সাঈদীর রায় সম্পর্কে শামসুদ্দিন চৌধুরীর মতামত
মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে দেলাওয়ার হোসইন সাঈদীর বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের রায়ে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথীবির বেশির ভাগ দেশেই এখনো মৃত্যুদণ্ড বলবৎ এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মনে করে যে, কিছু কিছু অপরাধ এতই জঘন্য, যেগুলো রোধকল্পে মৃত্যুদণ্ড বলবৎ রাখা প্রয়োজন।
তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি উন্নত দেশেও ফাঁসির দণ্ড দেয়ার তালিকায় পাঁচ নম্বরে রয়েছে। পৃথিবীতে এমন আরো অনেক দেশ আছে যেখানে, খুন ছাড়াও অন্যান্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
তিনি উল্লেখ করেন যে নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টে রিট হয়েছিলো, রায়ে সুপ্রিমকোর্টে ফাঁসির দণ্ড বহাল ছিল। পৃথিবীর অনেক দেশ মৃত্যুদণ্ড রহিত না করে দণ্ডের কার্যকরিতা সাময়িক স্থগিত করেছিল, পরবর্তীতে সন্ত্রাসী হামলার প্রেক্ষাপটে ওই স্থগিতাদেশ তুলে নিয়েছে। এর মধ্যে পাকিস্তান অন্যতম। এমনকি রাশিয়াতেও মৃত্যুদণ্ড পুনর্বহাল করার জন্য প্রচুর জনমত ভিত্তিক চাপ রয়েছে।
শামসুদ্দিন মানিক বলেন, আন্তর্জাতিক আইন মৃত্যুদণ্ডকে অস্বীকার করে না। জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনার কভনেন্ট ফর সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটর্স এর একটি ধারায় আছে যে, শুধুমাত্র গুরুতর অপরাধেই মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা যাবে। যার অর্থ এই যে, জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক আইনেও অত্যন্ত জঘন্য অপরাধের জন্য মৃত্যুদণ্ড স্বীকার করে।
জাতিসংঘের মানবাধিকারগোষ্ঠী বলেছে, খুন ছাড়া অন্য অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া ঠিক হবে না। ইংল্যাণ্ডের পিভি কাউন্সিলও মৃত্যুদণ্ডকে অস্বীকার করেননি। মৃত্যুদণ্ডকে মার্কিন সুপ্রিমকোর্টে চ্যালেঞ্জ করা হলে সেই চ্যালেঞ্জও টেকেনি। এমনকি স্যার জ্যাফরি রবার্টসন কিউসির মতো একজন যুদ্ধপরাধ বিশেষজ্ঞ যিনি মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে অত্যন্তে সোচ্চার তিনিও বলেছেন যে, অনেক খুনের মামলাই সাধারণত এবং অত্যন্ত ন্যায় সংগত ভাবেই মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে।
তিনি আরো বলেছেন, মৃত্যুদণ্ড রোধ করার মত যথেষ্ট জনমত গড়ে ওঠেনি যার ফলে একে আন্তর্জাতিক আইনের অংশ হিসেবে পরিণত করা যাচ্ছে না। তিনি আরো উল্লেখ করেন যে, মৃত্যুদণ্ড দেয়াটা যে সব ক্ষেত্রেই প্রতিশোধমূলক তা নয়, এটি অত্যন্ত সুফল প্রতিরোধ্য শক্তি হিসেবেও কাজ করে। যদিও মৃত্যুদণ্ড অনেক অপরাধই বন্ধ করতে পারেনি, কিন্তু তার পরেও সাধারণ ধারণা এই, মৃত্যুদণ্ড না থাকলে, যেসব অপরাধে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, সেসব অপরাধ আরো অধিক হারে সংঘটিত হতো।
বিশেষ করে ভারতীয় আইন এবং সুাপ্রিমকোর্টের ব্যাখ্যা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায়, অত্যন্ত বিরল ক্ষেত্রে কিন্তু তার পরেও দেখা গেছে এই ধরনের বিরল মামলার সংখ্যা মোটেও কম নয়। ভারতীয় সুপ্রীমকোর্ট শুধু বিরল ক্ষেত্রে মুত্যুদণ্ড দেয়া যাবে এই রায় দেয়ার পরেও কয়েকশ` মামলায় মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে।
বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী এমন অনেক মামলার নজির তার রায়ে উল্লেখ করেছেন এবং কি ধরনের পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় ভারতীয় সুপ্রিমকোর্টের সেই ব্যাখ্যাও বিচারাপতি মানিক রায়ে উদ্বৃত করেছেন।
তিনি উল্লেখ করেন, যে ধরনের অপরাধের জন্য এবং পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া যায় সেই ধরনের পরিস্থিতি এবং অপরাধের চেয়ে অনেক জঘন্য অপরাধ করেছেন দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। ইন্টারন্যাশনার কভনেন্ট ফর সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটর্স (আইসিসিপিআর) যে পরিস্থিতিতে মৃত্যুদণ্ড সমর্থনযোগ্য বলে উল্লেখ করেছেন, তার চেয়েও অনেক জঘন্য অপরাধ করেছে সাঈদী।
তিনি আরো বলেন, যদিও ইন্টারন্যাশনার ক্রিমিনাল কোর্ট নিজে কোন মৃত্যুদণ্ড দিতে পারে না, তবুও রোম স্ট্যাচুট যার দ্বারা উক্ত আদালত সৃষ্টি হয়েছে সেই আইন পরোক্ষভাবে মৃত্যুদণ্ড স্বীকার করে কেননা, রোম স্ট্যাচুট অনুযায়ী সদস্য রাষ্ট্রসমূহ তার নিজ দেশের আদালতে মানবতাবিরোধীদের বিচার করতে সক্ষম।
বিচারপতি মানিক বলেন, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী যে অপরাধের অংশীদার ছিলো, যেসব অপরাধ ১৯৭১ সালে এবং তার পরবর্তীকালে বিশ্ব বিবেককে অত্যন্ত মারাত্মভাবে কম্পিত করে তুলেছিলো। গণহত্যা, ধর্ষণ, লুট, অগ্নিসংযোগসহ এহেন কোন মানবতাবিরোধী অপরাধ নেই যা, দেলাওয়ার সাঈদ করেননি।
সাঈদী এদেশে পাকি উপনিবেশিক শাসন রক্ষা কল্পে সমস্ত বিবেক বুদ্ধির মাথা খেয়ে এক জঘন্য হত্যা যজ্ঞ, ধর্ষণ যজ্ঞ এবং ধ্বংস যজ্ঞে নেমে ছিলেন, যা সারা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এটাও প্রমাণিত যে, তার এবং তার পরিবারের লোকদের ভয়ে বহুলোক সাক্ষী দিতে আসেনি এবং বাড়ি থেকে পালিয়ে গেছে, তার মতো একজন জঘন্য কুলাঙ্গারকে বাঁচিয়ে রাখার অর্থ হবে তার এবং তার পরিবার কতৃক এই ধরনের অপরাধ পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ করে দেয়া।
তিনি বলেন, সাঈদী যেহেতু হাজার মানুষের প্রাণ নিয়েছে সুরতাং তার প্রাণ নেয়া কোন ভাবেই অযৌক্তিক হবে না। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চের কালো রাত্রির পরে যেসব মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী লোকজন এক পৈশাচিক উন্মাদনায় মেতে উঠেছিলেন, সাঈদী তাদের মধ্যে অন্যতম। তারা তখন ভেবেছিলেন, পাকিস্তান বেঁচে গেলো এবং পাকিস্তান নামের এই উপনিবেশিক শক্তিকে বাংলার পবিত্র মাটিতে টিকিয়ে রাখার জন্যই তারা এসব অপরাধ করেছে।
তিনি উল্লেখ করেন, সাঈদী বহু বাঙালি নারীকে ধর্ষণের জন্য শুধু পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতেই তুলে দেয়নি বরং সে নিজেও অনেক ধর্ষণ করেছে। অস্ট্রেলিয়ান ড. জেফরি ডেভিস এর মতে, কম পক্ষে চার লক্ষ্য নারী ধর্ষীতা হয়েছিলো যাদের অনেকেই গর্ভপাত করে এবং আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছিলো। অধ্যাপক মুনতাসির মানুনের মতে, এদের সংখ্যা ছিলো ছয় লাখ। এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে যে ব্যাক্তি জড়িত ছিলো, তাকে ফাঁসির দড়িতে না ঝুলানো হলে সেটা হবে ৩০ লাখ শহীদের আত্মার প্রতি এবং কয়েক লাখ ধর্ষীতা নারীর প্রতি চরম অবমাননার নামান্তর।
এই আইন বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, সাঈদী শুধু হত্যা ধর্ষণ অগ্নি সংযোগ এবং ধ্বংস যজ্ঞতেই তার অপরাধ সীমাবদ্ধ রাখেনি, সে আমাদের মুক্তিযোদ্ধের চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং ধর্ম নিরপেক্ষতার খুটিতে আঘাত করেছিলো তা সমূলে ধ্বংস করার জন্য, যা ছিলো রাষ্ট্রদ্রোহীতার সামিল। এমনকি স্বাধীনতার পরেও সে তার সেই পাকিস্তানি মতবাদ থেকে সড়ে দাঁড়ায়নি বরং গ্রেফতার হওয়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছে বাঙালি জাতীয়তাবাদের মতবাদকে শেষ করার এবং দেশের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মতবাদ প্রচার করে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের অংশ বানানোর।
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় এর আগেও আপিল বিভাগে যে কয়টি আপিল এসেছে তার সব কয়টিতেই মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন।, সেইসব অপরাধীর চেয়ে সাঈদীর অপরাধ কোন অংশেই কম নয়। যে অবস্থায় অন্যদের যেখানে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে সে অবস্থায় সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড না দেয়া হবে সম্পূর্ণ বৈষম্যমূলক।
ইব্রাহিম কুট্টির মৃত্যুর ব্যাপারে বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, যে বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা তার রায়ে এক নিঃশ্বাসে বলেছেন, যেই এজাহার সাঈদীর ছেলে আদালতে উপস্থাপন করেছেন সেটি সন্দেহাতিত ভাবে একটি ভূয়া দলিল। তিনি এও বলেছেন, সরকার এটা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে যে ওই দলিলটি ভূয়া। বিচারাপতি চৌধুরী বলেন, এই দুই ধরনের উক্তি সম্পূর্ণ এবং দ্বন্দ্বমূলক ও স্ব-বিরোধী। আদালত যখন বলে দলিলটি ভূয়া, তখন কি করে আবার বলতে পারে রাষ্ট্রপক্ষ এটা ভূয়া বলে প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি উল্লেখ করেন, কুট্টি হত্যার বিষয়ে সাঈদীর পক্ষ থেকে যেসব দলিল উপস্থাপন করা হয়েছে তা সম্পূর্ণ মিথ্যা ও ভূয়া।
বিচারপতি চৌধুরী উল্লেখ করেন যে, নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের সামনে তার বক্তব্য পেশ করাকালে ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর বিচারপতি জ্যাকসন বলেছিলেন, আমরা যদি ডিফেন্সের কথা স্বীকার করি যে, তারা এসব অপরাধ করেনি। তাহলে এই ধরনের যুক্তি মেনে নিতে হবে যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোন গণহত্যা হয়নি।
বিচারপতি মানিক বলেন, বিচারপতি জ্যাকসনের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে আমাকেও বলতে হবে আমরা যদি সাঈদীর এই উক্তি মেনে নিই, যে সাঈদী এই অপরাধ করননি তাহলে তার অর্থ হবে এটা মেনে নেয়া যে, ১৯৭১ এ পাকিস্তানি বাহিনী এবং তাদের দোসর রাজাকার আল-বদরেররা গণহত্যা, গণধর্ষণ অগ্নি সংযোগ করেনি এবং এর অর্থ হবে গোটা মানব জাতীর সঙ্গে প্রতারণা করা, কেননা গোটা বিশ্ব বাসিই জানে কি ধরনের জঘন্য হত্যা যজ্ঞ, ধ্বংস যজ্ঞ এবং কি ধরনের জঘন্যতম পালাক্রমে ধর্ষণ তাদের দোসররা করেছিলো বাংলাদেশে। তিনি আরো বলেন, সারা বিশ্বজানে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধসমূহ গোটা বিশ্বের সর্বকালের ইতিহাসেই বিরল।
বিচারপতি জ্যাকসনের অপর উক্তি উল্লেখ করে বিচারপতি মানিক লিখেছেন, যে বিচারপতি জ্যাকসন নুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালে তার বক্তব্যে বলেছিলেন, আজ যদি আমরা এসব অপরাধীদের বিচার করতে ব্যর্থ হই তাহলে আগামী দিন ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে আমাদেড়ই অপরাধের কাঠগড়ায় দাড়াতে হবে। এবং এই কথাটা আমাদের দেশের মানবতাবিরোধীদের বেলাও প্রযোজ্য।
বিচারপতি মানিক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রচলিত সাজা দেয়ার আইন ও নীতিমালা উল্লেখ করে বলেছেন, এসব নীতিমালার আলোকে একমাত্র ফাঁসিই হবে উপযুক্ত শাস্তি।
আমৃত্যু কারাদণ্ড সিনহা :
ইব্রাহিম কুট্টি বিষয়ে আসামিপক্ষ যে ফটোকপি দাখিল করছে, সেটা ভূয়া তা সরকার প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও ওই দলিলটা আমরা সন্দেহাতিত ভাবে ভুয়া বলে মনে করি। তবে রাষ্ট্র এটা ভুয়া প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। একটা অপরাধেই সে অপরাধী অন্য অপরাধগুলো রাষ্ট্রপক্ষ ভূয়া প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
অনেক অপরাধই তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে, যার বেনিফিট অব ডাউট সাঈদী পেতে পারে। সব দিক বিবেচনা করে আমরা মনে করি আমৃত্যু কারাদণ্ডটাই তার জন্য উপযুক্ত।
এফএইচ/এসকেডি/এমএস