নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স
ছেলে অগ্রাধিকার পাবেন এমন বিধান অবৈধ
কোনা নিকাহ রেজিস্ট্রারের মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে লাইসেন্সের কার্যকারিতার অবসান ঘটলে নতুন লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রারের পুত্রসন্তান (ছেলে) অগ্রাধিকার পাবেন এমন বিধান অবৈধ ঘোষণা করে রায় ঘোষণা দিয়েছেন হাইকোর্ট।
অবসরপ্রাপ্ত এক নিকাহ রেজিস্ট্রারের ছেলের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা রুল খারিজ করে ২০২২ সালের ৮ ডিসেম্বর এ রায় দেন হাইকোর্ট। হাইকোর্টের বিচারপতি কাশেফা হোসেন ও বিচারপতি কাজী জিনাত হকের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হয়েছে।
আদালতে ওই সময় রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ওজি উল্লাহ, মো. ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়া, মো. আবুল কালাম ও মো. ওমর ফারুক। আর রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নূর-উস সাদিক চৌধুরী, সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল সৈয়দা সাবিনা আহমেদ মলি, ফরিদা পারভীন ফ্লোরা। আর তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম কে রহমান ও আইনজীবী মো. শরীফুল ইসলাম।
রায়ে আদালত বলেছেন, আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ অনুযায়ী ৬ (৬ ক) বিধিটি, বিধি ৫ এবং বিধি ৬ (৫) এর সুস্পষ্ট বিধানের অধীনে প্রযোজ্য হতে পারে না।
রায়ে আদালত আরও বলেন, এটা স্পষ্ট যে আবেদনকারী মেধা তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে ছিলেন। তাই আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি হলো ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটি’ মেধাতালিকা অনুসরণ করে প্যানেল প্রস্তুত করে কোনো বেআইনি কাজ করেনি। অতএব, আমরা এ রুলের গ্রহণযোগ্যতা খুঁজে পাই না। তাই রুলটি খারিজ করা হলো।
‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ এর বিধি ৬(৬ক) এ বলা হয়েছে-
৬ (৬ ক): যদি কোনো সিটি করপোরেশন, পৌরসভা বা ইউনিয়ন পরিষদ এলাকার কোনো নিকাহ রেজিস্ট্রারের মৃত্যু বা অবসরজনিত কারণে লাইসেন্সের কার্যকারিতার অবসান ঘটে তাহলে উপ-বিধি (৪) এর অধীন নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স প্রধানের উদ্দেশ্যে প্রার্থী বাছাই এবং উপ-বিধি (৬) এর অধীনে লাইসেন্স মঞ্জুরের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট নিকাহ রেজিস্ট্রারের পুত্রসন্তানকে বিবি ৮ এর অধীন যোগ্যতা থাকা সাপেক্ষে অগ্রাধিকার দিতে হবে।’
তবে, একই বিধিমালার ৫ এ বলা হয়েছে-
৫। উপদেষ্টা কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী-উপদেষ্টা কমিটির দায়িত্ব ও কার্যাবলী হবে নিম্নরূপ, যথা-
ক) এ বিধিমালার অধীন সরকার কর্তৃক নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স মঞ্জুর করিবার উদ্দেশ্যে, প্রাপ্ত দরখাস্ত পর্যালোচনাপূর্বক তিনজন প্রার্থীর একটি প্যানেল প্রস্তুত করে তা সরকারের কাছে পাঠানো এবং এ বিধিমালার উদ্দেশ্য পূরণকল্পে, অন্য যে কোনো কার্যসম্পাদন ও প্রয়োজনে সরকারকে পরামর্শ দেওয়া।
আর ‘মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩)’ এর বিধি ৬ (৫) এ বলা হয়েছে-
৬ (৫): উপদেষ্টা কমিটি প্রতিটি লাইসেন্সের বিপরীতে তিনজন প্রার্থী বাছাই করবে এবং সংশ্লিষ্ট জেলা রেজিস্টার বা সাব-রেজিস্টার উপ-বিধি (৪) এর অধীন বাছাই সম্পন্নের পরবর্তী সাতদিনের মধ্যে সব দরখাস্ত এবং প্রয়োজনীয় দলিলাদিসহ তিনজন প্রার্থীর প্যানেল সরকারের পাঠাবে।’
এখানে উপদেষ্টা কমিটি বলতে ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটিকে’ বুঝানো হয়েছে।
এর আগে মুসলিম বিবাহ ও তালাক (নিবন্ধন) বিধিমালা, ২০০৯ (সংশোধিত ২০১৩) এর বিধি লঙ্ঘন করে ২০২১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি তজুমদ্দিন উপজেলা সাব-রেজিস্ট্রারের স্বাক্ষরে (যিনি উপজেলা নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটির সদস্য সচিব) লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে বাছাই করা তিনজনের নাম সুপারিশ করাকে কেন বেআইনি ও আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে রিটকারীকে তজুমদ্দিন উপজেলার ৫নম্বর শম্ভুপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স দেওয়ার জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চাওয়া হয়।
ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার ৫ নম্বর শম্ভুপুর ইউনিয়নের অবসরপ্রাপ্ত নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. খুরশেদ আলমের ছেলে মো. মাহমুদুল হাসানের দায়ের করা রিটের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ২০২১ সালের ২৪ মার্চ এ রুল জারি করেন।
মামলার বিবরণে জানা যায়, ২০২০ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ভোলার তজুমদ্দিন উপজেলার শম্ভুপুর ইউনিয়নের নিকাহ রেজিস্ট্রার মো. খুরশেদ আলমের ৬৭ বছর পূর্ণ হওয়ায় তিনি অবসরে যান। এরপর উপজেলা সাব রেজিস্ট্রার নতুন নিকাহ রেজিস্ট্রার নিয়োগে দিতে বিজ্ঞপ্তি জারি করলে তাতে খুরশেদ আলমের ছেলে মাহমুদুল হাসান আবেদন করেন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়ে মাহমুদুল হাসান চতুর্থ হন।
পরে নিয়োগের জন্য গঠিত ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটি’ মেধা তালিকায় প্রথশ, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থান অধিকারী তিনজনের নাম সুপারিশ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সুপারিশ পাঠায়।
এরপর ২০২১ সালের ৭ এপ্রিল আইন বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব, ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা-৬ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিবের কাছে ‘নিকাহ রেজিস্ট্রার লাইসেন্স মঞ্জুরি উপদেষ্টা কমিটির’ সুপারিশ বাতিল চেয়ে আবেদন করেন মাহমুদুল হাসান।
সেই আবেদনের পর উপদেষ্টা কমিটির দাখিল করা সুপারিশ বাতিল এবং এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এ কারণে মাহমুদুল হাসান সংক্ষুব্ধ হয়ে হাইকোর্টে রিট দায়ের করেন।
রিটে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখা ৬ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব, নিবন্ধন মহাপরিদর্শক, ভোলার জেলা রেজিস্ট্রার, তজুমদ্দিন উপজেলার সাব-রেজিস্ট্রার, তজুমদ্দিন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ ১১ জনকে বিবাদী করা হয়। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর এ বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দেন হাইকোর্ট।
এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন রিটকারী মাহমুদুল হাসান। যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
রিটকারীর আইনজীবী মো. ইসমাইল হোসেন ভূঁইয়া বলেন, মাহমুদুল হাসানকে নিকাহ রেজিস্ট্রারের লাইসেন্স দেওয়ার বিষয়ে জারি করা রুল খারিজ করে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে নিয়মিত আপিল (সিপি ফাইল) দায়ের করা হয়েছে। যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
এফএইচ/এমএএইচ/জেআইএম