‘এটা এখন ফাঁসির দেশ হয়ে গেছে’
নিজামী একটা বাহিনীর প্রধান ছিলেন মন্তব্য করে আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা নিজামীর প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হেসেনকে উদ্দেশ্য করে বলেন, নিজামীর বক্তৃতার বিবৃতিতে কি এটা ইঙ্গিত করে না তার ইন্ধন ছিল।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, বাংলাদেশে কাউকে মৃত্যুদণ্ড দিলেই বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে হৈ চৈ শুরু হয়ে যায়। অথচ সৌদি আরব ও চীনের ক্ষেত্রে তেমনটা হয় না। মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতি এমন কথা বলেন।
বুধবার সকাল সোয়া ৯টা থেকে দুপুর পৌনে ১টা পর্যন্ত নিজামীর আপিলের ওপর যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করা হয়। ওই সময়ে নিজেদের পক্ষে একের পর এক যুক্তি তুলে ধরেন প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার (এসকে)সিনহা এবং নিজামীর আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বিভাগের বেঞ্চে এই মামলার শুনানি চলছে। বেঞ্চের অপর সদস্যরা হলেন বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী। নিজামীর পক্ষে খন্দকার মাহবুব হোসেন ছাড়াও যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন আরেক আইনজীবী এস এম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, দেশ এখন ফাঁসির দেশ হয়ে গেছে। জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সৌদি ও চীনের অবস্থা দেখেন। আমরা একটা দিলে (মৃত্যুদণ্ড) হৈ চৈ পড়ে যায়। সৌদিতে যা হচ্ছে আমাদের দেশে তারও চেয়ে কম। ওদের টাকা আছে, স্ট্যান্ড আছে।’
শুনানিতে নিজামীর কথা উল্লেখ করে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘আমি (নিজামী) ১৯৭১ সালে ১৯-২০ বছর বয়সের ছাত্র ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের পর ছাত্রসংঘের আর কোনো দায়িত্বে ছিলাম না। তাই আমি কাউকে হত্যা, গণহত্যার জন্য বক্তব্য দিইনি। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনারা মুজাহিদের পূর্ণাঙ্গ রায় দেখেননি? ওখানে বলা আছে কার দায়দায়িত্ব কতোটুকু।’
খন্দকার মাহবুবকে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘তারা (নিজামীরা) যদি পাকিস্তানিদের সমর্থন না করতেন, তাহলে সিন্ধু, পাঞ্জাব, বেলুচিস্তান থেকে এসে তারা এ দেশে নয় মাস থাকতে পারতেন না। তারা তিন মাস থাকতেন। ১৯৭১ সালে দেশে আইনশৃঙ্খলা ছিল না। তারা ব্যক্তিগতভাবে ইয়ে করেছে। মানে সহযোগিতা করেছে মিলিটারিদের। এরা জড়িত ছিল।’
জবাবে খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘৩০ সেপ্টেম্বরের পর উনি নেতা ছিলেন না।’ এ সময় প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বিভিন্ন সংবাদে রয়েছে উনি নেতা ছিলেন। ওনার বক্তব্য প্রচার হয়েছে। যুদ্ধের শেষ দিকে অনেক নর-নারী হত্যা করা হয়েছে। এটা থেকে প্রমাণ হচ্ছে না উনি (নিজামী) লিডার ছিলেন?’
প্রধান বিচারপতির ওই বক্তব্যের পর খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘মতিউর রহমান নিজামী ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তানের দায়িত্বে ছিলেন। কিন্তু বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা ছিল এর পর।’ ওই বক্তব্যের পরিপ্রক্ষিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘৭১ সালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল না। এরাই সহযোগিতা করেছেন মিলিটারিদের।’ তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের শেষে যদি এ কথা বলেন, তাহলে কি প্রমাণ হচ্ছে না যে, নিজামী লিডার ছিলেন?
তখন আপিল বিভাগের সিনিয়র বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা খন্দকার মাহবুব হোসেনের প্রতি জিজ্ঞাসা করে বলেন, ‘নিজামী একটা বাহিনীর প্রধান ছিলেন এতে কি সেটা ইঙ্গিত করে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, আপনি টোকিও ট্রায়াল দেখেন।’ খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘টোকিও ট্রায়াল দেখাবেন না। আপনারা তাহলে ১৯৫ জন পাকিস্তানি সেনার বিচার করছেন না কেন? পাকিস্তান তো জড়িত ছিল।’ জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আজ তো পাকিস্তান এটা অস্বীকার করছে।’
খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘ঘটনা ঘটেছে, এটা সত্য। কিন্তু নিজামী ওই সময় আলবদর বাহিনীর সুপিরিয়র (সর্বোচ্চ) ক্ষমতায় ছিলেন না। দেশের পুলিশ বাহিনী পাক আর্মিদের পথ দেখিয়েছে। কোনো আর্মি মুভ করতো না যদি পুলিশ লিড না দিতো। নিজামীর মতো ইয়াংরা (তরুণ) পথ দেখালো আর আর্মিরা সেখানে গেলো- এটা ইমপসিবল।’
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘নিজামী একটা বাহিনীর প্রধান ছিলেন না; ছাত্রসংঘের লিডার ছিলেন।’ এ সময় তিনি আদালতে একটা মামলার প্রতিবেদন পড়ে বলেন, ‘‘এ প্রতিবেদনে লেখা আছে, ‘মাদানী বাহিনীর মতো জেহাদে ঝাঁপিয়ে পড়ে।” এভাবে রক্ত ঝরলো, আর বাকি থাকলো কী।’ ওই সময় খন্দকার মাহবুব বলেন, ‘এটা এখন ফাঁসির দেশ হয়ে গেছে।’
জবাবে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এটা বলবেন না; সৌদি, চীনে কী হচ্ছে? আমরা একটি দিলে হৈ চৈ পড়ে যায়। সৌদিতে যা হচ্ছে আমাদের দেশে তার এক পার্সেন্টও হচ্ছে না। ওদের টাকা আছে, স্ট্যান্ড আছে।’
এফএইচ/বিএ