প্রধান সাক্ষী থেকে ফাঁসির আসামি মিন্নি
বরগুনার আলোচিত রিফাত শরীফ হত্যা মামলার দশ আসামির মধ্যে ৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৪ জনকে খালাস দিয়ে রায় ঘোষণা করেছেন বরগুনার আদালত। এই মামলার প্রধান সাক্ষী ছিলেন রিফাত শরীফের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। পরে তাকে সাক্ষী থেকে আসামি করা হয়। এরপর রায়ে আজ তারও মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেছেন আদালত।
মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অন্যরা হলেন- মো. রাকিবুল হাসান ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), রেজোয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২) ও মো. হাসান (১৯)। আর খালাসপ্রাপ্তরা হলেন- মো. মুসা (২২), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সায়মুন (২১)।
১০ আসামির মধ্যে মুসা পলাতক রয়েছেন। রায় ঘোষণার পর মিন্নিকে গ্রেফতার দেখিয়েছে পুলিশ। বর্তমানে পুলিশ হেফাজতে রয়েছেন তিনি। মুসা ছাড়া বাকিরা রিফাত হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে শত শত লোকের ভিড়ে রিফাত শরীফকে (২৫) কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ঘটনার পরদিন ১২ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও ৫-৬ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন নিহত রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ। ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক ও অপ্রাপ্তবয়স্ক দুভাগে বিভক্ত করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেয় পুলিশ। এতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জনকে অভিযুক্ত করা হয়।
রিফাতের স্ত্রী হিসেবে এই মামলায় প্রধান সাক্ষী ছিলেন আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি। পরে তাকে সাত নম্বর আসামি করে ২৪ জনের বিরুদ্ধে বরগুনার জ্যেষ্ঠ বিচারিক আদালতে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করে পুলিশ। মামলার প্রধান ও প্রত্যক্ষ সাক্ষী মিন্নিকে আসামি করার পেছনে যেসব কারণ রয়েছে, তার কিছুটা জানা গেছে পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার মাধ্যমে।
জেলা পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, মিন্নিকে রিফাত শরীফ হত্যা মামলায় অভিযুক্ত করার পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। যার মধ্যে প্রথমত মিন্নি তার স্বামী রিফাত হত্যার ঘটনায় সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন। তাছাড়া মামলায় এজাহারভুক্ত দুই নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী, তার ভাই তিন নম্বর আসামি রিশান ফরাজী, ছয় নম্বর আসামি রাব্বি আকন এবং ১২ নম্বর আসামি টিকটক হৃদয় আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে মিন্নির সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছেন।
তিনি আরও জানান, রিফাত হত্যায় নয়ন বন্ডের সঙ্গে পরিকল্পনায় ছিলেন মিন্নি। ২৬ জুন ঘটনার দুই দিন আগে রিফাত শরীফ হেলাল নামে তার এক বন্ধুর মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেন। হেলাল রিফাত শরীফের বন্ধু হলেও নয়ন বন্ডের খুব ঘনিষ্ঠ। তাই ছিনিয়ে নেয়া মোবাইল ফোন উদ্ধারের জন্য নয়ন বন্ড দ্বারস্থ হয় মিন্নির।
নয়ন বন্ডের অনুরোধে হত্যাকাণ্ডের দুই দিন আগে রাতে সেই ফোন রিফাত শরীফের কাছ থেকে উদ্ধার করেন মিন্নি। কিন্তু এ ফোন উদ্ধার করতে গিয়ে রিফাত শরীফের মারধরের শিকার হন তিনি। পরে হত্যাকাণ্ডের আগের দিন নয়নের সঙ্গে দেখা করে মিন্নি সেই ফোন তার হাতে তুলে দেন। এ সময় মিন্নি তার স্বামী রিফাত শরীফের হাতে যে মারধরের শিকার হয়েছেন তার প্রতিশোধ নিতে বলেন নয়নকে। এরপর ওইদিন বিকেলে বরগুনা কলেজ মাঠের শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে নয়ন বন্ড ও তার বাহিনীর সঙ্গে রিফাত শরীফকে মারধরের বিষয়ে সভা করেন মিন্নি। এছাড়া রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডের আগে এবং পরে নয়ন বন্ডের সঙ্গে মিন্নির একাধিকবার মোবাইল ফোনে কথা হয়েছে।
ওই পুলিশ কর্মকর্তা জানান, হামলার আগ মুহূর্তে রিফাত শরীফের সঙ্গে মিন্নি কলেজ থেকে বের হলেও পরিকল্পনা অনুযায়ী কলেজের সামনে তাকে মারধরের কোনো প্রস্তুতি দেখতে না পেয়ে সময়ক্ষেপণ করেন। এর জন্য মিন্নি রিফাত শরীফের বাধা উপেক্ষা করে আবার কলেজে প্রবেশ করেন। এর কিছুক্ষণ পরই নয়ন বন্ড বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য একত্রিত হয়ে রিফাত শরীফকে আটক করে মারধর করতে করতে কলেজের সামনের রাস্তা দিয়ে পূর্ব দিকে নিয়ে যায়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রিফাতকে মারধর করা হচ্ছে দেখে স্বাভাবিকভাবে হাঁটছিলেন মিন্নি। তবে পরিকল্পনার বাইরে গিয়ে নয়ন বন্ড রিফাত শরীফকে মারধর শুরু করলে মিন্নি তখনই এগিয়ে আসেন।
গত বছরের ২৬ জুন হত্যাকাণ্ডের পর রিফাত শরীফের বাবা আব্দুল হালিম দুলাল শরীফ মিন্নিকে প্রধান সাক্ষী করে বরগুনা থানায় হত্যা মামলা করেন। এরপর ১৩ জুলাই রিফাত হত্যাকাণ্ডে মিন্নি জড়িত থাকার অভিযোগ এনে সংবাদ সম্মেলন করেন তিনি। পরদিন মিন্নিকে গ্রেফতারের দাবি জানিয়ে মানববন্ধন করা হয়। যদিও মিন্নি হাইকোর্ট থেকে জামিন নিয়ে কারাগারের বাইরে ছিলেন। এখন থেকে তাকে কারাগারে যেতে হবে।
এফএইচ/এমএসএইচ/এমএস