জিয়া পরিবারের ভবিষ্যৎ কোন পথে?
দুর্নীতির দুই মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির পর প্রায় ২৫ মাস কারাভোগ করেন। দেশে করোনা মহামারি শুরু হলে পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের নির্বাহী আদেশে অন্তর্বর্তীকালীন মুক্তি নিয়ে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ বিকেলে বাসায় ফেরেন তিনি। এরপর গত সাড়ে তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজধানীর গুলশানের বাসা ‘ফিরোজায়’ অবস্থান করছেন। এরমধ্যে বিভিন্ন সময় শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে তাকে হাসপাতালে যাওয়া-আসা করতে দেখা গেছে। ৭৭ বছর বয়সী খালেদা জিয়ার আর্থ্রাইটিস, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যাসহ বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতা রয়েছে। সবশেষ গত ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় তিনি রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। বর্তমানে সেখানেই চিকিৎসাধীন।
এরই মধ্যে দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে আগের দুটি শর্তেই তার মুক্তির মেয়াদ আরও ছয় মাস বাড়িয়েছে সরকার। মুক্তির মেয়াদ বাড়িয়ে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। এর আগে তার দণ্ড স্থগিত করে মুক্তির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে মত দেয় আইন মন্ত্রণালয়। গত ১০ সেপ্টেম্বর আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়কমন্ত্রী আনিসুল হক সচিবালয়ে সাংবাদিকদের এ কথা জানান।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, আগের মতো খালেদা জিয়া ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা নেবেন এবং এসময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না- এ দুটি শর্তে দণ্ড স্থগিতের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ নিয়ে সরকারের নির্বাহী আদেশে অষ্টমবারের মতো খালেদা জিয়ার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হলো।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বর্তমানে যে ৩৫টি মামলা রয়েছে তার মধ্যে ১৩টিই ২০০৭-০৮ সময়কালে ওয়ান/ইলেভেন সরকারের করা। বাকিগুলো পরবর্তীসময়ের। এরমধ্যে পাঁচটি দুর্নীতির, চারটি মানহানির ও একটি রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা। বাকি মামলাগুলো হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও নাশকতার অভিযোগে। সেসব মামলার বর্তমান বিচারিক অবস্থা উঠে এসেছে এ প্রতিবেদনে।
আরও পড়ুন: মামলায় নাকাল খালেদা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেন বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠে স্থাপিত ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। রায় ঘোষণার পর খালেদাকে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডে অবস্থিত পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর এ মামলায় আপিলে তার আরও পাঁচ বছরের সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন হাইকোর্ট।
জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলা
২০১৮ সালের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় খালেদা জিয়াকে সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ দেন ঢাকার ৫ নম্বর বিশেষ জজ আদালত। রায়ে সাত বছরের কারাদণ্ড ছাড়াও তাকে ১০ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ছয় মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
নাইকো দুর্নীতি মামলা
কানাডার জ্বালানি কোম্পানি নাইকোর সঙ্গে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অস্বচ্ছ চুক্তি করে রাষ্ট্রের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতিসাধনের অভিযোগে ২০০৭ সালের ৯ ডিসেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় এ মামলা করে দুদক। ২০০৮ সালের ৫ মে খালেদা জিয়াসহ ১১ জনের বিরুদ্ধে এ মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৯-এ বিচারাধীন।
চলতি বছরের ১৯ মার্চ এ মামলায় অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু করেন সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক শেখ হাফিজুর রহমান। এরপর গত ২৩ মে মামলার বাদী দুদকের তৎকালীন সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ মাহবুবুল আলমের জবানবন্দি দেন। এরপর মাধ্যেমে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। সর্বশেষ গত ১২ সেপ্টেম্বর আদালতে তিনি দ্বিতীয় দিনের মতো জবানবন্দি দেন। এরপর তাকে জেরা করেন আসামিপক্ষের আইনজীবীরা। আসামিপক্ষের জেরা শেষ না হওয়ায় পরবর্তী জেরা ও সাক্ষ্যগ্রহণ হয় গত ১৭ সেপ্টেম্বর। ওইদিন এ মামলায় খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) একজন এবং কানাডিয়ান রয়েল মাউন্টেড পুলিশের দুজনকে অনুমতি দেন আদালত। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ১০ অক্টোবর দিন ধার্য রয়েছে।
আরও পড়ুন: খালেদার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে তিন বিদেশিকে অনুমতি
গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা
গ্লোবাল অ্যাগ্রো ট্রেড (প্রাইভেট) কোম্পানি লিমিটেডের (গ্যাটকো) সঙ্গে লেনদেনের সময় প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর খালেদা জিয়া ও তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে তেজগাঁও থানায় এ মামলা করেন দুদকের তৎকালীন উপ-পরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী। মামলার পরদিনই খালেদা জিয়া ও কোকোকে গ্রেফতার করা হয়। পরের বছরের ১৩ মে খালেদা জিয়াসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক। তবে কোকোসহ ৯ আসামির আগেই মৃত্যু হওয়ায় মামলা থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করা হয়েছে।
এ মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান গ্যাটকোকে রাজধানীর কমলাপুর আইসিডি ও চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজ পাইয়ে দিয়ে রাষ্ট্রের ১৪ কোটি ৫৬ লাখ ৩৭ হাজার ৬১৬ টাকার ক্ষতিসাধন করেন। মামলাটি বর্তমানে অভিযোগ গঠন শুনানির পর্যায়ে।
সবশেষ ২৯ আগস্ট ঢাকার তিন নম্বর বিশেষ আদালতের বিচারক আলী হোসেনের আদালতে এ মামলার অভিযোগ গঠন শুনানির দিন ধার্য ছিল। কিন্তু মামলার আসামি ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন চিকিৎসার জন্য বিদেশে থাকায় তার আইনজীবী শুনানি পেছানোর সময় আবেদন করেন। তবে খালেদা জিয়া তার আইনজীবীর মাধ্যমে হাজিরা দেন। আদালত সময় আবেদন মঞ্জুর করে ২৪ সেপ্টেম্বর শুনানির নতুন দিন ধার্য করেন।
বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলা
দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া খনি থেকে কয়লা উত্তোলন, ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণে ঠিকাদার নিয়োগে অনিয়ম এবং রাষ্ট্রের ১৫৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা ক্ষতি ও আত্মসাতের অভিযোগে ২০০৮ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি শাহবাগ থানায় এ মামলা করা হয়। ওই বছরের ৫ অক্টোবর খালেদা জিয়াসহ ১৫ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করে দুদক।
বর্তমানে মামলাটি ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২ এ অভিযোগ গঠন শুনানির পর্যায়ে রয়েছে। সবশেষ গত ৮ আগস্ট কেরানীগঞ্জ কারাগারে স্থাপিত অস্থায়ী ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-২ এর বিচারক মো. আকতারুজ্জামানের আদালতে এ মামলার অভিযোগ গঠন শুনানি শুরু হয়। ওইদিন খালেদা জিয়ার পক্ষে তার আইনজীবী হাজিরা দেন। এরপর দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজল অভিযোগ গঠন করতে শুনানি করেন।
অন্যদিকে মামলার আসামি মঈনুল আহসানের পক্ষে তার আইনজীবী অব্যাহতি চেয়ে শুনানি করেন। আদালত পরবর্তী আসামিদের শুনানির জন্য ২৬ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন।
মিথ্যা জন্মদিন পালনের মামলা
১৫ আগস্ট খালেদা জিয়ার জন্মদিন পালনকে ‘ভুয়া’ অভিযোগ করে ২০১৬ সালের ৩০ আগস্ট ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী জহিরুল ইসলাম ঢাকা চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা করেন। মামলাটিতে পুলিশের প্রতিবেদন আমলে নিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে সময় আবেদন করেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিন সে আবেদন মঞ্জুর করে অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য আগামী ১৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির মামলা
বাংলাদেশের মানচিত্র, জাতীয় পতাকা ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করার অভিযোগে ২০১৬ সালের নভেম্বরে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করা হয়। মামলাটি এখন অভিযোগ গঠন শুনানির পর্যায়ে। সবশেষ গত ১৪ সেপ্টেম্বর মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য ছিল। তবে খালেদা জিয়া অসুস্থ থাকায় তার পক্ষে সময় আবেদন করেন আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার। ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সুলতান সোহাগ উদ্দিন আবেদন মঞ্জুর করে অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য আগামী ১৮ অক্টোবর দিন ধার্য করেন।
আরও পড়ুন: বিএনপির বিরুদ্ধে এক লাখ মামলায় আসামি ৩৫ লাখ
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়ে কটাক্ষ ও বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রশ্নবিদ্ধ করার মামলা
২০১৫ সালের ২১ ডিসেম্বর বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা দল আয়োজিত এক আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর তথ্য দেওয়ার অভিযোগে ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন আদালতে একটি মামলা করা হয়। মামলাটি অভিযোগ গঠন শুনানির পর্যায়ে রয়েছে।
ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির দুই মামলা
২০১৪ সালের ১০ অক্টোবর খালেদা জিয়ার এক বক্তব্যের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষ ও বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত এবং জাতিগত বিভেদ সৃষ্টির অভিযোগ ওঠে। পরে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ বিষয়ে মামলা করা হয়। এ মামলাটিও অভিযোগ গঠন শুনানির অপেক্ষায়।
দারুস সালাম থানার ১১ মামলা
রাজধানীর গাবতলী বালুর মাঠ ও মিরপুর মাজার রোড সংলগ্ন এলাকায় ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যানবাহন ভাঙচুর, পুলিশের কাজে বাধা দেওয়াসহ নাশকতার অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দারুস সালাম থানায় ১১টি মামলা হয়। ঢাকার বকশীবাজারে বিশেষ জজ আদালতে মামলাগুলো বিচারের জন্য উঠলেও হাইকোর্টের আদেশের এর কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত।
যাত্রাবাড়ী থানার ৪ মামলা
২০১৫ সালের জানুয়ারিতে পেট্রোলবোমা মেরে চারজনের গায়ে অগ্নিসংযোগ, হত্যা ও হতাহতের ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে চারটি মামলা করা হয়। এ মামলাগুলোও হাইকোর্টের আদেশে স্থগিত অবস্থায় আছে।
কুমিল্লায় ৩ মামলা
২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চৌদ্দগ্রামের হায়দারপুল এলাকায় একটি কাভার্ডভ্যানে অগ্নিসংযোগ ও আশপাশের বেশকিছু গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। পরে এ ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৫ জানুয়ারি চৌদ্দগ্রাম থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি, বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে একটি এবং একটি হত্যা মামলা হয়। তিনটি মামলাই অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ।
আট যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার মামলা
বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলীয় জোটের ডাকা লাগাতার হরতাল-অবরোধ চলাকালে ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে যাত্রীবাহী নৈশকোচে দুর্বৃত্তদের নিক্ষেপ করা পেট্রোলবোমায় আট যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় খালেদা জিয়া ও বিএনপির ৫৫ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়। চৌদ্দগ্রাম থানার তৎকালীন এসআই নুরুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি করেন। মামলায় ৫৬ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।
রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে মামলা
একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টির অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেহেদী। ঢাকার বকশীবাজারে বিশেষ জজ আদালতে চলমান এ মামলাটির বিচারকাজও হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত।
আরও পড়ুন: নাইকো দুর্নীতি মামলা : আদালতে যাবেন না খালেদা
মানহানির তিন মামলা
২০১৬ সালের ১ মে শ্রমিক দিবসে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের জনসভায় বক্তব্য দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে নিয়ে মিথ্যা বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানি মামলা করা হয়। ঢাকার বিচারিক আদালতে বাংলাদেশ জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী দণ্ডবিধির ৫০০/১৫৩-ক ধারায় এ মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।
এছাড়া সজীব ওয়াজেদ জয়ের অ্যাকাউন্টে ৩০ কোটি মার্কিন ডলার রয়েছে বলে বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে ২০১৬ সালের ৩ মে আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সংগঠনের কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলা কমিটির সভাপতি শরিফুল আলম চৌধুরী বাদী হয়ে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে এক কোটি টাকার মানহানির মামলা করেন। মামলায় খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করা হয়। কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষমাণ।
২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে খালেদা জিয়া বলেন, শেখ মুজিবুর রহমান দেশের স্বাধীনতা চাননি। তিনি চেয়েছিলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রিত্ব। জেনারেল জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ায় এ দেশের জনগণ যুদ্ধে নেমেছিল। ওই সভায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের নিয়েও বিতর্কিত বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৭ সালের ২৫ জানুয়ারি জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী বাদী হয়ে আদালতে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মানহানির একটি মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে অভিযোগ গঠন শুনানির জন্য রয়েছে।
নড়াইলে মানহানির মামলা
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্য করায় ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর নড়াইলে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হয়। ওইদিন জেলার নড়াগাতী থানাধীন চাপাইল গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান রায়হান ফারুকী ইমাম নড়াইলের জেলা জজ আদালতে এ মামলা করেন। মামলাটির ঘটনা ঢাকায়। ওইদিন খালেদা জিয়া এক অনুষ্ঠানে স্বাধীনতাযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা এবং বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ না করে মন্তব্য করে বক্তব্য রাখেন। এ মামলায়ও প্রতিবেদন জমা দিয়েছে পুলিশ।
পঞ্চগড়ে নাশকতার মামলা
পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা ও নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে খালেদা জিয়া, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও রুহুল কবির রিজভীকে হুকুমের আসামি করে একটি মামলা করা হয়। ২০১৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মামলাটি করেন বোদা উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক সেলিম সোহাগ।
ঋণখেলাপির মামলা
খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমান ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর বিরুদ্ধে মামলা করে সোনালী ব্যাংক। কোকো মারা যাওয়ার পর ওই মামলায় খালেদা জিয়াকে পক্ষ করা হয়। ২০১৩ সালের ২ অক্টোবর ৪৫ কোটি ৫৯ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৫ টাকা ঋণখেলাপির অভিযোগ তুলে ঢাকার অর্থঋণ আদালতে এ মামলাটি করেন সোনালী ব্যাংক কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম। ২০১৬ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকার প্রথম অর্থঋণ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ফাতেমা ফেরদৌস এ মামলায় অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন। মামলাটি উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত।
আরও পড়ুন: হাসিনা সরকারের পতন ঘটলেও বিএনপি ক্ষমতায় আসবে না
গুলশানে বোমা হামলার মামলা
রাজধানীর গুলশানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খানের নেতৃত্বে শ্রমিক-কর্মচারী-পেশাজীবী-মুক্তিযোদ্ধা সমন্বয় পরিষদের মিছিলে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে মামলা করা হয়। এছাড়া বিএনপি নেত্রী শিরিন সুলতানা, চেয়ারপারসনের তৎকালীন প্রেস সচিব মারুফ কামাল খান সোহেলসহ ১৪ জনের নাম উল্লেখ করে আরও ৬৫-৭০ জনকে মামলায় আসামি করা হয়। ২০১৫ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হামলার ঘটনায় গুলশান থানায় এ মামলা করেন সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতা ইসমাইল হোসেন। ঢাকার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলাটি পুলিশের প্রতিবেদন দাখিলের জন্য অপেক্ষমাণ।
৪২ জনকে হত্যার অভিযোগে মামলা
২০ দলীয় জোটের আন্দোলনে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে মারা যাওয়া ৪২ জনকে হত্যার অভিযোগ এনে ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াসহ দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। বাংলাদেশ জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে এ মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে পুলিশের প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।
খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে মামলার বিষয়ে দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) মোশাররফ হোসেন কাজল জাগো নিউজকে বলেন, খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে করা গ্যাটকো, নাইকো ও বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলার বিচার চলছে। দুদকের পক্ষ থেকে মামলাগুলোর বিচারকাজ শেষ করার জন্য তোড়জোড় রয়েছে।
ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, খালেদা জিয়া কিছু মামলায় অসুস্থতাজনিত কারণে আদালতে উপস্থিত না হয়ে সময়ের আবেদন দাখিল করেন। তার আদালতে হাজির না হওয়ায় মামলার বিচারিক কার্যক্রম এগোচ্ছে না।
এসব মামলার বিষয়ে খালেদা জিয়ার আইনজীবী সৈয়দ জয়নুল আবেদীন মেজবাহ জাগো নিউজকে বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসনের বিরুদ্ধে সারাদেশে ৩৫টির মতো মামলা বর্তমানে চলমান। এরমধ্যে গ্যাটকো, নাইকো, বড়পুকুরিয়া দুর্নীতি মামলা ও গুলশানে বোমা হামলার মামলায় আইনজীবীর মাধ্যমে খালেদা জিয়ার পক্ষে হাজিরা দেওয়া হচ্ছে। নাশকতা ও রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে করা ১১ মামলায় উচ্চ আদালতে স্থগিত থাকায় তা আদালতকে অবহিত করি। বাকি মামলাগুলোতে অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়া আদালতে হাজির হতে না পারায় সময় আবেদন করা হয়।
জেএ/এমকেআর/এমএস