নালায় পড়ে মৃত্যু
দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিতে পারতো চসিক ও উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ
২০২১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর। রাত সাড়ে ১০টা। চশমা কিনে মামার সঙ্গে বাসায় ফিরছিলেন সেহরীন মাহবুব সাদিয়া (১৯)। কিন্তু তার আর বাসায় ফেরা হয়নি। সেদিন চট্টগ্রামে আগ্রাবাদের মাজার গেট এলাকার খোলা নালায় পড়ে যান সাদিয়া। ভাগ্নিকে উদ্ধারে সঙ্গে সঙ্গে নালায় লাফ দেন মামা। কিন্তু ব্যর্থ হন তিনি। ঘটনার চার ঘণ্টা পর সাদিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিস।
তখন মর্মান্তিক এই ঘটনা দেশে বেশ আলোড়ন তোলে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের গাফলতি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। যা আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
সাদিয়ার পরিবারকে পর্যাপ্ত পরিমাণ ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে ওই ড্রেনে পড়ে কতজন নিখোঁজ, নিহত ও আহত হয়েছেন তাও জানতে চেয়েছিলেন আদালত।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের সেই প্রতিবেদন এসেছে হাইকোর্টে। যাতে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও ওঠে আসে। এছাড়া সাদিয়ার মর্মান্তিক এই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব ছিল বলেও প্রতিবেদন উল্লেখ করা হয়।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চে প্রতিবেদনটি দাখিল করা হয়। যার অনুলিপি জাগো নিউজের কাছে রয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, নালাটি আনুমানিক ১১ ফিট চওড়া এবং ১০ ফিট গভীর। এটি সড়কের পাশে অবস্থিত হওয়ায় এবং এ নালার প্রান্তে রাস্তা সংশ্লিষ্ট জায়গায় বক্স কালভার্ট থাকায় এখানে দুর্ঘটনা রোধে কর্তৃপক্ষের আরও সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল। এছাড়া নালা সংলগ্ন জায়গায় উঁচু দেয়ালের মাধ্যমে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রয়োজন ছিল।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বৃষ্টি কারণে এই রাস্তা দিয়ে চলাচল ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। সেই ঝুঁকিপূর্ণ ফুটপাত ধরে পিচ্ছিল গার্ডারের ওপর দিয়ে হেটে যাওয়া সময় পা পিছলে পড়ে যায় সাদিয়া। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ঘটনাকে দুর্ঘটনা বললেও নালার অবস্থান ও পানি প্রবাহ বিবেচনা করে সেই স্থানে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নেওয়ার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।
জেলা প্রশাসকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, যেহেতু বাদামতলী মোড়ের কাছে আগ্রাবাদ অবস্থিত, তাই শেখ মুজিব রোডের ফুটপাত দিয়ে প্রতিদিন অনেক মানুষ চলাচল করে। আর রাস্তা সংলগ্ন নালাটি রাস্তার নিচ দিয়ে কালভার্টে মিলিত হয়েছে, এক্ষেত্রে ডাস্টবিন ভাঙার সময় নালাটিকে সুরক্ষিত করা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল।
এছাড়া নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে সংশ্লিষ্ট সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। আর নিয়মিত তদারকির মাধ্যমে সেই স্থানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন ছিল। নালার অবস্থান, প্রবাহ ও সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় ফুটপাত সংস্কারের সময় নালার ওপরের অংশ সংস্কার করে অথবা নালাটির সামনের অংশ সুরক্ষিত করে দুর্ঘটনা এড়াতে পারতো চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
প্রতিবেদনের মতামত অংশে বলা হয়, সাদিয়ার মৃত্যুর ঘটনায় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের কেউই দায় স্বীকার করেনি। উভয় কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে যে, ওই মেয়ে অসাবধানতাবশত গার্ডারের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে মারা যান। পাশাপাশি এটিকে দুর্ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
ঘটনাস্থলে নালার অবস্থান ও নিরাপত্তার বিষয়টি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দুর্ঘটনাস্থলে নালা সংলগ্ন রাস্তায় আগে সিটি করপোরেশনের ডাস্টবিন ও দেয়াল ছিল। তা নিরাপত্তা বেষ্টনী হিসেবে কাজ করছিল। কিন্তু লালখান বাজার থেকে শাহ আমানত বিমানবন্দর পর্যন্ত ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ’ প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ডাস্টবিনটি ভেঙে ফেলে।
সেখানে রাস্তার পাশে ফুটপাতের কাজ করা হলেও নালার ওপরের অংশে ফুটপাতের কাজ করা হয়নি এবং কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেনি চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ।
ফুটপাত হয়ে হাঁটার জায়গায় নালার ওপরের অংশে কোনো স্ল্যাব বসানো বা সংস্কার করা হয়নি। ফলে আনুমানিক ১১ ফুট দৈর্ঘ্য ও তিন ফুট প্রস্থ আয়তনের জায়গা অনেকটা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, যা নালায় পরে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ায়। এক্ষেত্রে ফুটপাত হয়ে কেউ সোজা হেঁটে এসে নালার অংশ খেয়াল না করলে বা অন্ধকারে ফুটপাত ধরে হাঁটলে সহজেই পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
ফলে ফুটপাত হয়ে হাঁটার সময় নালার কাছে এসে ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে হেঁটে যেতে হতো, অথবা এক ফুট প্রশস্ত হুইল গার্ড ব্যারিয়ারের ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হতো, যা ছিল অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আর সেই হুইল গার্ড ব্যারিয়ারের ওপর দিয়ে হাঁটতে গিয়ে পা পিছলে নালায় পড়ে যায় সাদিয়া।
প্রতিবেদনের বিষয়ে রিটকারীর পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. শাহীনুজ্জামান শাহীন জাগো নিউজকে বলেন, জেলা প্রশাসকের পাঠানো প্রতিবেদন হাইকোর্টে দাখিল করা হয়েছে। প্রতিবেদনটি নথিভুক্ত করেছেন আদালত। এ বিষয়ে পরবর্তীতে শুনানি ও আদেশ হবে।
এর আগে সাদিয়ার মর্মান্তিক এ মৃত্যুর ঘটনায় তার পরিবারকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ কেন দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে গত বছরের ৫ ডিসেম্বর রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি কোনো উন্নয়নমূলক কাজ চলাকালীন পথচারীদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা না নেওয়া কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা রুলে জানতে চাওয়া হয়।
একই সঙ্গে যেখানে সাদিয়া মারা গেছে, সেখানকার প্রকৃত অবস্থা কেমন, কর্তৃপক্ষের অবহেলা ছিল কি না, এ বিষয়ে প্রতিবেদন দাখিল করতে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেওয়া হয়।
হাইকোর্টের নির্দেশে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক তার কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার তানভীর হাসান চৌধুরীকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করেন।
এদিকে রিট করেছিলেন নিহত শিক্ষার্থীর মামা জাহিদ উদ্দিন বেলাল, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ও সিসিবি ফাউন্ডেশনের পক্ষে ব্যারিস্টার অনিক আর হক।
রিটে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে রিটটি উপস্থাপন করেন ব্যারিস্টার অনীক আর হক। সঙ্গে ছিলেন সিসিবি ফাউন্ডেশনের পরিচালক অ্যাডভোকেট এএম জামিউল হক ফয়সাল।
এর আগে ১৯ অক্টোবর এ বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন যুক্ত করে সিসিবি ফাউন্ডেশনের পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মো. আব্দুল হালিম ও অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান সংশ্লিষ্টদের প্রতি লিগ্যাল নোটিশ পাঠান। নোটিশ পাওয়ার সাতদিনের মধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে আইনি প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে রিট করা হবে বলে জানানো হয়েছিল।
এদিকে নালা-খালে মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ নগরবাসী। তারা বলছেন, দায় এড়ানোর এই প্রবণতা প্রমাণ করে সেবা সংস্থার মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই।
এফএইচ/জেডএইচ/জেআইএম