ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রিভিউ আপিল বিভাগের কার্যতালিকায়
বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদ সদস্যদের হাতে এনে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় রয়েছে।
প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের নিয়মিত ও পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য বৃহস্পতিবার (২০ অক্টোবর) দিন ধার্য রয়েছে।
এর আগে গত ৮ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে সর্বোচ্চ আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আজ দিন ধার্য করেন আপিল বিভাগের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের চেম্বারজজ আদালত।
জাগো নিউজকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেন অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড হরিদাস পাল।
সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে পুনর্বহাল সংক্রান্ত ওই সংশোধনী বাতিল রায়ের রিভিউ চেয়ে প্রায় ১০ মাস আগে আবেদন করে সরকার।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মুহাম্মদ এ এম আমিন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, আমরা সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালতের দেওয়া রায়ের রিভিউ শুনানির উদ্যোগ নেবো।
২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে) সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে সংক্ষিপ্ত এ রায় দিয়েছিলেন। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছিল একই বছরের ১ আগস্ট।
মূল রায়টি লিখেছেন এসকে সিনহা। ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের বিষয়ে সব বিচারপতিই একমত হন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী নিয়ে রিট আবেদন করা হলেও, আপিল বিভাগের রায়ে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গ ছাড়াও নিম্ন আদালতের বিচারকদের কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরসহ শৃঙ্খলা বিধান নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাসংক্রান্ত সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী ঘোষণা করা হয়।
এছাড়া রায়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি), তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার বিধানসংবলিত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, গণতন্ত্রসহ সার্বিক বিষয় নিয়ে আসা হয়।
এসব নিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী দল প্রধান বিচারপতির পক্ষে-বিপক্ষে মাঠে নামে। আওয়ামী লীগ ওই রায় ঘিরে এসকে সিনহার পদত্যাগও দাবি করে। আন্দোলন চলাকালে ওই বছরের ১৩ অক্টোবর ছুটি নিয়ে বিদেশ চলে যান তিনি।
এরপরে ১০ নভেম্বর সিঙ্গাপুর থেকেই রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন বিচারপতি এসকে সিনহা। যদিও সম্প্রতি নিজের লেখা একটি বইয়ে এস কে সিনহা দাবি করেছেন, তাকে পদত্যাগ ও দেশ ত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল।
আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায়ে মূল প্রসঙ্গ ছাড়াও অপ্রাসঙ্গিকভাবে অনেক কিছু টেনে আনার কারণেই ২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সরকার ওই রায়ের রিভিউ চেয়ে আবেদন দাখিল করে।
সাধারণত যেকজন বিচারপতির আদালত মূল রায় দিয়ে থাকেন, সে আদালতেই রিভিউ আবেদনের শুনানি হয়। যদি সংশ্লিষ্ট আদালতের কোনো বিচারপতি কোনো কারণে অনুপস্থিত থাকেন, তবে অন্য একজন বিচারপতিকে নিয়ে শুনানি করা হয়ে থাকে।
অর্থাৎ মূল রায় দেওয়া বিচারকের সংখ্যা ঠিক রাখা হয়। আপিল বিভাগে ওই রায় দেওয়া সাতজনের মধ্যে তিনজন বিচারপতি এরই মধ্যে অবসরে চলে গেছেন।
১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে ন্যস্ত করা হয়।
পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে ওই ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে। আপিল বিভাগের রায়ে পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হলেও সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের ব্যবস্থা রেখে দেওয়া হয়েছিল।
পরে বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী পাস করা হয়। ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়।
এ অবস্থায় সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০১৪ সালের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের ৯ আইনজীবী হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন। একই বছরের ২০১৪ সালের ৯ নভেম্বর রুল জারি করেন। ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে ২০১৬ সালের ৫ মে ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে রায় দেন আদালত।
এরপরে ২০১৬ সালের ১১ আগস্ট সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ।
ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। ২০১৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ষোড়শ সংশোধনীর আপিল শুনানিতে অ্যামিকাস কিউরি (আদালতের বন্ধু) নিয়োগ দেন আপিল বিভাগ।
আপিল শুনানিতে আদালতে মতামত উপস্থাপনকারী ১০ অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে শুধু ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে মত দেন। অপর ৯ অ্যামিকাস কিউরি ড. কামাল হোসেন, জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এম আই ফারুকী, আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া, প্রাক্তন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম, বিচারপতি টিএইচ খান, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, ফিদা এম কামাল, এ জে মোহাম্মদ আলী সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর বিপক্ষে তাদের মতামত তুলে ধরেন।
ওই বছরের ২০১৭ সালের ৮ মে শুনানি শুরু হয়ে ১১ দিন শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। এরপরে আপিল আবেদনের শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ৩ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেন।
২০১৭ সালের ২৪ ডিসেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে দেওয়া আপিল বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে রিভিউ আবেদন দাখিল করা হয়।
আপিল বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখায় রাষ্ট্রপক্ষের ৯০৮ পৃষ্ঠার এ রিভিউ আবেদনে ষোড়শ সংশোধনীর পক্ষে ৯৪টি যুক্তি দেখিয়ে আপিল বিভাগের রায় বাতিল চাওয়া হয়েছে।
এফএইচ/এসএএইচ/এএসএম