মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিনকে ১৮ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) অধীনে অধিভুক্ত কলেজ থেকে এলএলবি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে সনদ দেরিতে পাওয়া যশোরের বীর মুক্তিযোদ্ধা মুন্সি মহিউদ্দিন আহমেদকে ক্ষতিপূরণ বাবদ ১৮ লাখ টাকা দিতে নিদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদেশের অনুলিপি পাওয়ার দুই মাসের মধ্যে রাবি কর্তৃপক্ষতে ক্ষতিপূরণের এ টাকা পরিশোধ করতে বলা হয়েছে।
আদালতের আদেশ উল্লেখ করে মহিউদ্দিনের আইনজীবী জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এ সময়ের মধ্যে ক্ষতিপূরণ দিতে ব্যর্থ হলে ৫ শতাংশ হারে ১৮ লাখ টাকার বার্ষিক সুদ দিতে হবে।
পরীক্ষার খাতা মূল্যায়ন ও ফলাফল নিয়ে অনিয়ম, কারচুপির অভিযোগে করা ক্ষতিপূরণ সংক্রান্ত এক রিটের রুল নিষ্পত্তি করে বৃহস্পতিবার (৩ আগস্ট) হাইকোর্টের বিচারপতি কে এম কামরুল কাদের ও বিচারপতি মো. শওকত আলী চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ রায় দেন।
মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন যশোর সদরের মাইক পট্টি এলাকার হরিনাথ দত্ত লেনের বাসিন্দা। তিনি কয়েক দফা ব্রেইন স্ট্রোকের পর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে বর্তমানে শয্যাশায়ী।
আদালতে এদিন মহিউদ্দিন আহমেদের রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এম শামসুল হক। তার সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী সাইফুল ইসলাম উজ্জ্বল। রাবির পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী এ বি এম আলতাব হোসেন।
রায় ঘোষণার পর মহিউদ্দিন আহমেদের শারীরিক অবস্থা সংকটাপন্ন জানিয়ে তার ছেলে আসিফ শাহরিয়ার সৌম্য জাগো নিউজকে বলেন, আমার বাবা একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত। সব মিলিয়ে একটা কঠিন সময় পার করছি। আশা করছি রাবি কর্তৃপক্ষ আদালতের রায় মেনে নিয়ে নির্দেশনা বাস্তবায়ন করবে। যদি তা না করে, তবে আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করে আইনি পদক্ষেপ নেবো।
রিট আবেদন থেকে জানা গেছে, ১৯৮৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত যশোরের শহীদ মশিউর রহমান কলেজে এলএলবিতে ভর্তি হন বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দীন আহমেদ। দুই বছর মেয়াদি পাস কোর্সে ১৯৮৮ সালে চূড়ান্ত পরীক্ষায় অংশ নেন। পরীক্ষার পর পরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোর এলএলবি পরীক্ষা এবং খাতা মূল্যায়ন নিয়ে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও দৈনিক পত্রিকায় এ নিয়ে প্রতিবেদনও হয়।
এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাবির সিন্ডিকেট একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গুরুতর অসদাচরণ, অবহেলা, দায়িত্বহীনতার দায়ে রাবির আইন বিভাগের দুই শিক্ষককে যথাক্রমে ৭ ও ১২ বছরের জন্য খাতা দেখা থেকে বিরত রাখতে নির্দেশ দেয়।
একই বছরের ৬ এপ্রিল পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হলে মহিউদ্দীন আহমেদকে অকৃতকার্য দেখানো হয়। পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন ‘দেওয়ানী কারর্যবিধি এবং তামাদি আইন’ বিষয়ে ২৫ নম্বরের মধ্যে তিনি ২৪ পেয়েছেন। খাতায় ১ নম্বরের জন্য অকৃতকার্য হওয়ায় তিনি এ বিষয়ের উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের আবেদন করেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই সময় তাকে জানায় উত্তরপত্র (পরীক্ষার খাতা) বিক্রি হয়ে গেছে।
এ নিয়ে একই বছরের শেষ দিকে তিনি যশোরের সহকারী জজ আদালতে দেওয়ানি মামলা করেন। ১৯৯০ সালের ১৯ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট উত্তরপত্র পুনর্মূল্যায়নের নির্দেশ দিয়ে রায় দেন আদালত। এ রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সালে যশোরের জেলা জজ আদালতে আপিল করে রাবি কর্তৃপক্ষ। ১৯৯৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাবির আপিল খারিজ করে দেন আদালত। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে (সিভিল রিভিশন) হাইকোর্টে আবেদন করে রাবি। এর ৬ বছর পর ১৯৯৯ সালে হাইকোর্ট রাবির সিভিল রিভিশ্যানটি খারিজ করে দিয়ে জেলা জজ আদালতের রায় বহাল রাখেন।
এ রায়ের পর রাবি কর্তৃপক্ষ এলএলবির চারটি বিষয়ের উত্তরপত্রে মহিউদ্দিন আহমেদের প্রাপ্ত নম্বর গড় করে তাকে কৃতকার্য দেখায়। ২০০১ সালে তাকে এলএলবির সনদও দেওয়া হয়। এরপর মহিউদ্দিন আহমেদ ২০০২ সালের ২২ জুন রাবি কর্তৃপক্ষের কাছে মামলার খরচ ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ১০ লাখ টাকা দাবি করে চিঠি দেন। একই বছরের ২৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চিঠি দিয়ে জানায়, হাইকোর্টের রায়ের অনুলিপি পাওয়ার পর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ তাকে জানানো হবে। এ অবস্থায় মহিউদ্দিন আহমেদ আইনজীবী তালিকাভুক্তিকরণ পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে যশোর বারে আইন পেশায় যুক্ত হন।
কিন্তু এরই মধ্যে ২০১০ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে মোট পাঁচবার ব্রেইন স্ট্রোক করেন তিনি। কয়েক দফা ব্রেইন স্ট্রোকে পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়েন। এরপর ক্ষতিপূরণের দাবি নিয়ে বিভিন্ন সময় রাবি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও এখন পর্যন্ত তাকে কিছুই জানানো হয়নি।
বিষয়টির সুরাহা করতে ২০১৯ সালের ৫ অক্টোবর, ৫ নভেম্বর, ২০২০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি, ১৮ মার্চ রাবি রেজিস্ট্রারের দপ্তরেও আবেদন করেন। প্রতিকার না পেয়ে ২০২০ সালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনেও আবেদন করেন মহিউদ্দিন। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও মঞ্জুরি কমিশিন রাবি কর্তৃপক্ষকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দেয়। তাতেও কোনো সাড়া না পাওয়ায় ২০২০ সালে ক্ষতিপূরণ চেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে লিগ্যাল নোটিশ পাঠান মহিউদ্দিন আহমেদ।
নোটিশ পাওয়ার পরও ক্ষতিপূরণের বিষয়ে কোনোরকম পদক্ষেপ না নেওয়ায় ২০২১ সালে ৩০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে রিট করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন আহমেদ। ওই রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে তাকে ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন উচ্চ আদালত। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে তা নিষ্পত্তি করে রায় দেন আদালত।
এফএইচ/এমকেআর/জিকেএস