কোন অভিযোগে ননী তাহেরের কি দণ্ড


প্রকাশিত: ০৪:২৭ পিএম, ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

একাত্তরে সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে নেত্রকোণার রাজাকার কমান্ডার মো. ওবায়দুল হক তাহের এবং আতাউর রহমান ননীর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছেন ট্রাইব্যুনাল।

মঙ্গলবার বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এই রায়ে ছয়টি অভিযোগের চারটি সন্দেহাতীত প্রমাণ হয়। তৃতীয় ও পঞ্চম অভিযোগে দুই জনের মৃত্যুদণ্ড অথবা গুলি চালিয়ে তা কার্যকর করতে বলা হয়েছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় অভিযোগে হত্যা, নির্যাতন, লুট-পাট, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সংশ্লিষ্টতা প্রমাণিত হওয়ায় ট্রাইব্যুনাল আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দিয়েছেন। চতুর্থ অভিযোগে হিন্দুদের দেশত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে গণহত্যার ঘটনায় দুই আসামির সংশ্লিষ্টতা প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে না পারায় আদালত তাদের খালাস দিয়েছেন। এর মধ্যে ষষ্ঠ অভিযোগে গণহত্যার কথা বলা হলেও প্রসিকিউশন কোনো সাক্ষী হাজির করতে পারেনি। বাকি অভিযোগগুলোতে প্রসিকিউশনের পক্ষে মোট ২৩ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন।তবে আসামিপক্ষ কোনো সাক্ষ্য হাজির করতে পারেনি।

গত বছর ২ মার্চ অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে তাহের ও ননীর বিচার শুরু হয়। ২০১৪ সালের ১২ অগাস্ট গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে দুই জনেই কারাগারে রয়েছেন।

যে দুই অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড :

তৃতীয় অভিযোগ : একাত্তরের ১৯ অক্টোবর তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও রাজাকাররা পাকিস্তানি সেনাদের নিয়ে আছমা ইউনিয়নে হামলা চালিয়ে চানফর আরী ও ঋষি মিয়াকে ধরে নির্যাতন চালায়। পরে লাউফা গ্রামে হামলা করে এবং কয়েকজন নারীকে ধর্ষণ করে সোনার গয়না ছিনিয়ে নেয়। আসামিসহ রাজাকাররা স্থানীয় মশরব আলীর স্ত্রী নুরু নাহার আক্তারের ওপর পাশবিক নির্যাতন চালায়। ওই ঘটনায় নুরু নাহার মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন।

পরে তারা লাউফা গ্রামের পশ্চিম পাড়ায় হামলা করে ৫০/৬০টি বাড়ি লুটপাট করে আগুন দেয়। গ্রামে ছেড়ে যাওয়ার পথে রুজ আলী তালুকদার ও জাফর আলী তালুকদারকে গুলি মেরে হত্যা করে লাশ খালের পাড়ে ফেলে দেয়। ওই গ্রাম থেকে কয়েকজনকে ধরে ঠাকুরকোনা রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে রাতেই মশরব আলী তালুকদার, আলাউদ্দিন, জাহেদ আলী, আ. জব্বার, ঋষি মিয়া, চানফর আলীকে ঠাকুরকোনা রেল ব্রিজের নিচে নিয়ে গুলি চালায়। চানফর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণ বাঁচাতে পারলেও বাকিদের মৃত্যু হয়।

পঞ্চম অভিযোগ : একাত্তরের ১৫ নভেম্বর রাজাকার রাবিরামপুর বাজারে হামলা চালায় এবং মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক বদিউজ্জামান মুক্তাসহ ছয়জনকে অপহরণ করে নেত্রকোণা ডাকবাংলোর ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করার পরে সবাইকে খোলা জিপে নিয়ে শহর ঘোরানো হয় এবং রাতে মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়। এই হত্যার পরে আসামিরা উল্লাস করে।

দুই অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড :

প্রথম অভিযোগ : ১৯৭১ সালের ১৭ অাগস্ট রাজাকার ও পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের নিয়ে নেত্রকোণা থেকে নদী পার হয়ে বাউসী বাজারে হামলা চালিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে আটক করে নির্যাতন চালায়। আটকদের মধ্যে কাউকে ছেড়ে দেয়া হলেও বাউসী ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মফিজ উদ্দিন তালুকদারের ছেলে ফজলুর রহমানকে আটকিয়ে রাখে। সেখানে লুটপাট চালিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় বাজারের চার থেকে পাঁচশ দোকান। বাজারের পাশে সাহা পাড়ায় ২০/২৫টি বাড়ি লুটপাট করে অগুন ধরিয়ে দেয়।

পরে ফজলুর রহমানকে নেত্রকোণায় নিয়ে গিয়ে জেলা পরিষদ ডাক বাংলোয় নির্যাতন করে ওই রাতে তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও তার রাজাকাররা ত্রিমহোনী ব্রিজে নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করে এবং লাশ নদীতে ফেলে দেয়।

দ্বিতীয় অভিযোগ : মোহনগঞ্জ থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অফিসার মোশাররফ হোসেনের ছেলে দবির হোসেন ৭১ সালে ছিলেন মোহনগঞ্জ পাইলট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি মোহনগঞ্জ লুহিয়ার মাঠে (বর্তমানে আলী উসমান শিশু পার্ক) পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে তাদের রোষানলে পড়েন।

পরে ৪ অক্টোবর তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও রাজাকাররা বারহাট্টা রোডের নরসিংহ জিউর আখড়া এলাকায় হামলা চালিয়ে দবিরকে ধরে নির্যাতনের জন্য জেলা পরিষদের ডাক বাংলোয় নিয়ে যায়। ওই রাতেই দবির হোসেনকে মোক্তারপাড়া ব্রিজে নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় এবং এরপর তার লাশ নদীতে ফেলে দেয় আসামিরা।


যে দুই অভিযোগে খালাস :

চতুর্থ অভিযোগ : মে মাসের শেষ দিকে তাহেরের নেতৃত্বে ননী ও রাজাকাররা মোক্তারপাড়ায় মলয় বিশ্বাসের বাড়ি দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে। মলয় বিশ্বাস ও তার পরিবারের লোকজন প্রাণের ভয়ে দেশত্যাগ করেন। নেত্রকোণা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি নেজামী ইসলাম পার্টির তখনকার সভাপতি মাওলানা মঞ্জুরুল হক রাজাকার সদস্যদের নিয়ে অ্যাডভোকেট শ্রীশ চন্দ্র সরকারের বাড়ি দখল করে পার্টির অফিস করা হয়।

ষষ্ঠ নম্বর অভিযোগ : ৭১ সালের অক্টোবর মাসে আসামিরা নেত্রকোণা শহর থেকে ১৫ জন হিন্দুকে ধরে ত্রিমোহিনী ব্রিজে নিয়ে যায়। সেখানে তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়।একটি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সদস্যদের বিরুদ্ধে এই পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞের জন্য আসামিদের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ আনা হয়।

এফএইচ/জেএইচ

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।