জাল নথিতে হাজার কোটির সম্পত্তি দখল, হাইকোর্টে কোটি টাকা জরিমানা
ভুয়া জন্ম ও নাগরিকত্ব সনদ দাখিল করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি নিয়ে নেয় জালিয়াত চক্র। সেটি নিম্ন আদালতে ধরা না পড়লেও ধরা পড়েছে উচ্চ আদালতে। পরে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে দেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে জালিয়াতি চক্রের হোতা মাধব চন্দ্র সাহাকে এক কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
জাল জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও সিটি করপোরেশনের নাগরিক সনদপত্র দাখিল করেছিলেন তারা। এসব জাল কাগজপত্র দিয়েই সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অবমুক্তির রায় হাসিল করে নেয় ওই জালিয়াত চক্র। তারা জমি দখল করতে পরিচয় দেন বীরেশ চন্দ্র সাহার সন্তান হিসেবে।
হাইকোর্ট বলেছে, আবেদনকারী মাধব ও রোহী বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হলে বাবা-মায়ের সঙ্গে তাদের পারিবারিক ছবি আদালতে দাখিল করতেন। বাবা-মায়ের নামের ভোটার তালিকা উপস্থাপন করতেন। বাবা-মা কবে মারা গেছেন, কোথায় দাহ করা হয়েছে বলতে পারতেন।
তাদের অন্যান্য আত্মীয়-স্বজনের নাম, ঠিকানা বলতে পারতেন। নথি পর্যালোচনায় এটা দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, আবেদনকারীরা বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দারের সন্তান হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। জাল কাগজ দাখিল করে তারা আদালতের সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। এই জালিয়াতি ও প্রতারক চক্র জাতির শত্রু।
হাইকোর্টের বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের দেয়া পূর্ণাঙ্গ রায়ে এমন পর্যবেক্ষণ দেন। ২০২০ সালে দেওয়া রায়ের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়।
এদিকে নথিপত্র সঠিকভাবে যাচাই না করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অবমুক্তির রায় জালিয়াত চক্রের অনুকূলে দেওয়ায় অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ এবং আপিল ট্রাইব্যুনালের বিচারকের সমালোচনাও করেছেন হাইকোর্ট।
আদালত পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মাধব ও রোহী চন্দ্র সাহা নিজেদেরকে ক্ষেত্র মোহনের নাতি ও বীরেশ চন্দ্র সাহার সন্তান দাবি করে মূল মালিকের উত্তরাধিকারী হিসাবে সম্পত্তি ফেরত পেতে মামলা করেন। কিন্তু এদের মালিকানার বিষয়টি যাচাইয়ের সুযোগ ছিল ট্রাইব্যুনালের। সেটি না করে শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও ঢাকা সিটি করপোরেশনের নাগরিকত্ব সনদ বিবেচনা করে কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি জালিয়াত চক্রকে দিয়ে দেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সাভারের গান্ধারীয়ায় জমি নিয়ে এই জালিয়াতি ঢাকা জেলার সাভারের গান্ধারীয়া মৌজার ২ নং খতিয়ানের এস.এ ৩০ নং দাগের ১৫ দশমিক ২ একর, ৭২ নং দাগের শূন্য দশমিক ১৬ একর, ৭৮ নং দাগের শূন্য দশমিক ৫৬ একরসহ মোট ১৫ দশমিক ৭৪ একর ভূমির মালিক বীরেশ চন্দ্র সাহা পোদ্দার।
তিনি ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ভারতে চলে যান। ফলশ্রুতিতে নালিশি সম্পত্তি সেনসাস লিস্ট অনুযায়ী শত্রু সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। পরবর্তীকালে নালিশি সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি তথা ভেস্টেড প্রপার্টি (ভি.পি) তালিকাভুক্ত হয়।
দীর্ঘ ৪৭ বছর পর ২০১২ সালে মাধব চন্দ্র সাহা পোদ্দার ও রোহী চন্দ্র সাহা সংশ্লিষ্ট মৌজার এক হাজার ৫৫৬ শতাংশ সম্পত্তির মালিকানা দাবি করে এবং প্রকাশিত গেজেটে ‘ক’ তফসিলভুক্ত অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্তির জন্য ঢাকার অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনালে মামলা দায়ের করেন।
২০১৬ সালে ২৫ অক্টোবর সাভারের সিনিয়র সহকারী জজ আদালত এক রায়ে বাদি পক্ষের আবেদন মঞ্জুর করে নালিশি সম্পত্তি অবমুক্তির আদেশ দেন। রায়ে বলা হয়, মামলার বাদীরা যে বীরেশ চন্দ্র সাহার ওয়ারিশ নয় সেই মর্মে কোনো প্রমাণ আদালতে দাখিলে বিবাদীরা ব্যর্থ হয়েছেন।
এছাড়া বাদিদের দাখিল করা নথি (জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্মসনদ ও ঢাকা সিটি করপোরেশন কর্তৃক নাগরিক সনদপত্র) যে জাল তাও প্রমাণ করতে পারেনি। সাক্ষ্য-প্রমাণ পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে বীরেশ চন্দ্র সাহার সম্পত্তি অবৈধভাবে ভিপি তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। বাদিরা তার বৈধ ওয়ারিশ।
পরে এই রায়ের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন সাভার থানা অসহায় পরিবার পুনর্বাসন বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড। রিটে অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল ও আপিল ট্রাইব্যুনালের রায় ও ডিক্রি অবৈধ ঘোষণার আবেদন জানানো হয়। ওই রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট রুল জারি করে। ওই রুলের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে গত বছর ২০২০ সালে হাইকোর্ট দুটি ট্রাইব্যুনালে রায় বাতিল করে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে বলা হয়েছে, পুনরায় জাল দলিল সৃজন করে এই নালিশি সম্পত্তি গ্রাস করার প্রচেষ্টা প্রতিহত করতে মূল মালিক ‘ক্ষেত্র মোহন’ এর নামে সাভার অঞ্চলের শিশু কিশোরদের জন্য একটি শিশু পার্ক নির্মাণ করতে ঢাকার ডিসিকে নির্দেশ দেওয়া হলো।
এফএইচ/এমএইচআর/এমএস