আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা: তিনপক্ষের আপিল শুনানির অপেক্ষায়
বীর মুক্তিযোদ্ধা, গাজীপুরের শ্রমিক নেতা ও আওয়ামী লীগের সাদেক সংসদ সদস্য আহসানউল্লাহ মাস্টারকে হত্যা মামলার চূড়ান্ত বিচার এখনো সম্পন্ন হয়নি। বিচারিক আদালতের রায়ের পরে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে আসামিপক্ষ, বাদীপক্ষ ও রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
এ মামলা শুনানির জন্য আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় (কজলিস্টে) এলেও বেশ কয়েকবার বাদ দিয়েছেন আদালত। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি শুনানির জন্য এলেও শুনানি হয়নি। ওইদিন এ মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ১১ জনের সাজা বাড়ানোর জন্য করা আপিল আবেদন কার্যতালিকা (কজলিস্ট) থেকে বাদ দিয়েছিলেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের বেঞ্চ এ আদেশ দেন।
এদিন শুনানিতে রাষ্টপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন। তার সঙ্গে ছিলেন ডেপুর্টি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ। আসামিপক্ষে ছিলেন খন্দকার মাহবুব হোসেন।
এ বিষয়ে শনিবার (৭ মে) রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আসামি ও বাদীপক্ষের করা লিভ টু আপিল স্বাভাবিক নিয়মে শিগগির শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসবে। রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতও রয়েছে।
এর আগে মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের দায়িত্বে নিয়োজিত আইনজীবী ছিলেন অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল ও বর্তমানে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নবনির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট মো. মোমতাজ উদ্দিন ফকির। তিনি সে সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন, মামলার নথি প্রস্তুত করতে কিছু সময় লেগেছে।
এরপর আসামিপক্ষ কয়েক দফা সময় নিয়েছে। এছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। এসব কারণে এ মামলাটির বিচার বিলম্বিত হয়েছে। তবে শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষ প্রস্তুত রয়েছে। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে আদালত বন্ধ ছিল। নিয়মিত আদালত খোলার পর মামলাটি শুনানির জন্য উদ্যোগ নেওয়া হবে।
জানা গেছে, মামলাটি শুনানির জন্য প্রথমে ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় (কজলিস্ট) ছিল। এ দিন প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগ শুনানি ৮ সপ্তাহ পিছিয়ে দেন। এরপর ৪ মার্চ মামলাটি আবার কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু এ দিন নথি না আসায় শুনানি হয়নি। সেই থেকে বার বার শুনানি পিছিয়েছে।
এরপর মহামারি করোনার প্রকোপের কারণে সবকিছুর সঙ্গে থমকে পড়ে স্বাভাবিক বিচারকাজও। আইনজীবীরা বলছেন, করোনার প্রভাব পড়ে এই মামলাটির ওপরও। প্রায় দুই বছর স্বাভাবিক বিচারকাজ পরিচালিত না হওয়ায় এ মামলায়ও শুনানি হয়নি। সর্বশেষ ২০২১ সালের ৭ জানুয়ারি আপিল বিভাগের কার্যতালিকায় (কজলিস্ট) ছিল। সেদিন আপিল বিভাগে লেখা হয়, আপাতত কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হলো। এখন লিভ টু আপিল নিষ্পত্তির অপেক্ষায়।
এর আগে ২০১৬ সালের ১৫ জুন আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যার ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের করা আপিলের শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। রায়ে ১১ জনকে খালাস দেন হাইকোর্টের বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।
রায়ে বিচারিক আদালতের দেয়া বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ অন্য ছয়জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন উচ্চ আদালত। বিচারিক আদালতে দণ্ড পাওয়া জীবিত ২৬ আসামির মধ্যে ৮ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেয়া হয়েছে। আগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত একজন পলাতক থাকায় তার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদালত। এসব আসামির মধ্যে ১৭ জন কারাগারে ও ৯ জন পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া দুজন মারা গেছেন।
বিচারিক আদালতের দেয়া ফাঁসি ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে খালাস পাওয়া ওই ১১ আসামি হলেন- আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর ও মনির।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৮ জনের মধ্যে ৭ জনের বিচারিক আদালতের দেয়া ফাঁসির সাজা কমেছে এবং বাকি একজনের আগের সাজাই বহাল রয়েছে।
এদিকে, মারা যাওয়া দুই আসামির করা আপিলের নিষ্পত্তি করেছেন আদালত। আর মামলার মোট ৩০ আসামির মধ্যে দু’জন বিচারিক আদালতেই খালাস পেয়েছিলেন।
চূড়ান্ত রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ছয়জন হলেন- নুরুল ইসলাম সরকার, নুরুল ইসলাম দিপু (পলাতক), মাহবুবুর রহমান মাহবুব, শহীদুল ইসলাম শিপু, হাফিজ ওরফে কানা হাফিজ ও সোহাগ ওরফে সরু।
মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাতজন হলেন- মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আহমেদ হোসেন মজনু (পলাতক), আনোয়ার হোসেন ওরফে আনু (পলাতক), রতন মিয়া ওরফে বড় রতন, ছোট জাহাঙ্গীর (পলাতক), আবু সালাম ওরফে সালাম ওমশিউর রহমান ওরফে মশু (পলাতক)। যাবজ্জীবন বহাল থাকা আসামি হলেন নুরুল আমিন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত অহিদুল ইসলাম টিপু পলাতক থাকায় তার সাজার বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি আদালত।
বিচারিক আদালতে ফাঁসির দণ্ডাদেশ পাওয়ার পর মারা যাওয়ায় আল-আমিন ও রতন ওরফে ছোট রতনের আপিলের নিষ্পত্তি করেন হাইকোর্ট। ৩০ আসামির বাকি দু’জন কবির হোসেন ও আবু হায়দার ওরফে মিরপুরইয়া বাবু বিচারিক আদালত থেকেই খালাস পেয়েছিলেন।
২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় আহসান উল্লাহ মাস্টারকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ঘটনার পরদিন আহসান উল্লাহ মাস্টারের ভাই মতিউর রহমান টঙ্গী থানায় ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও ১০/১২ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন।
এরপর বিচার শেষে ২০০৫ সালের ১৬ এপ্রিল বিচারিক আদালত নূরুল ইসলাম সরকারসহ ২২ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশসহ দু’জনকে খালাস দেন।
পরে বিচারিক আদালতের রায়ের বিষয়ে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপিল হয়। এরপর ২০১৬ সালে হাইকোর্টের রায় ঘোষণা করা হয়। মামলার রায়ে ৬ জনের ফাঁসি বহাল থাকে। এই মামলায় ৩০ আসামির মধ্যে নিম্ন আদালতে মোট ২৮ জনের দণ্ড হয়। এর মধ্যে ২২ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়। এসব আসামিদের মধ্যে ১৭ জন কারাগারে ও ৯ জন পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া দুজন মারা গেছেন।
হাইকোর্টের রায়ের পর ১১ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিল
আহসানউল্লাহ মাস্টার হত্যা মামলায় হাইকোর্টের রায়ে খালাসপ্রাপ্ত ১১ জনের রায় স্থগিত চেয়ে আপিল আবেদন করেন রাষ্ট্রপক্ষ।
খালাস পাওয়া ১১ আসামি হলেন- আমির হোসেন, জাহাঙ্গীর ওরফে বড় জাহাঙ্গীর, ফয়সাল (পলাতক), লোকমান হোসেন ওরফে বুলু, রনি মিয়া ওরফে রনি ফকির (পলাতক), খোকন (পলাতক), দুলাল মিয়া, রাকিব উদ্দিন সরকার ওরফে পাপ্পু, আইয়ুব আলী, জাহাঙ্গীর (পিতা মেহের আলী) ও মনির। ১১ জনের মধ্যে তিন আসামি পালাতক রয়েছেন যারা মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত।
আবেদন করার বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলে, ‘আমরা খালাসপ্রাপ্তদের রায় এজন্য স্থগিত চেয়েছি যেন মামলার রায়ের অনুলিপি প্রকাশিত হওয়ার পর আসামিরা বের হয়ে যেতে না পারেন। কারণ তাদের বিরুদ্ধে আমরা আপিল বিভাগে নিয়মিত আপিল করব।’
এফএইচ/এমএএইচ/এএসএম