ব্রিটিশবিরোধী স্মৃতি বিজড়িত ভবন ভাঙতে পারবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক
নিজস্ব প্রতিবেদক নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ০১:৫৬ পিএম, ০৬ জানুয়ারি ২০২১

চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জের ‘বাংলা কলেজ’ এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবন ভাঙার বিষয়ে স্থিতাবস্থা জারি করেছেন হাইকোর্ট। ফলে ২০০ বছরের পুরানো সেই ভবন ভাঙতে পারবে না বলে জাগো নিউজকে জানিয়েছেন আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আলম চৌধুরী।

এর আগে ‘বাংলা কলেজ’ এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত ভবন রক্ষায় করা এক রিট আবেদনের ওপর শুনানি নিয়ে বুধবার (৬ ডিসেম্বর) হাইকোর্টের বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মো. খায়রুল আলমের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ এ আদেশ দেন।

আদালতে রিট আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ব্যারিস্টার হাসান এম এস আজিম। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।

আইনজীবী হাসান এম আজিম বলেন, আদালত রুল জারি করে ভবনটির দখল ও অবস্থানের ওপর এক মাসের স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে পরবর্তী আদেশের জন্য আগামী ৮ ফেব্রুয়ারি মামলাটি (কজলিস্ট) কার্যতালিকায় থাকবে।

রুলে প্রাচীন পুরাকীর্তির এ ঐতিহাসিক যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ভবন বর্তমানে শিশুবাগ স্কুল ভবন রক্ষায় বিবাদীদের ব্যর্থতা কেন অবৈধ হবে না এবং ওই ভবন পুরাকীর্তির তালিকায় কেন অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেয়া হবে না তা জানতে চেয়েছেন আদালত।

হাইকোর্টে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মাসুদ আলম চৌধুরী এ রিট দায়ের করেন। রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী হাসান এমএইচ আজিম।

আবেদনে ৫ জানুয়ারি দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন সংযুক্ত করা হয়। সংস্কৃতি সচিব, প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের মহাপরিচালক, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ কমিশনারসহ ছয়জনকে বিবাদী করা হয়েছে।

খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের কোতোয়ালি থানার রহমতগঞ্জের ‘বাংলা কলেজ’ এলাকায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত একটি ভবন রক্ষায় বুলডোজারের সামনে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত।

সোমবার ওই জায়গার জনৈক ‘ক্রেতা’ পুলিশ ও লোকবলসহ ভবনটি ভাঙতে আসার খবর পেয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ও হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ছুটে আসেন।

জামালখান ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর জহর লাল হাজারীসহ অনেকেই তার পাশে দাঁড়ান। ভাঙার দৃশ্য দেখে বিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম নিতে আসা অভিভাবকদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দেয়।

পত্রিকার ওই প্রতিবেদনে ‘শিশুবাগ’ কিন্ডারগার্টেন পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মো. শাহজাহান বলেছেন, প্রিন্সিপাল ইসহাক ১৯৬৬ সালে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু জমি কিনেন এবং কিছু জমি সরকারের কাছ থেকে লিজ নিয়ে বাংলা কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আধুনিক শিশুশিক্ষা প্রতিষ্ঠান শিশুবাগ।

তিনি আরও বলেন, ১৯৭৮ সালে শিশুবাগ সরকারের অনুমোদন পায়। অর্ধশতাধিক বছরের প্রাচীন এ প্রতিষ্ঠানটিতে চসিক নির্বাচনের ভোট কেন্দ্র হিসেবেও তালিকাভুক্ত। জনৈক ক্রেতার ডিক্রির বিষয়ে আমাদের করা মামলা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। প্রয়োজনে আমরা উচ্চ আদালতে যাব।

কোতোয়ালি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. কবির হোসেন জানান, একটি দেওয়ানী মামলায় আদালতের নির্দেশে সংশ্লিষ্ট নাজির ডিক্রিপ্রাপ্তদের জমি দখল বুঝিয়ে দিতে গিয়েছিলেন। সিএমপির সিটি স্পেশাল ব্রাঞ্চের নির্দেশে আমাদের পুলিশ সদস্যরা সেখানে ছিলেন। দখল বুঝিয়ে দেয়া বা উচ্ছেদ করার কাজে কোতোয়ালি থানা পুলিশের কোনো ভূমিকা ছিল না।

মঙ্গলবার ঐতিহাসিক স্থাপনা ভাঙার প্রতিবাদে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে করে চট্টগ্রাম ইতিহাস সংস্কৃতি গবেষণা কেন্দ্র। এরমধ্যে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী মাসুদ আলম চৌধুরী।

মঙ্গলবার প্রকাশিত দৈনিক আজাদির প্রতিবেদনে বলা হয়, নগরীর রহমতগঞ্জ এলাকার শিশুবাগ স্কুলের ভবন ভাঙা নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে। সোমবার (৪ জানুয়ারি) দুপুরে ভবন ভাঙাকালীন দুইপক্ষকে মুখোমুখি অবস্থান নিতে দেখা যায়। পরে হিন্দু-বৌদ্ধ- খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্তসহ বিভিন্ন জনের হস্তক্ষেপে ভবন ভাঙা স্থগিত রাখা হয়। যদিও এর আগেই স্কুলের বেঞ্চ-টেবিলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি বের করে ভবনের উপরের একাংশ বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয়।

দুপুরের পর থেকে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। কোতোয়ালি থানার এসআই অমিতাভসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুলিশ সদস্য সেখানে দায়িত্ব পালন করছিলেন। জেলা প্রশাসনের একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

জানতে চাইলে আদালতের রায়ের ভিত্তিতে এম. ফরিদ চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি তার দখল সত্ত্ব বুঝে নিতে সেখানে গেছেন বলে জানান কোতোয়ালী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মহসীন। তবে ভবন ভাঙার কাজ শুরুর কিছুক্ষণ পর বিভিন্নজনের হস্তক্ষেপে তা স্থগিত রাখতে নির্দেশনা আসে। নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে ভবন ভাঙা কার্যক্রম বর্তমানে স্থগিত রয়েছে।

স্থানীয়দের দাবি, স্কুলটি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি। যা ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। ভারতীয় কংগ্রেসের নেতা যাত্রামোহন সেনগুপ্ত এই বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন। চট্টগ্রামের এই আইনজীবীর ছেলে হলেন দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত। ব্যারিস্টার যতীন্দ্রমোহনও ছিলেন সর্বভারতীয় কংগ্রেসের নেতা। তিনি কলকাতার মেয়রও হয়েছিলেন। ইংরেজ স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তাকে নিয়ে কিছুদিন ভবনটিতে ছিলেন তিনি। মহাত্মা গান্ধী, সুভাষ চন্দ্র বসু, শরৎ বসু, মোহাম্মদ আলী ও শওকত আলীসহ কংগ্রেসের শীর্ষ নেতারা বিভিন্ন সময় এই বাড়িতে এসেছিলেন। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবীরাও এই বাড়ির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। সূর্য সেন, অনন্ত সিংহ, অম্বিকা চক্রবর্তীর হয়ে মামলা লড়েছিলেন যতীন্দ্রমোহন। এতে ব্রিটিশ শাসকদের রোষানলে পড়ে ১৯৩৩ সালে কারাগারে মৃত্যু হয়েছিল যতীন্দ্রমোহনের।

এরপর নেলী সেনগুপ্তা ১৯৭০ সাল পর্যন্ত রহমতগঞ্জের বাড়িটিতে ছিলেন। ১৯ গণ্ডা এক কড়া পরিমাণ জমিটি পরে শত্রু সম্পত্তি ঘোষিত হয়। এরপর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে শামসুদ্দিন মো. ইছহাক নামে এক ব্যক্তি জমিটি লিজ বা ইজারা নিয়ে ‘বাংলা কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন সেখানে। পরে নাম বদলে সেই ভবনে ‘শিশুবাগ স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। ইছহাকের সন্তানরা স্কুলটি পরিচালনা করছেন। প্লে থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বর্তমানে প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী স্কুলটিতে অধ্যয়ন করছে বলে জানিয়েছেন শিশুবাগ স্কুলের পরিচালক আবু নাসের টিপু। কর্মরত শিক্ষকের সংখ্যা প্রায় ২০ জন বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত বাড়িটি রক্ষায় ঐক্যবদ্ধভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি এই বাড়িটিকে স্বাধীনতা সংগ্রামীদের স্মৃতি রক্ষার্থে জাদুঘর হিসাবে গড়ে তোলার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত তৎকালীন সময়ে রেল শ্রমিক আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে তাদের অনেক স্কুল কলেজ রয়েছে। এছাড়া মহাত্মা গান্ধী, জহরলাল নেহেরু, নেতাজি সুভাষ বসু, মৌলানা মুহাম্মদ আলী ও মৌলানা শওকত আলী ভ্রাতৃদ্বয়সহ অনেক নেতৃবৃন্দ এই বাড়িতে আতিথ্য গ্রহণ করেছেন।

এছাড়া মাস্টারদা সূর্যসেনের ফাঁসির আদেশের বিরুদ্ধে তৎকালীন সময়ে যেসব আইনজীবী মাস্টারদার পক্ষে আইনি লড়াইয়ের জন্য চট্টগ্রামে এসেছিলেন তারাও এই বাড়িতে ছিলেন বলেও জানান রানা দাশগুপ্ত।

এফএইচ/এসজে/এমআরআর/এমকেএইচ/এমএস

পাঠকপ্রিয় অনলাইন নিউজ পোর্টাল জাগোনিউজ২৪.কমে লিখতে পারেন আপনিও। লেখার বিষয় ফিচার, ভ্রমণ, লাইফস্টাইল, ক্যারিয়ার, তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি ও প্রকৃতি। আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন [email protected] ঠিকানায়।