নিবন্ধন নিয়ে আপিল সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০৮:২৩ এএম, ১৭ জুলাই ২০২৩

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে মামলার সারসংক্ষেপ জমা দিয়েছেন সংগঠনের আইনজীবীরা।

এ সংক্রান্ত মামলায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে লড়তে সংগঠনটি নিয়োগ দিয়েছে আইনজীবী।

রোববার (১৬ জুলাই) বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেন জামায়াতের আইনজীবী প্যানেলের অন্যতম সদস্য ও সুপ্রিম কোর্ট বারের সাবেক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট মুহাম্মদ সাইফুর রহমান।

তিনি বলেন, সম্প্রতি আপিল বিভাগে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী জামায়াতের পক্ষে শুনানি করবেন। তিনি আগেও জামায়াতের নিবন্ধনের মামলায় শুনানি করেন। এ ছাড়াও ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও এহসান সিদ্দিক আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তারাও মামলাটিতে সহযোগিতা করবেন।

এর আগে, গত ৩১ জানুয়ারি দল হিসেবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে দেওয়া নির্বাচন নিবন্ধন অবৈধ বলে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সারসংক্ষেপ জমা দিতে নির্দেশ দেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

চলতি বছরের গত ৩১ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন। এদিন আপিল বিভাগে জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন তুহিন। রিটকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর।

ওইদিন ‘রিটকারী আইনজীবী তানিয়া আমীর বলেন, ‘মামলাটি শুনানি করার জন্য আমরা অনেকবার উদ্যোগ নিয়েছি। আদালত তাদের (জামায়াত) অনেকবার সময় দিয়েছে। তারা গড়িমসি করে রেডি করছে না। আজকে ফাইনাল আদেশ দিলেন আদালত। যদি আট সপ্তাহের মধ্যে ফাইল (আপিলের সার সংক্ষেপ) শুনানির জন্য রেডি না করে তাহলে ডিফল্ট (খারিজ) হয়ে যাবে।’

জামায়াতের আইনজীবী মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আজকে আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় বিষয়টি ছিল। আদালত আগামী দুই মাসের জন্য সময় দিয়েছে। এ দুই মাসের মধ্যে কনসাইজ স্টেটমেন্ট (আপিলের সার সংক্ষেপ) জমা দেয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছে। আর কোনো সময় দেবে না বলে উল্লেখ করেছে।’

ওইদিন জানানো হয়, আমাদের প্রধান আইনজীবী সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী। এ ছাড়া ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও এহসান সিদ্দিক আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত আছেন। তারা এ মামলাটি পরিচালনা করবেন।’

২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি হাইকোর্ট বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০বি (১) (বি) (২) ও ৯০ (সি) অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন ঘোষণা করা হবে না-তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন আদালত।

এ রুলের দীর্ঘ শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ১২ জুন রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখেন আদালত। পরে ওই বছরের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট।

২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। সে সময় সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস, বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম ও রাষ্ট্র ধর্ম ইসলামের কথা ছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক (পরে প্রধান বিচারপতি) ও বিচারপতি মো. আবদুল হাইয়ের হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০০৯ সালের ২৭ জানুয়ারি রুল জারি করেন।

রুল জারির পর ওই বছরের ডিসেম্বরে একবার, ২০১০ সালের জুলাই ও নভেম্বরে দুবার এবং ২০১২ সালের অক্টোবর ও নভেম্বরে দুবার তাদের গঠনতন্ত্র সংশোধন করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেয়। এসব সংশোধনীতে দলের নাম ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’ করা হয়।

এর পর জামায়াতকে দেওয়া নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নিবন্ধন ২০১৩ সালের ১ আগস্ট অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেয় বিচারপতি এম মোয়াজ্জাম হোসেন, বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল-হকের হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ।

সে সময় সংক্ষিপ্ত রায়ে আদালত বলেন, এ নিবন্ধন দেওয় আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত। একই সঙ্গে আদালত ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সনদ দেন। দলটির পক্ষ থেকে হাইকোর্টের ওই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ চেয়ে আপিলও করা হয়। আপিলের নম্বর- ৭৭৮/১৩।

তবে এ রায়ের স্থগিতাদেশ চেয়ে জামায়াতের করা আবেদন একই বছরের ৫ আগস্ট খারিজ করে দেন আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। পরে ২ নভেম্বর পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে জামায়াতে ইসলামী আপিল করে।

এর আগে ২০০৯ সালে জামায়াতের নিবন্ধনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিট আবেদন করেন তরিকত ফেডারেশনের তৎকালীন মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরীসহ ২৫ জন ব্যক্তি। রিট আবেদনে অভিযোগ করা হয়, জামায়াতে ইসলামীর আদর্শ ও ভাবধারা বাংলাদেশের সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

রিট আবেদনের প্রাথমিক শুনানি শেষে ওই বছরের ২৫ জানুয়ারি হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে রাজনৈতিক দল হিসেবে ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০ বি (১) (বি) (২) এবং ৯০ সি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও সংবিধান-পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না কেন, তা জানতে চাওয়া হয়।

জামায়াতের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দলের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ তিন মানবতাবিরোধী এবং নির্বাচন কমিশনসহ বিবাদীকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়।

সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধীকরণের যোগ্য না হওয়ার বিষয়ে বলা আছে। ওই রুলের ওপর ১২ জুন পর্যন্ত নয়দিন শুনানি হয়।

আদালতে রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার তানিয়া আমীর। নির্বাচন কমিশনের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মুহসীন রশিদ, সঙ্গে ছিলেন আইনজীবী তৌহিদুল ইসলাম। জামায়াতের পক্ষে শুনানি করেন আবদুর রাজ্জাক। তাকে সহায়তা করেন আইনজীবী বেলায়েত হোসেন।

শুনানিতে তানিয়া আমীর বলেন, যে গঠনতন্ত্রের ওপর ভিত্তি করে জামায়াতে ইসলামীকে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছিল, তা ছিল নিবন্ধনের অযোগ্য। তাই নিবন্ধনের পর ওই গঠনতন্ত্র সংশোধনের সুযোগ নেই। জামায়াতের নিবন্ধন সংবিধানের ৭ ও ২৬ নম্বর অনুচ্ছেদের পরিপন্থি। সংবিধানে রাজনৈতিক দল করার মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে; তবে কোনো দলের গঠনতন্ত্র সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে, দলের নীতিতে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গবৈষম্য থাকলে সংগঠন বা রাজনৈতিক দল করা যাবে না।

মুহসীন রশিদ বলেন, ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। তখনকার পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তাদের সাময়িক নিবন্ধন দেওয়া হয়। গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সব দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের লক্ষ্যে তখন ইসি সিদ্ধান্ত নেয়। ইসির ওই সময়ের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী হয়েছে জামায়াতকে সাময়িক নিবন্ধন দেওয়ার অনেক পরে।

২০০৮ সালে জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন কমিশনে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিবন্ধিত হয়। আইন অনুযায়ী কোনো দল নিবন্ধিত না হলেও সংগঠন হিসেবে সক্রিয় থাকতে পারে কিন্তু নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না।

বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনো রাজনৈতিক দল দলীয় পরিচয়ে নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। হাইকোর্টের রায় বহাল অবস্থায় এখন থেকে আগামীতে যে কোনো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী অংশগ্রহণ করতে পারবে না।

এদিকে, হাইকোর্ট বিভাগের রায়ে নিবন্ধন অবৈধ করার বিরুদ্ধে লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, রাজনৈতিক সভা, জনসভা বা মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করা হয়েছে। একই সঙ্গে ১০ বছর পর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে নিবন্ধন ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি করায় আদালত অবমাননার অভিযোগ এনে পৃথক আবেদন করা হয়েছে। আগামী ৩১ জুলাই আপিল বিভাগে এসব আবেদন শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।

এফএইচ/এসএনআর/জেআইএম

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।