গণপিটুনি রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির অভিমত হাইকোর্টের
গণপিটুনির ঘটনায় প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা না হলে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি ও আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে না বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেণুর দুই শিশুকে মাতৃহারা করার শাস্তি নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
রোববার (১৮ সেপ্টেম্বর) রেণু হত্যা মামলায় সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্টদের মনিটরিংয়ের নির্দেশনা দিয়ে হাইকোর্ট এসব পর্যবেক্ষণ দেন।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান ও বিচারপতি মো. আতাবুল্লাহর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ স্বপ্রণোদিত হয়ে এ সংক্রান্ত নির্দেশ ও পর্যবেক্ষণ দেন।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের শুনানিতে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল ব্যারিস্টার এমরান আহমেদ ভুঁইয়া।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, রেণু হত্যা মামলা অতিরিক্ত মহানগর ষষ্ঠ দায়রা আদালতে বিচারাধীন। ভিকটিম (রেণু) পালিয়ে যাচ্ছিলেন না। তার হেফাজতে কোনো শিশুকে পাওয়া যায়নি। সে সময় কোনো অভিভাবক সন্তান হারানোর অভিযোগ না করা সত্ত্বেও আসামিরা বেআইনি জনতা গঠন করেন এবং উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার কক্ষে বেআইনি অনুপ্রবেশ করেন এবং ভিকটিমকে টেনে হিঁচড়ে বের করে নিয়ে আসেন।
‘কোনো রকম অপরাধ না করা সত্ত্বেও তাকে বলপূর্বক আটক করে এবং আত্মরক্ষায় অক্ষম এ অসহায় মায়ের বাঁচার আকুতিকে উপেক্ষা করে তার শরীরে নির্মম ও নিষ্ঠুরভাবে উপর্যুপরি ও ক্রমাগত এমনভাবে আঘাত করেন, যার উদ্দেশ্য ছিল তার মৃত্যু নিশ্চিত করা। ভিকটিমের মৃত্যু নিশ্চিত করার অভিন্ন উদ্দেশ্য ঘটনাস্থলেই উদ্ভব হওয়ার প্রমাণ রয়েছে।’
আদালত বলেন, গণপিটুনির নামে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় মানুষ হত্যার লাইসেন্স দেওয়া হবে সমাজের যে কোনো মানুষের জন্য আতঙ্ক ও অনিরাপত্তার কারণ। প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত না হলে এ রকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ করা সম্ভব হবে না। সর্বোপরি রেনুর দুই শিশুকে মাতৃহারা করার শাস্তি নিশ্চিত হওয়া অপরিহার্য বলেও মন্তব্য করেন আদালত।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে পিটুনিতে নিহত তাসলিমা বেগম রেনু হত্যা মামলা চলাকালে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত তদারকি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করতে সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ও তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট।
একই সঙ্গে সুবিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মামলার রায় ও আদেশ হওয়ার পূর্বে সাক্ষীদের যথারীতি ও যথাসময়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করাসহ ন্যায় ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ ও তদারকির জন্য কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তাও জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন আদালত।
ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ এর ৪৩৯ (১) ধারার বিধান মতে এই রুল জারি করা হয়েছে। যা মামলাটি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত বহাল থাকবে। আগামী ৮ (আট) সপ্তাহের মধ্যে ঢাকার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে। আদেশের বিষয়টি জাগো নিউজকে নিশ্চিত করেছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমেদ ভূঁইয়া।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১১২ অনুচ্ছেদের আলোকে এই মামলা চলাকালে সুবিচার নিশ্চিত করার জন্য নিয়মিত তদারকি ও পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য সংশ্লিষ্ট আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি), তদন্ত কর্মকর্তাকে (আইও) নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।আদেশের অনুলিপি সংশ্লিষ্ট আদালত, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) পাঠানো হয়েছে।
এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল এমরান আহমেদ ভূঁইয়া জাগো নিউজকে জানান, গুজবের কারণে গণপিটুনিতে নিহত রেনুর দুটি শিশু সন্তান রয়েছে। তার মামলা দেখভাল করার মতো উপযুক্ত কেউ নেই। তাই শিশুদের অভিভাবকের মামলাটি যথাযথভাবে দেখভাল করার বিষয়টি আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে আদেশ দিয়েছেন।
২০১৯ সালের ২০ জুলাই সকালে রাজধানীর উত্তর বাড্ডায় মেয়েকে ভর্তি করাবেন বলে স্থানীয় একটি স্কুলে যান তাসলিমা বেগম রেনু (৪০)। এসময় তাকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে হত্যা করা হয়।
ওই রাতেই রেনুর বোনের ছেলে নাসির উদ্দিন বাদী হয়ে বাড্ডা থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলায় অজ্ঞাত ৫০০ জনকে আসামি করা হয়। পরে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্তের পর গ্রেফতার করে পুলিশ।
মামলার প্রধান অভিযুক্ত হৃদয় ওরফে ইব্রাহিম আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। একই দিন রেনুকে পিটিয়ে হত্যার আগে ‘ছেলেধরা’ গুজব সৃষ্টিকারী রিয়া খাতুনও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। হৃদয় ও রিয়া কারাগারে রয়েছেন। জাফর হোসেন নামের আরেক আসামিও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়ে রয়েছেন কারাগারে।
এর আগে ২০২০ সালে ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনিতে রাজধানীর বাড্ডায় তাসলিমা বেগম রেনুকে হত্যার প্রেক্ষাপটে জারি করা রুলের চূড়ান্ত শুনানি শেষে গুজবের বিষয়ে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেছিলেন হাইকোর্ট।
রায়ে গণপিটুনিতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে পারে, গুজব সৃষ্টিকারী এমন যেকোনো কন্টেন্ট ফেসবুকে ছড়ানো বন্ধের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। যারা এ কাজে জড়িত তাদের চিহ্নিত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা এবং গুজব ছড়ানোর পর গণপিটুনির ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেন হাইকোর্ট।
২০২০ সালের (১ মার্চ) হাইকোর্টের বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মো. মোস্তাফিজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ নির্দেশনা দেন।
এফএইচ/আরএডি/জিকেএস