মেঘনা থেকে বালু তুলতে পারবেন না সেলিম খান
আলোচিত-সমালোচিত চাঁদপুরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. সেলিম খানকে মেঘনার ডুবোচর থেকে বালু তোলার অনুমতি দিয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
এর ফলে ২১ মৌজায় সেলিম খানের বালু উত্তোলন বন্ধই থাকছে বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন।
রোববার (২৯ মে) প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চ এই আদেশ দেন। বেঞ্চের অপর দুই সদস্য হলেন, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।
আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী মাঈনুল হাসান। অন্যদিকে সেলিম খানের পক্ষে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি।
এর আগে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল বালু উত্তোলনে সেলিম খানকে অনুমতি দিয়ে রায় দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। সেলিম খানের রিটের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে এই রায় দেওয়া হয়েছিল।
তখন রায়ে চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকসহ বিবাদীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, ২১টি মৌজায় অবস্থিত মেঘনার ডুবোচর থেকে ৮৬ দশমিক ৩০ কিউবিক মিটার (৩০ কোটি ৪৮ লাখ ঘনফুট) বালু সেলিম খানকে উত্তোলনে অনুমতি দিতে।
এই রায়ের চার বছর পর গত মার্চে লিভ টু আপিল (আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন) করে রাষ্ট্রপক্ষ। যা ৪ এপ্রিল চেম্বার জজ আদালতে শুনানি হয়। সেদিন শুনানি নিয়ে চেম্বার জজ আদালতের বিচারপতি হাইকোর্টের রায় স্থগিত করে রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠান। এর ধারাবাহিকতায় শুনানি নিয়ে আপিল বিভাগ লিভ টু আপিল নিষ্পত্তি করে ওই সিদ্ধান্ত দিলেন।
নথিপত্র অনুযায়ী, মেঘনা নদীর চাঁদপুর ও হাইমচর উপজেলায় অবস্থিত ২১টি মৌজায় নিজ খরচে সেলিম খান হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে নির্দেশনা চেয়ে ২০১৫ সালে রিট করেন। নৌপথ সচল করার কথা বলে রিটটি করা হয়েছিল। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ওই বছরের ৯ জুলাই হাইকোর্ট রুল দেন।
এরপর রুল নিষ্পত্তি করে ২০১৮ সালের ৫ এপ্রিল রায় দেন হাইকোর্ট। রায়ে হাইড্রোগ্রাফি বিভাগের ২০১৮ সালের ৩১ জানুয়ারির চিঠি উল্লেখ করে বলা হয়, এতে প্রতীয়মান হয় যে, ওই মৌজাগুলোতে পর্যাপ্ত বালু-মাটি রয়েছে এবং তা তুলতে কোনো বাধা নেই। আপত্তি জানিয়ে বিবাদীদের (ভূমি সচিব, নৌ-পরিবহন সচিব, বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক ও হাইড্রোগ্রাফিক বিভাগের পরিচালক) পক্ষ থেকে কোনো জবাব (হলফনামা) দায়ের করা হয়নি, যাতে বিষয়টি (বালু থাকা) বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
সবশেষ ২ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে ‘পদ্মা-মেঘনার সর্বনাশ: ‘বালুখেকো’ চেয়ারম্যান তিনি’ শিরোনামে প্রতিবেদন ছাপা হয়। যা নিয়ে শুরু হয় আলোচনা।
অভিযোগ রয়েছে, গত আট বছর ধরে পদ্মা ও মেঘনা থেকে অবাধে বালু উত্তোলন করে চলেছেন সেলিম খান। তবে এই আট বছরে সরকারকে এক টাকাও রাজস্ব দেননি। এমনকি অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে পরিবেশ ও প্রাণীবৈচিত্র্যের ক্ষতি হচ্ছে।
সেলিম খান গত এক দশকের বেশি সময় ধরে চাঁদপুর সদর উপজেলার ১০ নম্বর লক্ষ্মীপুর মডেল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান।
বর্তমানে তিনি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি। সবশেষ গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ইউপি নির্বাচনে নয়জন সদস্যসহ বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হন তিনি।
পরিবেশ অধিদপ্তর ও মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা বলছেন, মেঘনায় বালু তোলার কারণে চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থান দেবে গেছে। ভেঙে পড়ছে নদীর তীরও। জাতীয় মাছ ইলিশের প্রজননও ঝুঁকির মুখে পড়েছে। অন্যদিকে নদী থেকে তোলা বালু বিক্রি করে সেলিম খানের মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রপক্ষের লিভ টু আপিলে বলা হয়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে কোনো নদী থেকে বালু উত্তোলনের জন্য হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ প্রতিবেদনই যে একক ভিত্তি নয়, তা হাইকোর্ট উপলব্ধি করতে পারেননি। বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন অনুসারে, পরিবেশ, পাহাড়ধস, ভূমিধস অথবা নদী বা খালের পানির স্রোতের গতিপথ পরিবর্তন, সরকারি স্থাপনার (যথা ব্রিজ, কালভার্ট, রাস্তাঘাট, ফেরিঘাট, হাটবাজার, চা বাগান, নদীর বাধ ইত্যাদি) এবং আবাসিক এলাকার কোনো ক্ষতি হবে কি না, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের মতামত গ্রহণ করবেন জেলা প্রশাসক।
এছাড়া বালু বা মাটি উত্তোলন করার ফলে পরিবেশ ও প্রতিবেশ নষ্ট বা সরকারি-বেসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত ও জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে ওই বালুমহাল বিলুপ্তির প্রস্তাব পাঠাতে পারবেন জেলা প্রশাসক।
লিভ টু আপিলে আরও বলা হয়, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ডুবোচরের বালু উত্তোলনের বিষয়ে কোনো ধরনের মূল্যায়ন হয়নি। এমনকি রিটে উল্লিখিত মৌজাগুলো বিভাগীয় কমিশনার বালুমহাল হিসেবেও ঘোষণা করেননি। তাই হাইকোর্ট বিভাগ বিবাদীকে (সেলিম খান) বালু উত্তোলনের অনুমতি দিতে যে নির্দেশ দিয়েছেন তা বাতিলযোগ্য।
হাইড্রোগ্রাফিক জরিপের মাধ্যমে নদীর তলদেশে কোথায় কত দূরত্বে মাটি রয়েছে, তা আধুনিক পদ্ধতিতে চিহ্নিত করা বা এর মানচিত্র তৈরি করা হয়। ডুবোচর কাটতে হলে প্রথমে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করতে হয়।
এফএইচ/জেডএইচ/এমএস